এবারে পুজোর দেশ সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর মূল স্টোরি পড়তে গিয়ে দুটি ছবির বাঁদিকে পিঁপড়ের মতো আমার নামটা দেখে বুঝলাম এ ছবি আমারই তোলা।
স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে যখন দেখি সুনীলদার মত লেজেন্ডদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো যেন স্বর্ণালী অক্ষরে বাঁধানো হয়ে আছে, জীবনের উপন্যাসে তখন নিজের ছবিওয়ালা সত্ত্বাটার জন্য বড়ো আনন্দ হয়। নিশ্চিন্ত লাগে। আজ তাই ভাবলাম পেজফোর পুজো সংখ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শেষ আইকন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু স্মৃতি শেয়ার করে নিই পাঠকের সঙ্গে…
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়ার আকুলতা পাঠকদের ভিতরে এখনও অটুট যা আমি বুঝতে পারি পুজোসংখ্যায় ওনার অনুপস্থিতি দেখে। সুনীলদা লেখক হিসেবে সকলের প্রিয়। কিন্তু আমি তাঁকে জানি, চিনি লেখায় নয় — গল্পে, আড্ডায়, গানে, ছবি তোলায়। আমার দেখার অভ্যাস থাকলেও পড়ায় অনেক পিছিয়ে। প্রায় নেই বললেও আপত্তির জায়গা নেই। আমার স্ত্রী নিবেদিতা ঠিক তার উল্টো। ওর বাংলা ও ইংলিশ সাহিত্যের প্রতি এত প্রেম দেখেই আমিও একটু আধটু বইপত্র নাড়াচাড়া করি। তাও বাংলা। ইংলিশ বলাই আমার কাছে দুর্বোধ্য। সেই ভাষায় আবার নভেল!!
সারা বছর কলকাতায় কলেজ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু আধটু গল্প, উপন্যাস, কবিতা ঘাটাঘাঁটি করতাম। তাই বন্ধুদের ভিতরে সাহিত্য নিয়ে কোনো আলোচনা হলে মাথা নাড়ানো ছাড়া আমার কিছুই করার থাকতো না। ওদের আলোচনা শুনলেই আমার হয়ে যেত। অনেকটা ভূমিকা পরেই বই পড়ার মতন বা বলতে পারেন ক্যানিং পৌঁছেই সুন্দরবনের গল্প লেখা বাঘের ডাক শুনতে পাওয়ার মতন।
আমি মোটেও পড়ুয়া ছাত্র ছিলাম না কখনো। স্কুল জীবনে স্বপন কুমারের ডিটেকটিভের বিভিন্ন সিরিজ কাল নাগিনী, ড্রাগন নানান রোমাঞ্চকর ঘটনার ওই চটি বইগুলো আর একটু আধটু সুকুমার রায় আর রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পো ছাড়া মিশনে মহারাজরা জোর করে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ….এই আমার বিদ্যা।
আমার সুবিধা ছিলো আজকাল পত্রিকা এবং সাদা বাড়ির কালো গ্রিল (আনন্দবাজার পত্রিকায়) কাজ করার সময় বহু কবি, সাহিত্যিক-সহ বিভিন্ন গুণী মানুষদের সাথে হ্যাংলার মত মেলামেশা করার সুযোগটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মত পেলাম। পরবর্তী জীবনে এগুলোই কিন্তু আমার ছবি তোলায় অনেক উপকার হয়েছে।
৭০, ৮০, ৯০-এর দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে একটা ছোট কফি নিয়ে, আমাদের ভাষায় ইনফিউশন বলতাম, সেটা তিন চার এমন কি পাঁচটা ভাগও করে খেয়েছি। সে আনন্দ এখনকার সাজানো গোছানো কফি শপগুলো দিতেই পারে না। সেই সময় একটা ব্ল্যাক কফির দাম ৫০ পয়সা। দুধ কফি ৬৫ পয়সা। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যেতো। উঠে যাও বলার লোক নেই। আমাদের ঠিক আগের জেনারেশনের সুনীলদা, শক্তিদা, দীপক মজুমদার, শ্যামল গাঙ্গুলী, সন্দীপন, নবারুনদা, রাঘবদা, কবি নিরেন দা, শ্যামল গাংগুলি এরকম বহু গুণী মানুষ নিয়মিত যেতেন।
