১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান জুড়ে এক অদ্ভুত কেলেঙ্কারির ইতিহাস রচিত হয়। প্রণীত হয় ইনডেমনিটি বিল। ইনডেমনিটি হলো কোনো বিচারকার্যকে বাঁধা প্রদান সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন। কোনো অভিযান বা অভ্যুত্থানের ক্ষয়ক্ষতি আদালত বহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে বিল পাস করে তাকেই ইনডেমনিটি বিল বলে। এই শব্দের অর্থ শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা অর্থাৎ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। জিয়ার দ্বারা সংবিধানে কলঙ্ক লেপনের দিনটি কেন আমরা স্মরণ করছি? কারণ এটি প্রণয়ন করেছিলেন খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ আর বৈধতা দিয়েছিলেন আরেক খুনি জিয়া। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে এ আইন প্রণীত হয়।শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি।সেই নিষ্ঠুরতার যাঁতাকলে মানুষ পিষ্ঠ হতে থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের অক্টোবর অবধি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার বিচার ব্যবস্থা উন্নতি করলেও পুনরায় ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলা বিচারহীনতার দাপটে জনগণকে নিমজ্জিত হতে হয় গভীর সংকটে।সে সময় মিথ্যা মামলা দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর চেহারা আত্মপ্রকাশ করে আজকের বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার মধ্য দিয়ে।
২০০৭ সালে ‘‘কেন বন্দি মুজিব দুহিতা’’ কবিতায় কবি মহাদেব সাহা জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এভাবে-‘শেখ হাসিনা কেন কারাবন্দি এই কথা বলতে বলতে/দেখি মুক্তিযোদ্ধার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,/হাত থেকে পড়ে যায় অন্নথালা/দেখি দুঃখে তার বিরান হয়ে যায় শস্যক্ষেত্র, জলশূন্য হয়ে পড়ে দিঘি সরোবর/পিতৃমাতৃভ্রাতৃ হারা বাংলার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ/তার কে আছে আপন আর এই মাটি ও মানুষ ছাড়া?/এমন যে দুঃখী মানুষ যার দুটি চোখ সর্বক্ষণ অশ্রুর নদী/৭ই মার্চ আর ২১-এ ফেব্রুয়ারির এই স্বাধীন বাংলাদেশে/সেই চিরদুঃখী তোমার কন্যা আজ কারাবন্দি, হায় পিতা।’ প্রকৃতপক্ষে এদেশের মাটি ও মানুষ ছাড়া তাঁর আপন আর কে আছে?আর এজন্যই জনগণ সেদিন জেগে উঠেছিল।বন্দি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল।একইবছর শেখ হাসিনার বন্দিদশা নিয়ে ‘‘আশাহত হবার তো কথা নেই’’ কবিতায় আনোয়ারা সৈয়দ হক লিখেছিলেন-‘আশাহত হবার তো কথা নেই/মশালের লাল ঐ জ্বলছে/পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাকেই/এ কথাই সকলে বলছে।’ আসলে গ্রেফতার হওয়া শেখ হাসিনা সেদিন দুঃসহ জেল-যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে অমৃতের সন্ধান এনে দিয়েছিলেন জনগণকে। আর একারণেই ১৬ জুলাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হলেও শেখ হাসিনার জন্য দিনটি অবিনাশী সাহস আর প্রত্যয়ে অভিষিক্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য ভয়ঙ্কর একটি চ্যালেঞ্জের দিনও। কারণ সেদিন তাঁকে বিতর্কিত করে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল।যদিও সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় এদেশের প্রতিবাদী জনগণ।আর এজন্যই দিনটি স্মরণীয়।
আজ শেখ হাসিনাকে কারাগারে নিক্ষেপের সপ্তদশ বার্ষিকী। এই দিনটি এদেশের ইতিহাসে ‘গণতন্ত্র অবরুদ্ধ ও হত্যা প্রচেষ্টা দিবস’ হিসেবে বহুল পরিচিত। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের জন্য সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। চুপ করে ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। গ্রেফতারের আগে নেত্রীর নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়। বাসা থেকে তাঁকে পুলিশের একটি জিপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি নাজেহালের শিকার হন। সেদিন সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। সেই সকালে অনেক রাজনৈতিক কর্মী কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে ওই সব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
গ্রেফতারের পরই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, কবিরা কবিতায় সরব হন। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কান ও চোখের চিকিৎসা নেন। দেশে ফেরার পর আবার তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।কারাবরণের পর প্রায় ১ বছর বন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা।তবে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দেয়া মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করলেও, শেখ হাসিনা পরবর্তীতে সেই অভিযোগ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়, সৎ নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়- তাও প্রমাণিত হয়েছে।
আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি; অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম- কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তাঁর রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।
বঙ্গবন্ধুর ৩ হাজার ৫৩ দিন জেল জীবনে কারা-মুক্তি দিবস একাধিক হলেও আমরা ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে তাঁর জেল জীবনের সমাপ্তি টেনে দিবসটিকে মুক্ত স্বদেশের মুক্তির বারতায় তাঁর নিঃশ্বাস নেবার অন্যতম দিন হিসেবে চিহ্নিত করি। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের বন্দি জীবনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন তাঁর কারা-মুক্তি দিবস। বঙ্গবন্ধু ও ম্যান্ডেলা উভয়েই নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন বন্দি থেকেও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির চিন্তায় নিবেদিত ছিলেন। অনুরূপভাবে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না, দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে টিকে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনও সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকেই যা ২০২২ পর্যন্ত ২১ বার বলে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। এমনকি সাবজেলে থাকার সময় ‘স্লো পয়জনিংয়ে’ তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
