‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমিই আমার জীবন, আমার সুখ — আমার কাছে সবকিছু! আমাকে ক্ষমা করে দাও, কষ্ট করেও চুপ থাকার শক্তি আমার নেই। আমি বিনিময়ে ভালোবাসা চাই না, সহানুভূতি চাই। সন্ধ্যে আটটার দিকে আমার নাম স্বাক্ষর করা এ লেখা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, তবে আমার বেনামী চিঠিতে অস্বস্তি বোধ করো না। আমি যুবতী ও দেখতে সুন্দরী। তুমি আর কী চাও?’
পাভেল ইভানিচ ভিহোদতসেভ একজন বিবাহিত পুরুষ। সে সামার ভিলায় ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এই চিঠিটি পড়ে সে তার কাঁধ ঝাঁকাল ও বিভ্রান্তিতে পড়ল।
‘এটা কি শয়তানী?’ সে ভাবল. ‘আমি একজন বিবাহিত মানুষ, আমাকে এমন একটি অদ্ভুত চিঠি পাঠাতে পারে কোন মূর্খ! কে লিখেছে?’
পাভেল ইভানিচ তার চোখের সামনে চিঠিটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বারবার পড়ল। সে ঘৃণা ভরে থুথু ছিটাল।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি —’ সে ঠাট্টা করে মনে মনে বলল,’ তাই আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে যাচ্ছি!… আমি কয়েক বছর আগে এই ধরনের সব রোমান্সকর চিঠি পেয়েছিলাম! মেয়েটি অবশ্যই কিছুটা বেপরোয়া নীতিহীন মহিলা হবে। এ ধরনের মহিলারা এই রকমই হয়! হায় ঈশ্বর! তাকে অপরিচিত একজন বিবাহিত পুরুষকে এমন একটি চিঠি লিখতে হবে কেন! এটা সত্যিকারের মনোবিকার!’ পাভেল ভাবল।
তার আট বছরের বিবাহিত জীবনে পাভেল ইভানিচ সমস্ত আবেগপূর্ণ অনুভূতিকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছিলেন। অভিনন্দনের চিঠি ছাড়া সে মহিলাদের কাছ থেকে কোনও চিঠি পায় না, তাই সে এই চিঠিটাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে তার সোফায় শুয়ে ভাবতে লাগল,’অবশ্যই আমি একজন বোকা ছেলে নই, তাই আমি বোকামিপূর্ণ মিলনমেলায় তাড়াহুড়ো করতে যাচ্ছি না; তবে এটি কে লিখেছে তা জানা আবশ্যিক।হুম… … এটি অবশ্যই একজন মহিলার লেখা। … চিঠিটি সত্যিকারের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে লেখা! তাই এটা কমই রসিকতাপূর্ণ হতে পারে… … সম্ভবত এটি কোনও আবেগপ্রবণ মেয়ে, কিংবা একজন বিধবার লেখাও হতে পারে।’
চিঠিটির কথাগুলো তাকে ভাবনায় ফেলল। সে ভাবল, পাভেল ইভানিচের স্ত্রী ছাড়া সামার ভিলার একটি মেয়ের সঙ্গেও তার পরিচয় নেই।
‘এটা একটি অদ্ভুত চিঠি!’ পাভেল ভাবল, ‘তার চিঠিতে জাদু আছে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!—. সে কখনো কি কারো প্রেমে পেরেছে? আশ্চর্যজনক মহিলা! এভাবে প্রেমে পড়ার জন্য এমন প্রস্তাব! কোন পরিচয় না জানিয়ে আমি কেমন মানুষ না জেনে এমন প্রপোজ…! সে অবশ্যই খুব অল্পবয়সী ও রোমান্টিক হবে হয়তো। যদি সে আমার দিকে দুই বা তিনবার তাকানোর পরে প্রেমে পড়তে সক্ষম হত … …! কিন্তু … সে কে?’
পাভেল ইভানিচের হঠাৎ মনে পড়ল,’ গতকাল সে গ্রীষ্মকালীন ভিলাগুলোর মধ্যে হাঁটাহাঁটি করেছিল। তার আগের দিন মানে পরশু হালকা নীল টুপি পরা একজন ফর্সা যুবতী মহিলার সঙ্গে সেখানে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল । সুন্দরী যুবতীটি তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে এক সময় তার পাশের আসনে বসেছিল।’
‘সে কি হতে পারে? না সে হতে পারে না! সে আমার মতো একজনের প্রেমে পড়তে পারে? না, তা অসম্ভব’!’