আমাদের আড্ডার ভিতরে ভাগ্য ভালো থাকলে এদেরকেও দেখতে পারতাম। কথা না থাকলেও যেচে পড়ে একবার হ্যালো করে আসতাম। লেখালেখির ধার আমার কোনদিনই ছিল না। উপন্যাস না পড়ে ছোটগল্প, কবিতা এটাই আমার প্রিয় ছিল।
আনন্দবাজার অফিসে লিফটে তিন তলায় উঠে করিডোর ধরলেই শেষ মাথায় ধাক্কা খেলেই ফটো ডিপার্টমেন্ট। নেমেই কাচের দরজা ঠেলে এগোতে থাকুন…. যেতে যেতে করিডরের ডানদিকে দেশের ঘর। তার আগে সানডে, তারও আগে স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড। আসা যাবার পথে আমি দেশের ওই কাচের ঘরটার দিকে একবার তাকাবোই। কারণ বাংলা সাহিত্যের দেবতারদের দেখা মেলে ওই ঘরেই।
শীর্ষেন্দুদা, সুনীলদা, শক্তিদা, জয় গোস্বামী, আবুল বাশার, সাগরময় ঘোষ… যদিও তিনি চেম্বারে বসতেন। এইসব বিখ্যাত নামি সাহিত্যিক ছাড়াও দেখতাম সামনের টেবিলে লেখালেখির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা নতুন ছেলেমেয়েরা বসে আছে। অনেক সময় দু-একজন সুন্দরীদেরও দেখতাম সুনীলদার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে আছে। এটা আমি ঘুরে দু-বার দেখবোই। কিন্তু সুনীলদাকে পেছন থেকে দেখতে হতো কারণ চেয়ারের পেছনটা করিডোরের কাচের দিকে ছিলো।
তখনো আনন্দবাজারের অফিসে আগুন লাগেনি। ওপরে ওঠার এত কড়াকড়ি নিয়ম ছিল না। শুধু একবার রিসেপশনে বললেই হতো আমি অমুক মানুষের সাথে দেখা করবো। তাহলেই পারমিশন মিলতো।
সুনীলদা তাঁর সামনের চেয়ারে কেউ না থাকলে অনেক সময় দুটো হাত মাথার পেছনে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতেন। এটা আমার দেখতে ভালো লাগতো। সিগারেট তো আছেই। তখনই অফিসে সেন্ট্রাল এসি হলেও সব ঘরে সিগারেট খাওয়া যেত। কিন্তু আগুন লাগার পর ধূমপান বন্ধ হয়ে যায়। সুনীলদা প্রচুর সিগারেট খেতেন।
আনন্দবাজারে ঢোকার শুরুর দিকে টিকে থাকার জন্য একটু ভালো আসাইনমেন্ট পাবার আশায় বেশিরভাগ সময়ই রাতে অফিসে থেকে যেতাম কিংবা খুব সকালেই অফিসে হাজির হতাম। সুনীলদা একটু বেলায় দেশে আসতেন। শক্তিদা আবার ঠিক উল্টো সাত সকলেই অফিসে ঢুকে যেতেন। চার তলার রিপোর্টিং বিভাগে তখন কেউ আসেনি। আসলে মর্নিং শুরুই হতো সকাল ১১ টা থেকে।
আমি ওপরে গিয়ে শক্তিদার পাশে বসে পড়তাম। নানান গল্প। শক্তিদা দু-আঙ্গুলের ভিতরে সিগারেটটা ধরে ঘুষি মারার মতন টান দিয়ে যে ধোঁয়া ছাড়তেন সেটা ছোটো উনুন ধরানোর মতন ধোঁয়া ছিলো। মেজাজ ঠিক থাকলে বলতেন সিগারেট খাবি। অফিস শুরু হলেই কিন্তু শক্তিদা আর নেই। খানিক দেশে আড্ডা মেরেই চলে যেতেন।
সুনীল-শক্তি এই জুটি কিন্তু আমাদের কাছে একটা সাবজেক্ট। জানিনা কেনো এই জুটি নিয়ে কেউ পিএইচডি করেন নি। পুজোর দু-মাস আগেই সুনীলদা-সহ বহু সাহিত্যিকদেরই আর দেখতাম না অফিসে। পরে জেনেছিলাম উপন্যাস, গল্প লেখার জন্য নির্জন জায়গায় ওনারা চলে যেতেন।
