বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র যেদিন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসেন সেদিন তিনি দুখানি গান শুনিয়েছিলেন ঠাকুরকে। গান তো গাইলেন, তারপরই ঘটল অদ্ভুত কান্ড। গান শুনে ঠাকুর বিভোর হয়ে গেলেন। রামচন্দ্র দত্তকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ছেলেটি কে? আহা কি গান।’ তারপরেই হাত ধরে তাঁকে নিয়ে গেলেন উত্তরের বারান্দায়। শীতকাল। উত্তুরে হাওয়া যাতে না আসে তার জন্য ঝাঁপ দিয়ে বারান্দা ঘেরা। তাই বাইরের কাউকে দেখা যায় না। এবার ঠাকুর ঘরের দরজাটি দিলেন টেনে বন্ধ করে। তারপর বিশ্বনাথ দত্তের পুত্রের হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “এতদিন পরে আসতে হয়? বিষয়ী লোকের কথা শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে গেল, প্রাণের কথা কাউকে বলতে পাইনে। জানি তুমি নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি দূর করার জন্য আবার শরীর ধারণ করেছ।” যাঁকে এসব বলা হচ্ছে সেই ছেলেটির তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। তাঁর মনের ভাব তখন — এ আমি কাকে দেখতে এলাম? এ তো পুরো উন্মাদ! নইলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্রকে কেউ এমন কথা বলে!
এই প্রথম সাক্ষাতেই ঠাকুর তাঁর ছাত্রকে আলাদা করে নিয়ে অধিক যত্ন অধিক আদর দিয়ে আপন করে নিতে চেয়েছেন। আলাদা করে সন্দেশ মুখে জোর করে গুঁজে দিয়েছেন। কারণ একটাই, গুরু মেলে অনেক কিন্তু ঠিকঠাক শিষ্য বা ছাত্র মেলে না। তাই সেরকম ছাত্র পেলে গুরু বা শিক্ষক তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিতে চান।
দ্বিতীয় বার যখন আবার দেখা হল তখন ঠাকুর দিলেন ডান পা ছেলেটির গায়ে তুলে। সাহসী ছেলেটির সামনে ঘরের জিনিস পত্র সব প্রবল বেগে ঘুরতে লাগল। সব যেন ঘুরতে ঘুরতে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ছেলেটির ভয় হল। ‘আমি’ র বিনাশ মানে তো মৃত্যু! ছেলেটি বালকের মত চিৎকার করে বললে “ওগো, তুমি আমার এ কি করলে? আমার যে বাপ – মা আছেন!” এবার তাঁর কথা শুনে ঠাকুর হেসে উঠলেন। বুকে হাত দিয়ে টুক টুক করে চাপড়ে দিয়ে বললেন, “তবে এখন থাক। কালে হবে।” ছেলেটি সুস্থ হয়ে ভাবতে লাগল এটা কি হল? মেসমেরিজিম না হিপনটিজিম? যাঁকে ছেলেটি আগের বার বদ্ধ উন্মাদ ভেবেছিলেন সেই উন্মাদের কি অসীম ক্ষমতা!
শুরু হল এক অদ্ভুত অধ্যায়। পাগল শিক্ষক আর জ্ঞানী ছাত্রের অদ্ভুত রসায়ন যা অন্য কোথাও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। শিক্ষক যা শেখাতে চাইছেন ছাত্র সঙ্গে সঙ্গে সেটা তর্ক করে ছিঁড়েখুড়ে দিচ্ছে। এমনকি তাঁর প্রতি গুরুর যে স্নেহ তাকেও আক্রমণ করতে ছাড়েন নি। পুরাণের হরিণ শিশুকে ভালবেসে ভরতের কি হয়েছিল সেকথা মনে করিয়ে সাবধান করেছেন। ঠাকুর অর্থাৎ শিক্ষক প্রথমে তাতে ভয় পেয়ে ছুটেছেন আরও বড় শিক্ষিকার কাছে। মা কালীর কাছে। কিছুক্ষণ পরেই হাসতে হাসতে এসে বলেছেন, “যা শালা, আমি তোর কথা শুনব না। মা বললেন — তুই ওকে সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে জানিস, তাই ভালবাসিস। যেদিন ওর ভিতরে নারায়ণকে দেখতে পাবি না, সেদিন ওর মুখও দেখতে পারবি না।”
শিক্ষক যা যা বলেন, অবাধ্য ছাত্র প্রথম প্রথম কিছুই মানতেন না। শিক্ষক বললেন, “তবে আসিস কেন?” ছাত্র উত্তর দিলেন, “তোমায় দেখতে আসি, কথা শুনতে নয়।” একথা শুনে শিক্ষকের রাগ করার কথা, কিন্তু তিনি রাগের বদলে খুশি হলেন।