রাতের খাবারের সময় পাভেল ইভানিচ তার স্ত্রীর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিল।
‘মেয়েটি লিখেছে যে সে তরুণী ও দেখতে সুন্দরী।’
পাভেল ভাবল, ‘আমি বৃদ্ধ নই। সত্যি বলতে, আমি তেমন কুৎসিতও নই যে কেউ আমার প্রেমে পড়তে পারে না আমার বউ আমাকে ভালোবাসে! তাছাড়া ভালোবাসা অন্ধ, আমরা সবাই জানি।’
‘তুমি কি ভাবছ?’ তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করল।
‘ওহ… আমার মাথাটা একটু ব্যথা করছে…’পাভেল ইভানিচ মিথ্যা করে বলল।
সে ভাবল, প্রেমপত্রের মতো অযৌক্তিক বিষয়ের প্রতি ভাবা বোকামি!রাতের খাবারের পরে পাভেল ইভানিচ তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর পরিবর্তে ভাবতে লাগল —
‘আমি বুঝতে পারছি তরুণীটি আমার আসার অপেক্ষা আছে! কী বোকামি! ‘পাভেল মনে মনে আরো ভাবল, ‘আমার অপেক্ষায় মেয়েটি কতটা নার্ভাস ফিল করবে। যখন সে আমাকে খুঁজে পাবে না তখন তার সফর বানচাল হয়ে যাবে।’
পাভেলে মন বলল, ‘তোমার যাওয়া উচিত।’
আধঘণ্টা পরে সে ভাবল,’আমি গিয়ে দূর থেকে দেখতে পারি যে সে কেমন মেয়ে… … তার দিকে তাকানো আকর্ষণীয় হবে! তার সঙ্গে মজা করা যাবে। এমন সুযোগ পেলে কি একটু মজা করা যাবে না?’
পাভেল ইভানিচ তার বিছানা থেকে উঠে পোশাক পরতে শুরু করল। ‘তুমি কিসের জন্য এখন এত কেতাদুরস্ত পোশাক পরছো?’ তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, যখন সে একটি পরিষ্কার শার্ট ও একটি ফ্যাশনেবল টাই পরছিল।
‘ওহ, কিছুই না… আমার একটু হাঁটতে হবে… আমার মাথা ব্যথা করছে।’
পাভেল ইভানিচ তার সেরা পোশাকটি পরে, আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে অনিচ্ছাকৃতভাবে অগ্রসর হতে হতে ভাবল, ‘আমি কিসের ভয় পাচ্ছি? কেন, আমি মিলনমেলায় যেতে ইতস্তত করছি! ‘তার মন বললো, ‘কী… বোকা! সাহস করে এগিয়ে যাও!’
পাভেল ইভানিচের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল।
একটু নীল রঙের টুপি পরা একটি সুন্দরী মেয়ে তার মনের কোণে ভেসে উঠল।
‘আমি বিয়ে না করলে সব ঠিক হতো।’ পাভেল চিন্তা করল। “যদিও … আমার জীবনে একবারের জন্য, অভিজ্ঞতা থাকলে কোন ক্ষতি হবে না, নইলে কেউ না জেনে মারা যাবে… এবং আমার স্ত্রী, তাতে তার কী হবে? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আট বছর ধরে আমি কখনই স্থীর কাছ থেকে এক পাও সরে আসিনি… … আট বছরের ভাল ভাবেই দায়িত্ব পালন করেছি! তা তার জন্য যথেষ্ট… … এটা ইতিবাচক ভাবে বিরক্তিকর… …এখন আমি তাকে ক্ষুব্ধ করতে প্রস্তুত!’
কাঁপতে কাঁপতে পাভেল ইভানিচ আর্বরের পার্কে কাছে পৌছাল। আইভি ও বুনো লতা পুষ্প তার দিকে যেন উঁকি দিল। … স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ তার নাকে লাগল।
‘আমার বিশ্বাস ওখানে কেউ নেই…’ সে ভাবল। সে কিন্তু পরক্ষনেই একজন মানুষকে দেখতে পেল। ভাল ভাবে তাকিয়ে পাভেল ইভানিচ তার স্ত্রীর ভাই মিত্যাকে চিনতে পারল। সে একজন ছাত্র, এক সময় তাদের ভিলায় ছিল। এখন মাঝে আসে।
পাভেল তাকে দেখে বলল, ‘ওহ তুমি.!’
