শ্রীমদ্ভগবতগীতা শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, তার রয়েছে এক অপরিসীম ক্ষেত্র। তার ভাব পরিমণ্ডল বিশাল আকাশের মতো। এক জীবনে গীতার মর্মার্থ বোঝা সহজ নয়। গীতার মধ্য দিয়ে মনুষ্য ধর্মের কথা, শাশ্বত জ্ঞান, চিন্তা, মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক চৈতন্য, কর্মযোগ ও জীবন দর্শনের কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র কি না, সেই আলোচনার মধ্যে না ঢুকেও আমরা বলতে পারি, তিনি এমন এক মহামানব, যাঁকে ভারতবাসী কখনও অস্বীকার করতে পারেন না। গীতা এবং শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সারা বিশ্বে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। গীতা মানুষকে অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের পথে নিয়ে যেতে বলেছে, ধর্মের মধ্যে প্রেমের কথা বলেছে, জীবনে নৈতিকতার কথা বলেছে। অথচ আমরা কার্যত উল্টোপথেই হাঁটছি। আমরা ধর্মের উগ্রতাকে মন্ত্র করে ক্রমেই হিংসার পথে উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছি। ধর্মের আঙিনা থেকে প্রেমকে আগাছার মতো উপড়ে ফেলে মানবিক সত্তাকে জলাঞ্জলি দিয়েছি। ধর্মের মধ্যে সহিষ্ণুতার কথা বলা হলেও কোনও সম্প্রদায়ই আজ তা মানতে নারাজ। ধর্মমণ্ডুকদের মানসিকতা থেকে ‘নৈতিকতা’ শব্দটাই যেন হারিয়ে গিয়েছে। এর কারণ রাজনৈতিক। রাজনীতি যতদিন ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ততদিন মানুষের ভাগ্যাকাশে দুর্দশার সিঁদুরে মেঘ জমে থাকবে। বৈদিক যুগে ধর্ম ছিল কর্মপ্রধান, উপনিষদের যুগে জ্ঞানপ্রধান, পৌরাণিক যুগে ধর্ম হল ভক্তিপ্রধান এবং বর্তমান যুগে ধর্ম হয়েছে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। প্রতিদিন আমরা এই অস্ত্রকে বিভিন্ন দেশের শাসক এবং বিরোধীদের আপন স্বার্থে ব্যবহার করতে দেখি। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা এবং ক্ষমতা লিপ্সা। সেই ক্ষুদ্র চেতনা মানুষের ভাবনার মধ্যে বিষ ঢেলে তার মনে হিংসার উন্মেষ ঘটাচ্ছে। এ আর কিছুই নয়, ডিভাইড অ্যান্ড রুল।
এই অবস্থার মধ্যেও রয়েছে একটা আনন্দ সংবাদ। আজ ভারতবাসী হিসাবে একটি গর্ব করার মতো পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে। সেটি হল ভগবদ্গীতা এবং ভরতের নাট্যশাস্ত্র রাষ্ট্রসঙ্ঘের নথিতে স্থান পেয়েছে। ইউনেস্কোর মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার-এ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই দু’টি শাস্ত্রকে। এর আগে ইউনেস্কোর নথিতে ঠাঁই পেয়েছে তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’, বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ঋগ্বেদ’ ইত্যাদি। গীতার মতো মহান গ্রন্থকে নথিতে স্থান দিয়ে ইউনেস্কো আসলে বিশ্বের কাছে সৎ কর্মযোগ এবং শুদ্ধ চেতনার বার্তাই দিল।
বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘গীতা রহস্য’ বইতে আলোচনায় বলেছেন, গীতা আসলে কর্মযোগের কথাই বলে। প্রতিটি মানুষ সৎ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে সমাজ উন্নত হতে বাধ্য। কর্ম, জ্ঞান এবং আদর্শের জন্যই গীতা হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আধ্যাত্মিক শক্তি। বিপরীত ভাবনাকেও মেলাতে পেরেছিল গীতা। স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা ছিলেন চরমপন্থী, যাঁরা ছিলেন নরমপন্থী অথবা গান্ধীজির মতো অহিংস পথের পথিক, তাঁদের সকলের কাছেই আদর্শ গ্রন্থ ছিল