বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবল হিন্দুত্ববাদী ঔদ্ধত্যে রীতিমত অত্যাচারিত হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আবার সেইরকম একট ঘটনার সাক্ষী হল আমেদাবাদ। ওই রাজ্যে রবিবার সকালে ওধব এলাকার একটি বেসরকারি হলে ইস্টার ধর্মসভায় ‘ধর্মান্তর’ চলছে এই অভিযোগ তুলে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে হামলা চালাল বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ওধব থানার পুলিশ জানায়, প্রায় ১০০ জন খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ ইস্টার পালন করার সময় বজরং দল এবং ভিএইচপির সদস্যরা সেখানে হামলা চালিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধের চেষ্টা করেন। তারা দাবি করে, ওই ধর্মসভায় ‘ধর্মান্তর’ করানো হচ্ছিল এবং তাঁরা উপস্থিতদের কতজন হিন্দু জানতে চায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। যদিও পুলিশ জানিয়েছে, ধর্মান্তরের প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার পর রাজনৈতিক এবং সামাজিক মহল স্বভাবতই ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অনেকে বলছেন বিষয়টি নতুন কিছু নয়, এর আগেও বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অন্য ধর্মের উপর জুলুম চালিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে গুয়াহাটিতে বজরং দল হুমকি দেয়, বড়দিনে হিন্দুরা আনন্দ করলে বা গির্জায় গেলে মার খেতে হবে। গুয়াহাটি বিশ্ব হিন্দু পর্ষদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বজরং দল, তারা সেই বছর অসমে হিন্দুদের বড়দিন পালনে হুমকি দিয়েছিল। এরপর হুগলির উত্তরপাড়ায় ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে পোস্টারে হুসিয়ারি দিয়েছিল, সরস্বতী পুজোয় জুটি বেঁধে ঘুরতে দেখলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পোস্টারের তলায় লেখা ছিল বজরঙ দলের নাম। পোস্টারে আরও উল্লেখ ছিল, সরকারে আসার পর এই ধরনের বিচ্যুতি রুখতে কড়া আইনও আনা হবে। প্রায় সকলেরই মনে থাকার কথা, গুজরাটে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের পদাতিক সৈন্যরা গুজরাটের ডাঙসেতে ছটি গির্জা ও দুটি মিশন স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছিল। কেবল তাই নয় সেইসময় দক্ষিণ গুজরাটে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দল খ্রিস্টানদের উপর প্রায় ৪০টি হামলা চালিয়েছিল, যার মধ্যে ডাঙেসের হামলা ছিল অন্যতম।
হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া বাহিনীর অন্য ধর্মের উপর সবথেকে বর্বরোচিত এবং নৃশংসতম আক্রমন হল ১৯৯৯ সালে ওডিশায় অস্ট্রেলীয় মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন এবং তাঁর দুই নাবালক পুত্রকে গাড়ির মধ্যে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা। ওই ঘটনার অন্যতম অপরাধী মহেন্দ্র হেমব্রম এবং গেরুয়া পান্ডা দারা সিংয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সম্প্রতি ওড়িশায় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় এলে খুনিদের পুরস্কৃত করতে মুক্তি দেয় মহেন্দ্র হেমব্রম ও দারা সিংকে। মুক্তি পর ধর্মান্ধ গেরুয়াবাহিনী তাদের মালা পরিয়ে বিজয় মিছিল করে ও ঘটা করে সংবর্ধনা দেয়। বিলকিস বানুর পরিবারের ১১ জনের খুনিদেরও একইভাবে মুক্তি দেয় গুজরাটের হিন্দুত্ববাদী সরকার। এটাই হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেবি’র আসল পরিচয়। হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার রাজনৈতিক স্বার্থে তারা যেকোনও অপরাধকে বৈধতা দেয় এবং অপরাধীকে সম্মানিত করে।
