সেই আদ্যিকাল থেকেই লোকবিশ্বাস আছে এমন কিছু লৌকিক দেবদেবী আছেন যারা আমাদের রোগব্যাধি ভালো করেন। সেই সূত্র ধরেই তাদের পূজো প্রচলিত হয়েছে সমাজে। যেমন ধরুন — শিশুরক্ষক দেবী হলেন মা ষষ্ঠী, ওলাউঠা বা কলেরা রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওলাইচন্ডীদেবী, জ্বর থেকে রক্ষা পেতে জ্বরাসুর পাঁচুঠাকুর, তেমনি বিভিন্ন চর্মরোগ-খোস, চুলকানির লোকায়ত দেবতা হলেন ঘণ্টাকর্ণ বা ঘেঁটু।
বাংলার জনসমাজের কল্পিত ঘণ্টাকর্ণ বা ঘেঁটু হলেন ভারী অদ্ভুত লোকদেবতা। তিনি নাকি শিবের অনুচর এবং তীব্র হরিবিদ্বেষী। এই ঘেঁটু দেবকুমার থাকাকালীন কিছু অপরাধের জন্য বিষ্ণুর কাছ থেকে অভিশাপ পান। ফলে তাকে জন্ম নিতে হয় পিশাচকুলে। ফলে খুব স্বভাবতই অভিশাপ দেওয়া বিষ্ণুকে তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেননা। বিষ্ণুর নাম যাতে তাঁর কর্ণকূহরে প্রবেশ করতে না পারে তাই তার নিজের দুই কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন সর্বক্ষণ। এই জন্যই তার নাম ঘন্টাকর্ণ।
হরিবংশের কাহিনী অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ একবার যদু বংশীদের ওপর দ্বারাবতীর ভার অর্পণ করে বদ্রিকাশ্রমে গিয়েছিলেন হরপার্বতীর কাছে পুত্র সন্তান কামনায়। সেখানে ঘণ্টাকর্ণ উপস্থিত ছিলেন। কেননা মহাদেব ঘণ্টাকর্ণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বদ্রিকাশ্রমে গিয়ে নারায়ণের কাছে নিবেদন করলে তবে তিনি শাপমুক্তি পাবেন। এখানে এসেই নারায়ণের সাক্ষাৎ লাভ করে তিনি মুক্তি পান।
স্কন্দপুরানে ঘণ্টাকর্ণকে শিবানুচর বলা হয়েছে। তিনি নাকি কাশিতে ঘন্টাকর্নেশ্বর নামে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রঘুনন্দনের তিথিকৃত্যতে ঘণ্টাকর্ণর কথা রয়েছে। মঙ্গলকাব্যের দিগবন্দনাপালায় ঘেঁটুর কথা আছে। জানা যায় ঘেঁটুর মন্দির ছিলো পড়াশে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে —
জোড়ুরের ভগবতী আমতার মেলাই।
পুরাসের ঘাঁটুবন্দ খেপুতের খেপাই।।
অনেকেই মনে করেন পড়াশ বাঁকুড়া জেলার জয়পুর থানার পড়াশ গ্রাম। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের জ্ঞানদাস কাঁদরায় পূজিত হয় ঘন্টাকর্ণ ভৈরব। শিবের গাজনের সময় এই ঘন্টাকর্ণের বাৎসরিক পূজাও হয়। অনেকেই সন্ন্যাসী হন ঘন্টাকর্ণের গাজন উৎসবে।
ঘেঁটুর ক্রমশ আর্যকরণ হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে যে ক্রমশ পরিচিত হয়েছিল ঘন্টাকর্ণ নামে। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তার ‘বাংলার লৌকিক দেবতা’ গ্রন্থে লিখেছেন —
শোনো শোনো সর্বজন ঘাঁটুর জন্মবিবরণ ।
পিশাচকুলে জন্মিলেন শাস্ত্রের লিখন।।
বিষ্ণু নাম কোন মতে করিবে না শ্রবণ।
তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করিছে বন্ধন।।
অনেকেই মনে করেন ধর্মঠাকুর বা সূর্যের লৌকিক সংস্করণ হলেন ঘেঁটু। কারণ সুর্যের আলো এবং ধর্মঠাকুর দুজনেই কুষ্ঠ এবং নানান চর্মরোগ থেকে মুক্তি দেন। এই লোকবিশ্বাস থেকেই হয়তো ঋতু পরিবর্তনের সমযে বসন্তে চর্মরোগের হাত থেকে মুক্তি পেতে ঘেঁটুপুজোর আয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ — সিলেট এবং ভারতের ত্রিপুরার কিছু অঞ্চলে এর পূজো হয়।