বন্ধুদের মুখে শুনতাম সুনীলদা কবিতাটা লিখলেই ভালো হতো। সুনীলদা মানেই কেউ আবার বলতো উপন্যাস কেউ বা বলতো গল্প। তারা সবাই পড়ে বলে এই কথাগুলো বলতো। আমি অত পড়িনি। আমার সঙ্গে সুনীলদার ব্যক্তিগত আলাপ ও সেইসঙ্গে ওনার ছবি তোলার সূত্রেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমার সঙ্গে সুনীলদার অফিসে শুধু নয় বাড়িতেও অবাধ বিচরণ ছিল। এমনকি সুনীলদার জন্মদিনেও আমার নিমন্ত্রণ থাকত। বহু জন্মদিনে দেখেছি রাতে একদম শেষ দিকে সুনীলদা রবীন্দ্র সংগীত গাইছেন বা কাউকে গাইতে বলতেন। তখন তো মোবাইল আসেনি। আর আসেনি বলেই হয়তো সেই সময়গুলো মনের গভীরে গেঁথে আছে। এখন মোবাইল জীবনে যা অসম্ভব। আমাদের জীবন এখন অনেকটাই রিমোট কন্ট্রোল। অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, পে-টিএম। চাইলেই সমস্ত বিশ্বসংসার হাতের মুঠোয়। আমাদের কত পরিশ্রম করতে হতো। ম্যানুয়াল সেই দিনগুলো ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।
তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে কত সাহিত্যিক, গায়ক গায়িকা, উঠতি কবি, পোড়খাওয়া কবি সবাইকেই ওনার জন্মদিনে দেখা যেত। নাট্যকাররাও বাদ যেত না। বাদ যেত না সাহিত্য ভালোবাসা অভিনেতা অভিনেত্রীদের। বহু সময় এই ব্যবস্থাপনা করতো আমাদের বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনেতা বাচিক শিল্পী আমাদের সৌমিত্র মিত্রদা। যার সব সময় এনার্জি লেবেল এভারেস্ট সামিট করে।
সৌমিত্রদার কল্যাণে আমি বহু সাহিত্যিক সভায় এমনকি ঘরোয়া পার্টিতেও ডাক পেতাম। শান্তিনিকেতনের কবিতা উৎসবে একবার বহু মানুষকে অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় সুনীলদা এই কথাগুলো লিখেছিলেন আমি ইচ্ছে করেই ভিড়ের মধ্যে শুধু হাত দুটো রেখেই পোস্টের ছবিটা তুলেছিলাম। কি লেখা তা আপনারা ছবি দেখেই পড়ে নিতে পারবেন।
শান্তিনিকেতনে গেলে সুনীলদার বাড়িতে তো একবার যাবোই। সুনীলদা ছাড়াও সেখানে স্বাতীদি সব সময় মিষ্টি হেসে সকলকে আপ্যায়ন করতেন। আর দোলের সময় তো এক রঙিন হুল্লোড়।
আমার করা ইটসি-বিটসি নাটক সুনীলদা দেখতে এসেছিলেন। নাট্য পরিচালক দেবাশীষ এই নাটকে আমাকে দিয়ে ছোটো ছোট দুটো চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলো। আমার ভাগ্য বিশিষ্ট অভিনেতা গৌতম হালদারের সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম বলে। শেষ দৃশ্যে আমি বিচারক গৌতম হালদার বসে বসে কথা বলছি… এটা আজও আমার ভাবনার বাইরে। গৌতমদা আমায় সাহস জুগিয়েছিলো।
এই নাটকে একটা সিনে আমি দর্শক আসনে অল্প আলোয় সুনীলদাকে দেখি। শুধু দেখি না সুনীলদার একটা কথাও আমার কানে আসে, “আরে এ আমাদের অশোক না?” পাশে আর কারা ছিল বলতে পারব না।
নাটকের শেষে সুনীলদা গ্রীনরুমে আসলে প্রণাম করি। সুনীলদা জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি আবার কবে থেকে নাটক করছ? সময় পাও?”
