‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’। বাংলার এক জনপ্রিয় গান। এ গানের সুর দিয়েছিলেন অপরেশ লাহিড়ী। গানটি গেয়েছিলেন কোকিলকণ্ঠী লাতা মঙ্গেশকর। গানটি বসানো হয়েছে শহিদ ক্ষুদিরামের মুখে। ফাঁসির মঞ্চের দিকে যেতে যেতে যেন এই গান গাইছেন ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন বয়েসের তরুণ ক্ষুদিরাম।
গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। সমিতির নির্দেশে তিনি আর প্রফুল্ল চাকি বিহারের মজঃফরপুর যান অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। মজঃফরপুরের ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে কিসফোর্ডের গাড়ি দেখে বোমা ছোঁড়েন তাঁরা। সে গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না, ছিলেন মিসেস কেনেডি আর তাঁর কন্যা। বোমায় নিহত হলেন এই দুই জন।
গুপ্ত সমিতির নেতারা বলে দিয়েছিলেন বোমা ছোঁড়ার পরে পকেটের রিভলবার ফেলে দিতে। ক্ষুদিরামের কাছে ছিল দু-দুটো রিভলবার। তাঁর প্রিয় জিনিস। হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে আলাপ হবার পরে ক্ষুদিরাম তাঁর কাছে রিভলবার চেয়েছিলেন। রিভলবার সমেত রেল স্টেশনের কাছে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম। ১৯০৮ সালের ২ মে। প্রফুল্ল চাকি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মঘাতী হন। ক্ষুদিরাম সে সময় পান নি। ধরা পড়েন তিনি। ১৯০৮ সালের ২১ মে শুরু হয় তাঁর বিচার।
যে গানের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেই গানে বিচারের কথা আছে, ‘শনিবার বেলা দশটার পরে জজকোর্টেতে লোক না ধরে’। আর তারপরের লাইনে আছে বিচারেরর রায়ের কথা, ‘হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি’।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় ১৯০৮ সালের ৮ আগস্ট।
গানে যে অভিরামের উল্লেখ আছে, কে তিনি? তিনিই গানটির লেখক বলে বোঝা যাচ্ছে। কে এই অভিরাম?
এত দিন ধারণা ছিল অভিরাম হলেন বাঁকুড়ার এক লোককবি, যাঁর আসল নাম পীতাম্বর দাস। কিন্তু পীতাম্বর কেন অভিরাম নাম নিয়েছিলেন তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। গবেষক স্বদেশরঞ্জন মণ্ডল প্রমাণ করেছেন যে পীতাম্বর দাস নয়, এ গানের লেখক বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো। যাঁর বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের রাধানগর গ্রামে। ১৯৯৭ সালের ১৫ আগস্ট রাধানগর গ্রামে হেমচন্দ্রের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। সে স্তম্ভের গায়ে লেখা আছে ‘অভিরাম স্মৃতিস্তম্ভ’। হেমচন্দ্রের ডাকনাম কি ‘অভিরাম’? তার কোন প্রমাণ নেই। পরোক্ষ প্রমাণ অবশ্য আছে। এক এক করে তা বিচার করে দেখা যাক।
প্রথমত, হেমচন্দ্র তাঁর ‘বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা’ বইতে ক্ষুদিরামের সঙ্গে তাঁর আকস্মিক পরিচয়ের কথা বলেছেন।একদিন মেদিনীপুর শহরের রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে এক তরুণ তাঁর পথরোধ করে দাঁড়ায়। বোঝা যায় তরুণটি তাঁর পরিচয় জানতেন। তাই বিনা দ্বিধায় তরুণ তাঁর কাছে রিভলবার চান। কি করবেন তিনি রিভলবার দিয়ে?
আবার বিনা দ্বিধায় তরুণ বলেন যে তিনি ইংরেজ মারতে চান।
হেমচন্দ্র এই তরুণের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁকে নিয়ে আসেন গুপ্ত সমিতিতে। হেমচন্দ্রই ক্ষুদিরামের অস্ত্রগুরু।
দ্বিতীয়ত, ক্ষুদিরাম যে বোমা নিয়ে কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়েছিলেন, সে বোমা হেমচন্দ্রেরই তৈরি। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বোমা তৈরির তাগিদ অনুভব করেছিলেন হেমচন্দ্র। তাই তিনি নিজের জমিজমা বিক্রি করে চলে গিয়েছিলেন ইউরোপ। এক ফরাসি কেমিস্টের কাছে এক্সপ্লোসিভ তৈরির কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। এই কেমিস্ট সম্ভবত বলশেভিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গানের একটি লাইনে আছে, ‘(ওমা) কলের বোমা তৈরি করে দাঁড়িয়েছিলাম রাস্তার ধারে / বড়লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম ইংলণ্ডবাসী।’
তৃতীয়ত, হেমচন্দ্র ক্ষুদিরামের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। তাঁর সম্পর্ক তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘আমরা দেখেছি তার অন্যের প্রতি আচরিত অন্যায় অত্যাচারের তীব্র অনুভূতি। সে অনুভূতির পরিণতি বক্তৃতায় নয়, বৃথা আস্ফালনে নয়, অসহ্য দুঃখ কষ্ট এমন কি মৃত্যুকে বরণ করে, প্রতিকার অসম্ভব জেনেও শুধু সেই অনুভূতির জ্বালা নিবারণের জন্য; নিজ হাতে অন্যায়ের প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে ঐকান্তিক প্রবৃত্তি ও সৎসাহস ক্ষুদিরামের চরিত্রবৈশিষ্ট্য। ভারতের পুরাণ, ইতিহাসে এমন কি রূপকথায় এই কঠিনতম পরার্থপরতার তুলনা নাই।’
চতুর্থত, গান লেখার ও গান গাওয়ার অভ্যেস ছিল হেমচন্দ্রের। স্বদেশরঞ্জন মণ্ডল হেমচন্দ্রের কয়েকটি গান সংকলন করেছেন ‘হেমচন্দ্র রচনাবলি’তে।
পঞ্চমত, ক্ষুদিরামের ফাঁসির অল্প পরে ১৯০৯ সালের ১১ ডিসেম্বর আন্দামানে দ্বীপান্তর যাত্রা করতে হয় হেমচন্দ্রকে।