কোন মন্দিরে ঘেঁটু দেবতার পূজো হয় না। পুজো হয় পুকুর বা বিলের পাশে। এই দেবতার সঠিক কোন মূর্তি নেই। ভুষোকালি মাখা ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি বা মুড়িভাজার খোলা উল্টিয়ে ঘেঁটুর মূর্তি বানানো হয়। সেই উল্টানো খোলায় গোবর দিয়ে নাক, মুখ ও চোখ বানানো হয়। কালো হাড়িতে গোবরের উপর বসানো হয় সাদা কড়ি। কেউ কেউ আবার ঘেঁটু দেবতার কপালে লম্বা করে সিঁদুরের তিলক টেনে দেয়। খোলার উপর দেওয়া থাকে দূর্বাঘাস, ভাটফুল বা ঘেঁটুফুল, হলুদ ছোপানো ন্যাকড়া (ঘেঁটুর জামা), কচুপাতা, একটা লাঠি আরেকটি জ্বলন্ত মোমবাতি।
ষষ্ঠী গাছকে ঘেঁটুর আসনে পোঁতা হয়। আতপ চাল ডাল দূর্বা ধান হলুদ গুড় ইত্যাদি দিয়ে কলাপাতায় নৈবিদ্য সাজানো হয়। ভাঙ্গা হাড়ির ভেতরে জালানো হয় প্রদীপ। ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে এটিকে বিগ্রহ মেনে পুজো করা হয়।
আজ আনন্দে ঘেঁটু লয়ে সঙ্গে,
নাচিয়া গাহিয়া চলো সবে যাই,
মনের আনন্দে দাওগো পূজা,
এমন দিন তো হবে নাই।
খোস্ চুলকনা ঘেঁটু দিয়েছিস গায়,
সতী নারী বীরপতির গায়,
বামে দাঁড়িয়ে সতী নারী,
পতি বিনা সতীর গতি নাই।
এ পূজায় কোন পুরোহিতের দরকার পড়ে না। মহিলারাই সাধারণত ব্রতটি করে থাকেন। পুজোতে কচিকাঁচারা সব নতুন জামা কাপড় পরে। পূজা শেষে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাঠি দিয়ে ঘেঁটুর আসন মানে মাটির হাঁড়িটি ভেঙ্গে দেন। ঘেঁটুঠাকুরকে পুকুরে বিসর্জন দিয়ে হরিনাম কীর্তন করা হয়। এরপর গোবরের টুকরো আর কড়ি বাড়ির চৌকাঠের উপর রেখে দেওয়া হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এর ফলে ওই পরিবারের কারোর আর চর্মরোগ হবে না।
পুজোর পরে কলাগাছের কান্ড দিয়ে চতুর্দোলা তৈরি করে তাকে ঘেঁটুফুল দিয়ে সাজিয়ে তার ভিতরে একটা প্রদীপ বসিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রাম পরিক্রমা করে ছোটছেলমেয়েদের দল। চাল পয়সা মুড়ি অর্থাৎ সিধে আদায় করে বাচ্চারা আর সঙ্গে বলে সব মজার ছড়া —
চাল ডাল কলাই বড়ি
ঘেঁটু চলে বাড়ি বাড়ি।
যে দেবে মুঠো মুঠো
তার হবে হাত ঠুঁটো।
যে দেবে থালা থালা
তার হাতে সোনার বালা।
যে দেবে একটুখানি
তার হবে চুলকানি।
যে না দেবে ভরা ভরা
তার হবে খোস পাঁচড়া।…
লোক বিশ্বাস হল কোন বাড়ির লোকেরা যদি সিধে না দেয় তাহলে ঘেটুর অভিশাপে তাদের বাড়িতে খোস পাঁচরা আর চুলকানি প্রবেশ করে অস্থির করে তুলবে।
চৈত্র মাস জুড়ে ঘেঁটুকে উদ্দেশ্য করে নানা গান রচনা করে সারা পাড়া পরিক্রমা করে ছোটরা। গ্রাম বাংলার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কলার পাতা দিয়ে পালকি তৈরী করে পালকির ভিতরে প্রদীপ জালিয়ে এবং পালকিটিকে ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরের পুজো করেন। সন্ধ্যেবেলা ছোট ছোট ছেলেরা রঙীন কাগজ ও কঞ্চি দিয়ে ছোট্ট ডুলি বানিয়ে তাতে ঘেঁটু ফুল ও প্রদীপ দিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরকে সাজিয়ে তা কাঁধে করে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং ঘেঁটুর গান গেয়ে চাল পয়সা ভিক্ষা করে।
