“মাতা-পিতামহাক্রমে বঙ্গেত বসতি/দেশীভাষা উপদেশ মনে হিত অতি” — লিখেছিলেন মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম। এমন কথা উচ্চারিত হলেও মুসলমান বাঙালি ভাষাগত সঙ্কটে ভুগেছে অনেককাল। বাংলা ভাষা গরীবের ভাষা, নিচুস্তরের (আতরাফ) লোকেদের কথ্য — এমত ধারণা বিরাজমান ছিল বাংলার মুসলিম সমাজের উচ্চ-কোটি স্তরের মুষ্টিমেয় আশরফীদের মধ্যে। এরা নিজেদের আফগানি বা মুঘল ঘরানার বলেই গর্বিত ছিলেন। এরা বাংলা ভাষা কেন, বাঙালি মুসলমানদেরও অত্যন্ত নিচু চোখে দেখতেন। বাংলা ছিল তাদের কাছে মূর্তিপূজক হিন্দুর ভাষা। নবনূর পত্রিকায় লেখাই হয়েছিল, বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুগণের ভাষা। এমনকি বাঙালি মুসলমানরা একটু বিত্তশালী হলে উর্দুভাষী আশরফীদের জাতে উঠতে চাইতো! মাতৃভাষাকে অবদমনের এই আপওয়ার্ড ট্রেন্ড কি এখনও দুই বাংলার বাঙালিকে তাড়িত করেনা?
এরও কতপরে ৫২-র ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে একইরকম আক্রমন, একটু ভিন্ন মাত্রায় সক্রিয় ছিল ওপার বাংলায়। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন আসলে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র, মুসলমানের ভাষা উর্দু, বাংলা হিন্দুর ভাষা — এমন এক সাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা সক্রিয় ছিল পাক শাসকদের আচরণে। এ পারের বাঙালি ওপার বাংলার ঘটনায় নিষ্ক্রিয় ছিলনা। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হলেও দুই বাংলার মুখের বুলি বাংলা। এপারের পত্রপত্রিকায় খবর আসছিল নানারকম। আনন্দবাজার পত্রিকা বেশ কয়েকটি সম্পাদকীয় মন্তব্যে পূর্বপাকিস্তান সরকারের ধর্মীয় জিগির এর প্রতিবাদ করে। আন্দোলনকারী মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২-র ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা দমনে গুলী’ শীর্ষক সম্পাদকীয় তে বলা হয়, “বাঙলা ভাষাই পাকিস্তানের বৃহত্তম ভাষা। পূর্ববঙ্গের অধিবাসীর সংখ্যা সাড়ে চার কোটি, সমগ্র পাকিস্তানী জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ। রাষ্ট্রের বৃহত্তম সংখ্যক অধিবাসী যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাহার মর্যাদা রাষ্ট্রে স্বীকৃত হইবে না ইহা কোন ধরনের শাসন?” ‘পূর্ববঙ্গ কি লাহোর- করাচির অধীন এক নামরাজ্য?’ লাহোর থেকে আট শতাধিক মাইল দূরের শাসকরা কি এমনই শক্তিমান, এ প্রশ্নও উঠে আসে। এরপর ‘মাতৃভাষার জন্য’, ‘যৎকিঞ্চিত’, ‘দুর্বুদ্ধি’ শীর্ষক কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়। ‘মুস্কিল আসান’ নামক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধী লোক যদি পূর্ববঙ্গে থাকে তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক, “কিন্তু মুসলমান সাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য হিন্দু, ভারত এবং কলকাতার সংবাদপত্র লইয়া এই অপপ্রয়াস কেন?” কেবল হিন্দু বলেই কেউ মাতৃভাষার পক্ষে কথা বলার অধিকারী নয়! ‘দুর্বুদ্ধি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় তে প্রশ্ন তোলা হয় যে পূর্ববঙ্গের হিন্দুর কোন কথা বলা বা কোন কাজ করার অর্থই হল ‘সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রবিরোধী’? ধুতিপরা হিন্দুর জুজু দেখছে পাক সরকার! তাই “সর্বাগ্রে ধুতিপরা হিন্দুকে গ্রেপ্তার কর” কারণ এরা রাষ্ট্রবিরোধী! আনন্দবাজার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল এই মিথ্যাচার, এই ধোকা পূর্ববঙ্গের মানুষ মেনে নেবেনা। ৫২ থেকে ৭১-এর সময়পর্বে বাংলাদেশের উত্থান এই কথাই প্রমান করে।
বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ধর্মীয় জিগির এর সঙ্গে ছিল আতরফী কথা- বাংলা অশিক্ষিতের বুলি, ভদ্রজনোচিত নয়। তাই যেমন তেমনে কাজ চলে! হিন্দু কলেজের বাংলার শিক্ষক একসময় ছিলেন বাবু রামকমল সেন এর রাঁধুনি! রাজনারায়ণ বসুরা সেই শিক্ষকের কাছে বাংলা শেখার চেয়ে রান্নার কথাই আলোচনা করতেন বেশী। ১৮৪৪ সালে আবগারি বিভাগের কমিশনার দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছিলেন বাঙালি ছেলেরা মাতৃভাষা শিক্ষায় একদমই আগ্রহী নয়। তার অফিসে রাজেন্দ্রনাথ মিত্র নামে হিন্দু কলেজের একটি ছাত্র কর্মরত। কিন্তু সে স্বচ্ছন্দে বাংলা পড়তে পর্যন্ত পারেনা। প্রশ্ন উঠতেই পারে আশৈশব বিলেতে লালিত শ্রীঅরবিন্দের অ-স্বাচ্ছন্দের বাংলা ভাষাই কি তাঁকে জেল কুঠরীতে ধীরস্থির, নিশ্চুপ,বাক্যরহিত ঋষিকল্প হতে সাহায্য করেছিল! ইংরেজি শিক্ষিত অগ্রসর বাঙালির বাংলা সম্পর্কে মনোভাব কেমন ছিল প্রমথনাথ বিশী তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলায় এম. পাশ করলে জনৈক হিতৈষী বলেছিলেন, বাপু চাকরি পেতে হলে ভুলেও ওই বাংলায় এম. এ-র কথা বলবে না, ওই ইংরেজি অনার্সের কথাটাই লিখো, ওতে সুফল হতে পারে। বাংলায় এম. এ শুনে আরেকজন বলেছিলেন, আশু মুখুজ্জের কান্ড দেখো, অবশেষে বাংলায় এম. এ করে বসলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কি? এসব ঘটনা গত শতকের তিরিশের দশকের। এখনও কি কিছু অন্যরকম হয়েছে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২০ সালে বাংলায় এম. এ পরীক্ষা গৃহীত ও ডিগ্রি প্রদান শুরু হলেও ১৯৫৩ সালের আগে পর্যন্ত ‘বাংলা’ বিষয়ের প্রশ্ন ইংরেজিতেই হত! এমন কতই না আশ্চর্য কান্ডে ভরা আ মরি বাংলা ভাষা।
সহজ বাংলার জনপথে এখন ভাষা নির্যাতনের কলরব। কখনো তা ধর্মের মোড়কে আসে, কখনো বর্গ-ভেদে, উচ্চ-নীচে, কখনো বা খিচুড়ি ভাষার দাপটে। মোদের গরব মোদের আশা, বাংলা ভাষা ফাল্গুনেই থিতু হয়, ‘মাতাপিতামহাক্রমে’ ব্যবহারের কাজে আসেনা!