গ্রেফতারের পর তাঁকে রাখা হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে। সেখানে তাঁর খাবারে ক্রমাগত পয়জন দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার টার্গেট করা হয়। স্লো পয়জনিংয়ের কারণে বন্দি শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সবই ছিল তাঁকে এদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র। এজন্য ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর তাঁর দেশে ফেরার উপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। উদ্দীপিত হয় দলীয় নেতাকর্মীরা। যৌথবাহিনী তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার পর গণমানুষ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল। সেসময় তাঁর সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেফতারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে বদলে দিয়েছিল। কারণ তখন আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। উপরন্তু গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে যান। ওই চিঠিটি নেতা-কর্মীদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তিনি দেশবাসীর প্রতি তাঁর আস্থার কথা জানিয়েছিলেন তেমনি গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হওয়ায় দুঃসময়ে নেতা-কর্মীরা কি করবেন তার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। চিঠিটি হুবহু এরকম —
‘প্রিয় দেশবাসী,
আমার ছালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের উপর আমার ভরসা। আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।শেখ হাসিনা, ১৬.০৭.২০০৭’
অনুপ্রেরণামূলক এই চিঠিতে শেখ হাসিনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে তাঁর নেতৃত্বের একনিষ্ঠতা তখন সত্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। অথচ ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকালে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হলেও কখনো চাঁদাবাজির মামলা করা হয়নি। এজন্য আমাদের মনে হয়েছে, মামলাবাজ জোট সরকার থেকেও বড় আবিষ্কারক ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য শেখ হাসিনা আন্দোলন করেছিলেন। আটষট্টি জন মানুষ জীবন দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর হাতে। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। চারদলীয় জোটের ভোট কারচুপির নীলনকশা প্রতিহত করার জন্যই আন্দোলন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করাও তাঁর মূল টার্গেট ছিল। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায় — ‘আন্দোলন করে দাবি পূরণ করলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করলাম। যেই দ্রুত নির্বাচনের কথা বললাম, সেই আমি চাঁদাবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম। আমার স্থান হল কারাগারে। পাঁচটি বছর চারদলীয় জোট তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমার ও আমার পরিবারের দুর্নীতির কোন কিছু পায় কিনা, পায় নাই। পেয়েছে ফখরুদ্দীন সরকার।’
চাঁদাবাজির মামলাগুলো কীভাবে করা হয়েছিল তাও তিনি জানতেন। গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার চেষ্টাকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল যারা, তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করে মানুষকে সামরিক শাসন উপহার দিতে চেয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রথমে সশস্ত্রবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয়। নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করে দুই বছর পর নির্বাচন হবে। সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অথচ তখন নতুন নতুন দল গঠন করা হচ্ছিল। মাইনাস টু অনুসারে, যা ছিল আসলে ‘মাইনাস শেখ হাসিনা’- তৃতীয় শক্তির উত্থান প্রত্যাশা করেছিল শাসকগোষ্ঠী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সুদখোর, কালোটাকার মালিকরা টাকা সাদা করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছিল। অন্যদিকে ‘দুদক’কে দিয়ে রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সরকার, একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হচ্ছিল।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নয়টি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছয়টি মোট ১৫টি মামলা করা হয়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এবং তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে ‘দুদক’কে ব্যবহার করে। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করে ‘দুদক’। ২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার দায় থেকে অব্যাহতির জন্য শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে হাইকোর্টে বাতিল আবেদন করলে ৭ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর শুনানি শেষে আদালত মামলাটি বাতিল ঘোষণা করেন। এভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার পরিসমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উদঘাটিত হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলাগুলো করা হয়েছিল। এজন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিধিমালার অসংগতি দূর করতে তা সংশোধনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক নাটকীয় ঘটনার জন্ম হয়েছে। সেসময় ‘দুদকে’র দৌড়ঝাপ, ‘মাইনাস টু’র কুশিলবদের উচ্চস্বর ও দাম্ভিকতা, বিচারকদের অসহায়ত্ব আর শেখ হাসিনার জন্য জনগণের বেদনাবোধ অন্যান্য দেশের মানুষকে আলোড়িত করেছিল। শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে যে জোরাল দাবি উঠেছিল তা ছিল অভূতপূর্ব।
এজন্য ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাঁর কারাবরণ- গণতন্ত্র অবরুদ্ধ এবং তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টা দিবস হিসেবে খ্যাত।২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্ত হওয়ার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কারা-মুক্ত হয়ে তিনি জনগণের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন। জনগণের জন্য একটা সুন্দর ও নিরাপদ জীবন উপহার দেবেন- এটা তাঁর এখনকারও অঙ্গীকার। কারণ কারাগারে থাকার সময় এই জনগণই তাঁর জন্য রাজপথে লড়াই করেছিল।‘‘কোটি কণ্ঠে এক আওয়াজ’’ কবিতায় ২০০৭ সালে বেলাল চৌধুরী লিখেছিলেন-‘শেখ হাসিনাই গণতন্ত্রের শেষ ভরসা,/তাই তো কোটি কণ্ঠে আওয়াজ ‘মুক্ত করে আনতে হবে তাকে সহসা’।/এত কিছুর পরও জানি আমরা/শেষ হাসিটি হাসবেন শেখ হাসিনাই।’ প্রকৃতপক্ষে ১৬ জুলাই গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হলেও শেষ হাসিটি শেখ হাসিনাই হেসেছিলেন সেদিনের পর।কুচক্রী মহলের হত্যার ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি।বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে বিজয়ের মধ্য দিয়ে।২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মানুষের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার ও উন্নয়নের মহাযজ্ঞে শেখ হাসিনা সরকারের অবদান এদেশের ইতিহাসে যুক্ত করেছে ‘‘শেখ হাসিনা যুগ’’।জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনার জয়।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com