ঘণ্টাকর্ণ পুজোর কাঠখোদাই ছবি…তখনকার পঞ্জিকাতেও এই পুজোর নির্ঘন্ট দেওয়া থাকতো.. গুপ্তপ্রেস হাফ পঞ্জিকা ১৯২৪
১) শোন শোন সর্বজন ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ।
পিশাচ কুলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।
বিষ্ণুনাম কোনমতে করবে না শ্রবণ
তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করেছে বন্ধন।
২) ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি
এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা-বালা
যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটো
যে দেবে এক পলা তেল তার হবে সোনার দেল।
৩) আলোর মালা চাল-ডাল দাও
নয় খোসপচড়া লও।
যে দেবে ধামা ধামা
তারে ঘাঁটু দেবে জরির জামা
যে দেবে শুধু বকুনি।
ঘাঁটু দেবে তাকে খোস-চুলকানি।
বর্ধমান ও হুগলির অনেক গ্রামেই বয়স্করা একটি ঘেঁটুর দল বানিয়ে হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, বাঁশি সহযোগে ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তবে ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে এই সংস্কৃতি।
যারা ঘেঁটুপুজো করেন তারা বলেন এই ঘেঁটু বা ভাটফুল হল দেবতার প্রতিক। ভাটফুল বসন্তকালের একধরনের অনাদৃত ফুল। সাদা রঙের এই ফুলের ভিতরটা গাঢ় গোলাপী, পাতাগুলো খসখসে। ফুলের কয়েকটি সাদা কেশর বেরিয়ে থাকে। এই ফুল জমির আলের পাশে, ঝোপঝাড়ে বা বন বাদারে বসন্তকালে ফোটে। ঘেঁটুফুল গন্ধ ছড়ায় রাতে। সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে ঘেঁটু গাছ ও তার ফুলের ভেষজ গুণাগুণ মানব কল্যাণে বড় অবদান রেখেছে বহুকাল ধরে। পাতা ও মূল টিউমার ও কয়েক ধরনের চর্মরোগের বাহ্য প্রয়োগে উপকারী। পাতার রস ধারক, তিক্ত ও বলকারক। পাতা চিরতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। পাতার টাটকা রস ক্রিমিনাশক এবং বিশেষভাবে বাচ্চাদের ম্যালেরিয়া রোগে উপকারী। পাতা ও ফুল কাঁকড়া-বিছার কামড়ে উপকারী। খুব ক্ষিদের ভাব থাকলে, এমনকি অনেক খেয়েও পেট ভর্তি হলেও খাওয়ার রুচি কমে না, পেট বড় হয়ে যায়, চোখ কোঠারাগত হলে, শরীর দুর্বল হলে ও স্বভাবিক দৃষ্টি কমে গেলে ঘেঁটুর কচি পাতা ও মুল বেটে সকালে খেলে সুফল পাওয়া যায়।
বাচ্চারা রাতে বিছানায় প্রস্রাব করলে ও দিনে ঘনঘন প্রবল বেগে প্রস্রাব হওয়া থেকে ভালো রাখতে ঘেঁটুর পাতা ও মুলের রস কয়েক দিন ধরে খেলে বেশ উপকার দেয়। পোকামাকড় কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গে ঘেঁটুর পাতা বে্টে রস লাগালে অসহ্য যন্ত্রনা কমে। দীর্ঘ দিন ধরে শরীরে জ্বর লেগেই থাকলে,গেটবাতে ও আমাশয় ও পেট ব্যথায় ঘেঁটুর কচি ডগার রস কয়েকদিন সকলে খেলে ভালো হয়ে যায়। ঘেঁটুর রস তিতা বলে সহজে কেউ খেতে চায় না। অতএব দেখা যাচ্ছে, লোকায়ত ব্রতপালনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সময়োপযোগী চিকিৎসাবিদ্যার আদিরূপ।