কলকাতায় নানা অনুষ্ঠানে সুনীলদা যেতেন। কাউকে না করতে পারতেন না। কলকাতার পাতার জন্য কবি সাহিত্যিকদের গ্রুপ বুধসন্ধায় সুনীলদার নাটক, বাড়িতে গান, লেখালেখি, রাস্তায় হাঁটা, ড্রিংকস হাতে, ট্রামে বসে থাকা, বহু রকম অসংখ্য ছবি আমার সংগ্রহে রয়েছে। আমাকে দেখলেই সুনীলদা বলতেন, “এইরে মেশিনগান নিয়ে অশোক চলে এসেছে!” আসলে মুহূর্ত ধরার জন্য ক্যামেরার মোটর চালালেই ঐরকম আওয়াজ হতো।
পার্কস্ট্রিটে তখন মিউজিক ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বড়ো শোরুম ছিলো। যেখানে এখন আধুনিক খাবারের দোকান। ইটসি বিটসি নাটকের গানগুলোর সেই ক্যাসেট সুনীলদা, স্বাতীদি দুজনে একসঙ্গে রিলিজ করেছিল পরিচালক দেবাশীষ, আমার, ও ভূমির সুরজিৎ-এর অনুরোধে।
দেখলাম অনুষ্ঠান শেষে সুনীলদা রবীন্দ্র সংগীতের কাসেট সিডি উল্টেপাল্টে গানগুলো দেখতে দেখতে নিজের মনেই গুনগুন করছিলেন। সচল ছবি ভিডিও এতো জনপ্রিয় ছিলো না। সত্যি ছিলোনা বলেই আমরা মানুষদের অনুভূতি বুঝতে পারতাম। সব কিছু দেখা শোনার অভ্যাস ছিল। শান্ত স্বভাবের একদম আস্তে আস্তে কথা বলার অন্যরকমের মানুষ ছিলেন সুনীল দা। সুনীলদার মুখে গান ছাড়া কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতে শোনে নি।
একবর মনে আছে….জন্মদিনে আমি, তসলিমা নাসরিন-সহ অনেকেই সুনীলদার পাশে বসেছিলাম। তখন বেশ রাত হয়েছে। হঠাৎ সুনীলদা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “জানো আমার অনেক বন্ধু চলে গেছে মাঝে মাঝে আমি তাদের কবিতা শুনি। গল্পো করি। এখন বড্ড একা লাগে। আমারও আর ইচ্ছা করে না…?”