কিন্তু কেন মুসলমান ও দলিতদের পাশাপাশি খ্রিষ্টানদের ওপর হিন্দুত্ববাদিদের আক্রমণ বাড়ছে? যদিও জনসংখ্যার নিরিখে খ্রিষ্টানরা ৩ ভাগেরও কম আর মুসলমানেরা ১৪ ভাগ। দুই জনগোষ্ঠী মিলে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ৬ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। কিন্তু শাসক বিজেপি ও তার শাকরেদ আরএসএস প্রচার চালায়, দেশ মুসলমান আর খ্রিষ্টানরা দখল করে নিচ্ছে। তাই মুসলমানদের পাশাপাশি এদেশে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের শিকার খ্রিষ্টানরাও। দেশে খ্রিষ্টান পরিচালিত স্কুল ও গির্জায় ভাঙচুর তো আছেই, খ্রিষ্টানদের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে নান রাজ্যে আসছে ধর্মান্তরকরণবিরোধী আইন। বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অভিযোগ, মিশনারিগুলো জোর করে গরিব মানুষদের খ্রিষ্টান বানাচ্ছে। তাদের উন্নয়নমূলক কাজের উপর নামছে নানা ধরনের বাধা। যেসব এনজিও খ্রিষ্টানদের মধ্যে উন্নয়নের কাজ করে, তাদের বিদেশি অর্থসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অনেক সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু আরএসএস থেকে শুরু করে প্রায় সব হিন্দুসংগঠনগুলি চলে বিদেশ থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে। দলিত-সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ধর্মান্তরিত হন সেকথা ঠিক হিন্দুত্ববাদীরা তাদের প্রচারে এমন একটা ঘটনা হাজির করতে চাইছেন যেন দেশে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ধর্মান্তরিত হচ্ছে।
একটি সামান্যসংখ্যক ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাকে দেশজুড়ে রাজনীতির বড় একটি বিষয় করে তুলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রাজ্যে রাজ্যে ধর্মান্তরকরণবিরোধী বিল পাসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। স্বেচ্ছায় কেউ ধর্মান্তরিত হলেই অভিযোগ উঠছে জোর করে তাকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। বিশেষত কেউ যদি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করতে চাইলেও আশপাশের খ্রিষ্টানদের উপর আক্রমণ নেমে আসছে। প্রসঙ্গত, বর্ণপ্রথা থেকে উদ্ধার পেতে বহু যুগ আগে থেকে এদেশে দলিতদের বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুসলমান হওয়ার রেওয়াজ ছিল। উত্তর ভারতে নিজেদের সামাজিক আধিপত্য কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বিজেপি সেটা থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন তো আছেই, তাছাড়াও হিন্দুত্ববাদিরা সরাসরি সামাজিকভাবে বলপ্রয়োগ করে হিংসাকে রক্ষাকবচ হিসেবে গ্রহণ করেছে। নতুন আইনে জোর করে ধর্মান্তরকরণের ঘটনায় ১০ বছর কারাদণ্ডের আইন হয়েছে প্রায় ১১টি রাজ্যে। ২০২০ থেকে উত্তরপ্রদেশে চালু হওয়া এই আইনের ফলে ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করতে গিয়ে ধর্ম পাল্টানো অজামিনযোগ্য ‘অপরাধ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে হিন্দুত্ববাদী শাসকরা মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের এমনকি দলিত-আদিবাসীদেরও এদেশের হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নৃশংসভাবে খুন করাকে বৈধতা দিতে চাইছে। কারণ, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বাড়লে কেরালার মতো রাজ্য তৈরি হতে পারে যে রাজ্যে বিজেপি জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসন পায় না। যদিও কেরালায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু খ্রিষ্টান ও মুসলমান মিলেও ৪৫ শতাংশ হওয়ায় সে রাজ্যে রাজনীতির গুণগত ও সাংগঠনিক সমীকরণ দেশের অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা ‘কেরালা মডেল’ দেশের অন্য কোথাও আর দেখতে চায় না।