ছাত্র যখন নিজের ইচ্ছাতে ব্রাহ্মসমাজের মেম্বার হলেন, শিক্ষক জানতেন। সেই যুগে ‘সমাজে’ মেয়েমানুষেরা যান, তর্কে অংশগ্রহণ করেন। মেয়েদের সামনে রাখলে একাগ্র হওয়া যায় না। ধ্যান ভঙ্গ হয়। কে না জানে যে ইন্দ্র স্বর্গরাজ্য হারানোর ভয়ে পুরাকালে মুনিঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরাদের পাঠাতেন। কিন্তু তবু শিষ্যকে বাধা দিলেন না গুরু। একদিন শুধু বললেন, “রাখালকে ওসব কথা কিছু বলিস নি – যে তুই সমাজের মেম্বার হয়েছিস। ওরও, তা হলে, হ’তে ইচ্ছা যাবে।” অথচ রাখাল এবং এই ছাত্র বা শিষ্য যাই বলা হোক, একই বয়সী। পড়াশোনাও একই সঙ্গে চলছে। তবু ধারণ ক্ষমতা কার কতটুকু সেটা শুধু শিক্ষকরাই বুঝতে পারেন। তবে যেমন তেমন শিক্ষকের কম্মো যে নয় তা পরে প্রকাশ্য। শিষ্য নিজের প্রতি এরূপ পক্ষপাত স্পষ্ট বুঝতে পারতেন। এজন্য প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু গেঁয়ো শিক্ষক তাঁর পরিকল্পনাতে অটল থাকতেন।
ততদিনে গুরুর প্রতি খানিক আস্থা বেড়েছে শিষ্যের। শিক্ষকের এ যাবৎ কোনও ছবি নেই। ঠাকুর ছবি তোলাতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু উদ্যোক্তা যেহেতু একরোখা শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত, সেহেতু ছবি তোলা হল। গুরুকে ভগবৎপ্রসঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে দেখা গেল গুরু সমাধিমগ্ন, ঠিক তখনই নরেন্দ্রনাথ ছবিটি তুলতে বলেন। ছবিটি তুলেছিলেন সেকালের সবথেকে নামকরা প্রতিষ্ঠান বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের অ্যাপ্রেনটিস অবিনাশ চন্দ্র দাঁ। আর বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র সেদিন না উদ্যোগ নিলে আজ ঘরে ঘরে যে শিক্ষক যে গুরুর ছবি শোভা পায় তা আমাদের অধরা থাকত।
কিছুকাল শিক্ষা গ্রহণের পর একরাত্রে শিষ্য বসে আছেন পঞ্চবটীতলে, হঠাৎ গুরু এসে শিষ্যের হাত ধরে হাসতে হাসতে বললেন, “আজ তোর বিদ্যা বুদ্ধি বুঝা যাবে, তুই তো মোটে আড়াইটা পাশ করেছি, আজ সাড়ে তিনটে পাশ করা মাস্টার এসেছে, চল, তার সঙ্গে কথা কইবি।” অর্থাৎ একের সঙ্গে অপরের জ্ঞানের আদান প্রদান এবং ভবিষ্যতের বক্তা, যিনি সারা জগৎ নাড়িয়ে দেবেন তাঁকে তৈরি করে যাবার ছোট ছোট পদক্ষেপ এক গেঁয়ো শিক্ষকের। তর্ক শেষে বিচারক হিসেবে শিক্ষক বললেন, “পাশ দিলে কি হবে, মাস্টারটার মাদীভাব, কথা কইতেই পারে না।” অর্থাৎ ভবিষ্যতের বক্তার ভিতরে confidence ভরে দেওয়া।
শুধু শিক্ষা নয়, যাতে শিক্ষার পথে কোনও বাধা না আসে তার জন্যও শিক্ষকের সজাগ দৃষ্টি ছিল। শিষ্য কোথায় যান, কি করেন, কাদের সঙ্গে মেশেন সমস্ত খোঁজ রাখতেন। এমনকি সাধন শিক্ষার যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য, যখন শিষ্যের বিবাহের প্রায় ঠিকঠাক, তখন জগন্মাতার কাছে আর্জি জানিয়েছেন যাতে শিষ্য সংসারে আবদ্ধ হয়ে না পড়েন। আবার বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুতে যখন পরিবারটি অন্নকষ্ট ভোগ করছে, তখন সকলের কাছে নরেন্দ্রনাথের পরিবারের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। একথা কানে আসতে শিষ্য যখন গুরুকে বকতে লাগলেন, তখন ঠাকুর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ওরে তোর জন্য যে আমি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে পারি!” এমনি ভালবাসার পাকে পাকে গুরু বেঁধেছিলেন শিষ্যকে। অনেকে অনেক রকম কথা শিষ্যের নামে গুরুকে বলে গুরুর মন বিষিয়ে দিতে চেয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই শিষ্যের সম্পর্কে একটি খারাপ কথাও তিনি বিশ্বাস করেন নি। বরং যারা নিন্দে রটাচ্ছে তাদের দূর করে দিয়েছেন।