কথাগুলো বলার সময় দেখছিলাম কাশফুলের মতো ঝাঁকড়া চুলে কপাল ঢেকে গেলেও সুনীলদার চোখ চিক চিক করছে স্বাতীদি একটা হাত ধরে বলছে, “চলো অনেক রাত হয়েছে….ওঠো তো।”
এক ভোররাতেই নবমীতে সৌমিত্র মিত্র দাদা ফোন করে সুনীলদার মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিল। আমি বিছানায় উঠে বসি। ডাবল ই ব্লকের ভোরের আরতির ঢাকের শব্দ কানে আসছে। বহু স্মৃতি মনে করতে করতে সিদ্ধান্ত নিই যে আজ আমি সুনীলদার কাছে যাব না।
কত কত স্মৃতি মনে ভীড় করে আসছে। সেসব লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে। এটা পড়তেই আপনাদের ধৈর্য্যের ত্রুটি ঘটবে। শেষ করি সুনীলদার জন্মদিনে আমারই তোলা একটি ছবির ঘটনা বলে। আনন্দবাজারে কলকাতায় প্রকাশিত সেই ছবির কথা অনেকেরই মনে আছে। বুঝতে পারি এখনও অনেকে আমাকে মনে করায় ছবিটার কথা।
বিশেষ কিছু ছবি তুলবো বলে সুনীলদাকে নিয়ে বেড়িয়েছি। কি তুলবো কিছু ঠিক করিনি। রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক করে নেবো। এটা বরাবরের অভ্যাস। বিখ্যাত মানুষদের সাধারণ কোনো জায়গায় ছবি তুলতে আমার খুব ভালো লাগতো। গাড়িতে উঠিয়ে সোজা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে হাজির হলাম।
ভিক্টোরিয়ার উল্টো দিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সুনীলদাকে বললাম, “চলুন ব্রিগেডের মাঝখানে যাই।”
কিছুক্ষন হাঁটার পর সুনীলদা বললেন, “আর কত হাঁটাবে অশোক?”
সুনীলদার হাঁটা ছিলো অনেকটা পালকি চলার মতন।
আমি বললাম, “আর একটু সুনীলদা।”
ব্রিগেডের ঠিক মাঝামাঝি এসে বললাম, “সুনীলদা এখানেই।”….বলেই নানান মুহূর্ত তুলে যাচ্ছি।
সুনীলদা বললেন, অশোক “অনেকটা হেঁটেছি, এবার একটু বসি। কি বলো?”
সুনীলদা ঘাসের উপর বসে পরলেন। আমি নানারকম অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছি। উনি নিজের মনে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন। হটাৎ কি মনে হতে বললাম, “সুনীলদা, ঘাসের উপর একটু শুয়ে পড়বেন?”
অবাক হয়ে বললেন, “অ্যাঁ। শুয়ে পড়বো? ঠিক আছে….”
সুনীলদা চিৎ হয়ে শুয়ে পরলেন। যতদূর মনে পরছে একটা হলুদ কিংবা কমলা রঙের ছাপা শার্ট পরেছিলেন সেদিন।
এখনও কানে ভাসে…..শুয়ে শুয়ে সুনীলদা বলছেন, “এরকম করে শুয়ে তো কোনোদিন কলকাতার আকাশ দেখিনি। কতবড়ো আকাশ!! কত পাখি উড়ে যাচ্ছে….”
ওই ১৫/২০ মিনিটের ভিতরে সুনীলদা অনেক সিগারেট খেয়েছিলেন। আধপোড়া সিগারেটগুলো ছাই শুদ্ধ ঘাসেই ফেলছিলেন। ছবি তোলার সময় সেটাও ফ্রেমে রেখেছিলাম।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত সেই ছবি পাঠকদের কাছে খুবই প্রশংসা পায়। আমি সুনীলদার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। অশোক বলে কথা বলতেন। আমার মত ক্লাস ফোরেই ফেল, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যাহোক করে টিকে থাকা মানুষের সঙ্গে সুনীলদার মত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাওয়া সৌভাগ্য ছাড়া আর কিই বা বলতে পারি? এর চেয়ে বেশি সুনীলদার সম্পর্কে বলার ক্ষমতা বা সাহস আমার নেই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি সাহিত্য দিয়ে বুঝিনি। তাঁকে চিনেছি বন্ধুত্বে, চিনেছি শিশুসুলভ উদারতায়। ক্যামেরার লেন্স দিয়ে তাঁকে দেখেছি। সামনে বসে গল্প শুনেছি। তার ছায়া যতটুকু মাড়িয়েছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট। অর্ধেক জীবনের কথা বলে আমাদের কাছে সুনীলদা নিজেই একটা গোটা আকাশ হয়ে আছেন। যাঁকে সঙ্গী করে আজও বাঙালী দিকশুণ্যপুরের দিকে যাত্রা করার স্বপ্ন দেখে। প্রণাম নিও সুনীলদা।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত
ছবি : অশোক মজুমদার