গীতা। শ্রীঅরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, গান্ধীজি, ক্ষুদিরাম— এঁদের প্রত্যেককেই জীবনে লড়াইয়ের দিশা দেখিয়েছে গীতা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আত্মবিস্মৃত জাতির সামনে শ্রীকৃষ্ণকে প্রেরণার এক অফুরান শক্তি হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। বিদেশের বহু পণ্ডিতও গীতার দর্শনের মধ্যে পেয়েছেন মানবসত্তাকে প্রদীপের মতো জ্বালিয়ে তুলে আলো বিকিরণ করার প্রজ্ঞা। মার্কিন বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের জীবন প্রভাবিত হয়েছিল গীতার মন্ত্রে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক আর্থার উইলিয়াম রাইডার গীতার অনুবাদ করেছিলেন। ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক অলডাস হাক্সলি গীতার মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ ও গভীরতা অন্বেষণের চেষ্টা করেছেন। গীতার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য সং অব গড’। জার্মান দার্শনিক ম্যাক্সমুলারও গীতার মধ্যে ভারতের ঐক্যমন্ত্রের সুর খুঁজে পেয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন গীতার ভক্ত। তিনি চার্লস উইলকিন্সকে দিয়ে গীতার অনুবাদ করিয়েছিলেন। সেটি ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল গীতাপাঠ।
গীতার শ্লোক শুরু হচ্ছে ‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে’ কথাটি দিয়ে। সৎ যুক্তি দিয়ে বিচার করা দরকার, এখানে শ্রীকৃষ্ণ কোন ধর্মের কথা বলেছিলেন। তখন তো সম্প্রদায়গত কোনও বিভেদ ছিল না। ‘আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ, তোমার ধর্ম খারাপ’, ‘গোলি মারো শালোকো’— এসব তো ছিল না। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ কোন ধর্মের কথা বলেছিলেন? তিনি শাসকের ধর্মের কথাই বলেছিলেন। অর্থাৎ শাসক যখন আদর্শচ্যুত হয়ে গোটা সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেন, সমাজে অনাচার বেড়ে যায়, তখন শাসক ধর্মচ্যুত হন, তখন তাঁর বিনাশ দরকার। তাই কৌরবদের বিনাশ করে ধর্ম স্থাপনের জন্য অর্জুনকে উৎসাহিত করেছিলেন তিনি। যখন কৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করেন, কংসকে বধ করেন, জরাসন্ধকে বধ করেন, তখন কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রবর্তী হন তিনি? আসলে মানবধর্ম, কল্যাণধর্ম, নীতিধর্ম বিসর্জিত হলে তিনি নানা রূপে যুগে যুগে আবির্ভূত হন।
ইদানীং মাঝে মাঝে আমরা শুনি সনাতন ধর্মের কথা। সেই সনাতন ধর্ম বলতে একদল মানুষ কেবল হিন্দুধর্মকেই বোঝান। গীতায় সেই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, সনাতন ধর্ম হল মানুষের ধর্ম। কেমন সেটা? যেমন আগুনের ধর্ম তাপ দেওয়া ও দহন করা, বরফের ধর্ম শৈত্য। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রেই এই পদার্থগুলি তাদের নিজস্ব ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় না। তেমনই মানুষের ধর্ম হল সনাতন ধর্ম। তার মূল লক্ষ্য হল মানব কল্যাণ। গীতা সেই সনাতন ধর্মের বার্তাই বহন করে। তাই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জীবের ধর্মই সনাতন ধর্ম। তার কোনও আদি বা অন্ত নেই। সম্প্রদায় ভাবনা থেকে সনাতন ধর্মের দূরত্ব আকাশ পাতাল। কিন্তু কেউ সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিয়ে মত্ত হলে বুঝতে হবে সেখানে ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং বৃহৎ লালসা রয়েছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আজ যদি শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেন, তবে তিনি কার বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করবেন? আমরা দেশবাসী কি সত্যিই সুশাসন পাচ্ছি, শান্তিতে বেঁচে আছি? নৈতিকতার পথ কি অবরুদ্ধ হয়ে যায়নি? শাসকের ব্যর্থতা কি আমাদের জীবনকে শতচ্ছিন্ন করে দেয়নি? এমনই পরিপ্রেক্ষিতে জেগে ওঠার কথা বলে গীতা। দেয় আত্মজাগরণ ও প্রতিবাদের শিক্ষা। বীরমন্ত্রে মানুষকে উজ্জীবিত করে।