অথচ কোনও কিছুই কিন্তু ‘মোয়া’র মত ছাত্রের হাতে তুলে দেননি গুরুমশাই। প্রত্যেকটি ধাপ কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে শিষ্যকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে যখন গুরু সত্যিই বুঝেছেন যে শিষ্য ভুল করেছেন, তখন বকাবকি না করে কথা বন্ধ করেছেন, শিষ্যের হাতে খেতে পারেন নি। শিষ্য এতেই শুধরে নিয়ে সাধন পথে অগ্রসর হতে পেরেছেন। যে কারণে শিষ্য পরবর্তী কালে গুরু সম্পর্কে বলেছেন — শঙ্করাচার্যের ছিল বিরাট মস্তিষ্ক আর রামানুজের ছিল বিশাল হৃদয়। এবার এমন এক পুরুষের আবির্ভাবের সময় হয়েছে, যাঁর মধ্যে হৃদয় ও মস্তিষ্কের সমন্বয়, যিনি একাধারে শঙ্করের উজ্জ্বল মেধা ও শ্রীচৈতন্যের বিশাল অনন্ত হৃদয়ের অধিকারী হবেন যিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একই মহৎভাব দেখতে পাবেন। যিনি দেখবেন প্রত্যেক প্রাণীতে ঈশ্বর বিদ্যমান, যাঁর হৃদয় ভারতের এবং ভারতের বাইরের প্রতিটি দরিদ্র দুর্বল পতিতের জন্য কাঁদে, অথচ যার বিশাল মেধা এমন তত্ত্ব উদ্ভাবন করবে, যা ভারতে বা ভারতের বাইরে বিরোধী সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। এইরকম বিস্ময়কর সমন্বয়ের মাধ্যমে হৃদয় ও মস্তিষ্কের সামঞ্জস্যপূর্ণ এক সার্বভৌম ধর্ম প্রকাশিত হবে। এইরকম একজন মানুষ সত্যিই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আমি কয়েক বছর তাঁর চরণতলে বসে শিক্ষা পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম।
এবার চলে যাবেন শিক্ষক। আর সময় নেই। দেহ যাবার তিন-চারদিন আগে প্রিয় শিষ্যকে ডাকলেন ঠাকুর। একেবারে একাকী। তারপর শিষ্যকে সামনে বসিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন এবং সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। শিষ্য নরেন্দ্রনাথ তখন অনুভব করলেন, গুরুর শরীর থেকে একটা সূক্ষ্ম তেজ ‘ইলেকট্রিক শক’-এর মত এসে তাঁর শরীরে ঢুকছে। ক্রমে তিনি বাহ্যচেতনা হারিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। যখন চেতনা এল দেখলেন সেই গেঁয়ো, উন্মাদ শিক্ষক কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সস্নেহে গুরুর উত্তর এল, “আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম। তুই এই শক্তিতে জগতের অনেক কাজ করে তবে ফিরে যাবি।” ঐ শক্তিই শিষ্যকে গোটা বিশ্ব চরকিপাক খাইয়েছে। এক দন্ড বসতে দেয়নি। পরবর্তী কালে নরেন্দ্রনাথ যখন স্বামী বিবেকানন্দ হলেন, তখন বলেছেন, “ওই যে ঠাকুর ‘কালী’ ‘কালী’ ব’লে ডাকতেন, ঠাকুরের দেহ রাখার দু-তিনদিন আগে সেইটে এই শরীরে ঢুকে গেছে। সেইটেই আমাকে এদিক ওদিক কাজ করিয়ে নিয়ে বেড়ায়, স্থির হয়ে থাকতে দেয় না, নিজের সুখ দেখতে দেয় না।”
ঠাকুর যাঁকে বলতেন, “নরেন, তুই একটা বীর, তোকে দেখলেই আমি বুকে বল পাই।” — সেই বীর বিবেকানন্দের আজ জন্মদিন। যিনি এই জগতের সম্বন্ধে বলেছেন, “আমি মনে করি, জগৎটা একটা সার্কাস, আর আমরা এক একটা ভাঁড় হয়ে সেখানে ডিগবাজি খাচ্ছি। কারণ, আমরা ডিগবাজি খেতে ভালবাসি। তারপর যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন আমরা এই জগৎ থেকে বিদায় নিই।”
তবু আমরা সেই ডিগবাজিই খেতে থাকি, খেতেই থাকি। তাঁর কথা আত্মস্থ করে ওঠা হয় কি?
“ঈশ্বরের সঙ্গে আমি বিবাদ করিনি।
তবুও ঈশ্বর
হঠাৎ আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলেন?
অন্ধকার ঘর।
আমি সেই ঘরের জানলায়
মুখ রেখে
দেখতে পাই, সমস্ত আকাশে লাল আভা,
নিঃসঙ্গ পথিক দূর দিগন্তের দিকে চলেছেন।
অস্ফুট গলায় বলে উঠি :
ঈশ্বর! ঈশ্বর!”
Excellent presentation with rich content.
মুগ্ধ করলো উপস্থাপনার গুণে।
সব জানা তথ্য দিয়ে এতো সুন্দর বিশ্লেষণ মুগ্ধ করলো।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
Khub sundar pratibedan.sabalil vasa kata kichu jana gelo .Satti to aj Ramkrishna mission sara prithibi bypi je karma jagya korche ta Thakurer asirbad r Swamijir udyog chara samvab chilo na.