পাভেল তাকে ওখানে দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে সে তার টুপি খুলে পার্কের একটা বেঞ্চে বসল।
“হ্যাঁ, আমিই”।… উত্তর দিল মিত্যা।
নীরবে কেটে গেল দুই মিনিট।
শেষে মিত্যা বলল,” ক্ষমা করবেন, পাভেল ভাই, সে সাফাই গাইবার সুরে বলল, “আমি কি আপনাকে একা রেখে যেতে বলতে পারি? … … আমি আমার ডিগ্রির জন্য গবেষণামূলক গবেষণার বিষয়ে চিন্তা করছি। অন্য কারো উপস্থিতি আমার চিন্তাভাবনাকে বাধা দেয়।”
অন্যদিকে পাভেল ভাবল, “এখানে মিত্যার উপস্থিতি বিরক্তিকর।
আবার একটা নীরবতা। পাভেল ইভানিচ ক্রমাগত পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল তাই সে, হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠে প্রতিবাদী স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, মিত্যা! তোমার বয়স কম,আমার কথা তোমাকে ভাবা উচিত….. আমি অসুস্থ এবং …. আমার ঘুমের দরকার … … তুমি চলে যাও!”
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন আমি জানি না? আমি আপনার কথায় এখান থেকে যাব না।”‘মিত্যা বলল।
পাভেল ও মিত্যা দুইজনে তর্কবির্তকে জড়িয়ে পড়ল। পরিশেষে, মিতা বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনার কথা শুনে আমি আনন্দিত!’
সে ওখান থেকে, উঠে নিজের টুপিটাও পরে নিল।
পাভেল তা দেখে বলল, ‘এই মুহূর্তে এখানে এসে তুমি আমাকে এমন নোংরা কৌশল খেলেছ তাতে আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তোমাকে ক্ষমা করব না।’
পাভেল ইভানিচ আর্বার পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল। রাগের সঙ্গে সে তার নিজের ভিলায় চলে গেল।
নৈশভোজে পাভেল ইভানিচ ও মিত্যা তাদের প্লেটের দিকে চোখ রাখল। তাদের মধ্যে বিষণ্ণ নীরবতা বজায় রইল। তারা অন্তরের অন্তস্থল থেকে একে অপরকে ঘৃণা করতে লাগল।
“তুমি কী জন্য হাসছো?” পাভেল ইভানিচ তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল। তারপব সে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রাগতো স্বরে বলল, ‘শুধুমাত্র বোকারাই বিনাকারণে হাসে!’
তার স্ত্রী তার স্বামীর রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাবার আগে বলল,’আজ সকালের সেই চিঠিটিতে কী ছিল?’
‘আমি?… আমি তাকে পেলাম না…’ পাভেল ইভানিচ দুঃক্ষিত স্বরে বলল।
‘ওহ, আমিই তোমাকে চিঠিটি পাঠিয়েছিলাম!’ পাভেলের স্ত্রী জোরে জোরে হেসে উঠে বলল।
পাভেল ইভানিচের মুখটা যেন লাল হয়ে তার প্লেটের উপর বাঁকা৷ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হল। ‘মূর্খ রসিকতা,’ পাভেল গর্জে উঠল।
‘কিন্তু আমি কি করতে পারতাম? বলো তো… আজ সন্ধ্যায় আমাদের ঘরগুলো ঝাড়াপোছা জন্য তোমাকে বাড়ি থেকে বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে আমি এটা করেছি।এছাড়া আমরা কিভাবে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করতে পারতাম? তোমাকে বের করার আর কোনো উপায় ছিল না… কিন্তু প্রিয়তম রাগ করো না, বোকা… আমি চাইনি তুমি ওখানে গিয়ে ক্লান্ত হও।মিত্যাকেও একই চিঠি পাঠিয়েছিলাম ! মিত্যা, তুমি কি আর্বার পার্কে গিয়েছিলে?”
মিত্যা হেসে ফেলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি ঘৃণা দেখিয়ে চলে গেল।
লেখক পরিচিতি : আন্তন চেকভ (১৮৬০-১৯০৪) রুশ কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার, নাট্যকার হিসেবে শেক্সপিয়ার, ইবসেনের পর অবধারিতভাবে তাঁর নামটি আসে, রেমন্ড কারভারের মতে বিশ্বের সমস্ত গল্পকারদের মধ্যে ইনিই শ্রেষ্ঠ। তিনি জীবনের বেশিরভাগ আয় করেছেন লেখালেখিতে, বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে। অর্থলোলুপতা অপেক্ষা তাঁর ছিলো শিল্পসৌকর্যের দিকে টান। প্রভুত্বের ধারণাটিকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন। বিনয় ও নিরহংকার ছিলো মৃত্যু অবধি, মৃত্যুর পরপরই তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পান যা তিনি দেখে যেতে পারেননি, তবে জীবদ্দশায় তিনি পুশকিন পুরস্কার পান এবং তলস্টয়ের পর তিনিই ছিলেন সকল পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর লেখা In Summer Villa কে বঙ্গানুবাদ করা হল।
মনোজিৎকুমার দাস, কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