এখন সেই বীরমন্ত্রে আজ জেগে ওঠার সময়। মানুষের এবং দেশের সরকারের। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদে দেশের মানুষের জীবন জেরবার। পাকিস্তানের কলকাঠিতে বারবার ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ আমাদের দেশকে বিব্রত করেছে, বহু মানুষের প্রাণ নিয়েছে। তার যোগ্য জবাব দেশের শাসককে দিতেই হবে। মোদিজিকে আজ দেখাতে হবে, তিনি যেমন দুষ্টের দমন করতে সক্ষম, তেমনই তিনি শিষ্টের পালনেও বিশ্বাসী। দেশ থেকে আজ সমস্ত জঙ্গিকে নিকেশ করতে হবে তাঁকেই। পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ মোদিজির পাশে আছেন। তবে মনে রাখা দরকার, কয়েকজন ইসলামি জঙ্গির কৃতকর্মের জন্য দেশের সমস্ত মুসলমান জঙ্গি হয়ে যান না। একইভাবে সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা, মালেগাঁও বিস্ফোরণ বা গুজরাত গণহত্যার জন্য দেশের সব হিন্দু সন্ত্রাসবাদী হয়ে যান না। কিংবা কয়েকজন গোরক্ষকের হিংসায় বহু প্রাণ যাওয়ার পরেও হিন্দুদের মৌলবাদী বলে চিহ্নিত করা যায় না। আসলে সব ধর্মের মধ্যেই এমন মানুষ আছেন, যাঁরা মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে হিংসার পরিবেশ তৈরি করে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। এখন সেই দুঃসময়! এখন ‘শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-’ কবিগুরুর এই বাণী যেন গীতারই উপদেশ। মানুষ চাইছেন সীমান্তে প্রত্যাঘাত।
আজ কাশ্মীরের পরিস্থিতি দেখে মনে পড়ছে অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ ছবিটির কথা। সেখানে কাশ্মীরের ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল। একদল হিন্দু মৌলবাদী যাত্রীবাহী বাস থেকে বেছে বেছে মুসলমানদের নামিয়ে, তাঁদের শারীরিক ধর্মচিহ্ন পরীক্ষা করে হত্যা করেছিল। আসলে ধর্মসন্ত্রাস সব ধর্মের মধ্যেই রয়েছে। সুযোগ পেলেই সে হত্যালীলায় মেতে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর শিখ নিধন যজ্ঞের কথাও ইতিহাস ভুলবে না। ইতিহাস বলছে, এই সব বিচ্ছিন্নতা, হিংসার ঘটনা থেকে শাসকদল সুবিধা ভোগ করে। পুলওয়ামার কথা না বললে চলবে না। সেদিন সেই ঘটনার পর সারা দেশ জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে জেগে উঠেছিল। সেই জাতীয়তাবাদের ফসল ঘরে তুলেছিল বিজেপি। তারপর আর কিছুই হয়নি। জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক অবশ্য পরবর্তী সময়ে ভাণ্ডাফোঁড় করে দিয়েছিলেন।
অশুভ ধর্মচেতনা থেকে না সরলে দেশের মঙ্গল হতে পারে না। তা মানুষের শান্তিকে বিঘ্নিত করে। গীতা কোনও রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ভারতাত্মার মর্মকথা। গীতা যেমন বীরত্বের কথা বলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়ানোর কথা বলে, তেমনই নিষ্কাম ধর্মের কথাও বলে। লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ করলেই তার দর্শন ও ভাবনাকে আত্তিকরণ করা যায় না। ধরা পড়ে শুধু রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি।