বুধবার | ৪ঠা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন

রঞ্জন সেন / ৮৪ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ২ জুন, ২০২৫

আদিম মানুষ গুহার দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলেছিল তাদের জীবনযাপনের ছবি আর অভিজ্ঞতার বিবরণ। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে তা এখনও আমাদের অবাক করে চলেছে, দিচ্ছে নতুন ভাবনার রসদ। আজকের শহুরে দেওয়াল চিত্র বা গ্রাফিটি তারই উত্তরপুরুষ। শিকার-আহার-বংশবৃদ্ধির সময় পেরিয়ে সে ছবি ধরছে জীবনের জটিলতা আর বদলে যাওয়া সময়কে। গ্রাফিটি কখনও বা ব্যঙ্গে বিদ্ধ করছে মানুষকে, কখনও বা তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতের বিষয় সামাজিক অসঙ্গতি। গ্রাফিটি যেন আধুনিক শহরের এক অভিজ্ঞান। তার আয়নায় একটা গোটা শহরকে পড়ে নেওয়া যায়। দেখে নেওয়া যায় শহরের মুখ, এমনকি নিজেদেরও। সেই দৃষ্টিতে গুহাচিত্রের সরলতা নেই বরং রয়েছে আধুনিকতার অভিজ্ঞান।

শহরের দেওয়াল কখনও চিৎকার করে ওঠে, কখনও বা কথা বলে ফিসফিসিয়ে – আপনার আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বা তেরছা চোখে একঝলক তাকায়। সেই দৃষ্টিতে গুহাচিত্রের সরলতা নেই,বাম থেকে অতিবাম রাজনৈতিক ওয়ালিং এর স্পষ্ট ঘোষণাও সেখানে অনুপস্থিত। তা দেখতে হয় একটু খুঁটিয়ে, একটু মনোযোগ দিয়ে – তবেই পড়ে ফেলা যায় তার ভাষা। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আঁকা ছবিগুলির অর্থ তখন আস্তে আস্তে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা শহরের চলার ছন্দ, আশা-হতাশা, পতন-উত্থান সবকিছুই ধরা পড়ে গ্রাফিটিতে। দেওয়ালে জেগে থেকে সে হয়ে ওঠে শহরের একটা চরিত্র। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে যেতে সে বদলায়। শহরের উত্তরের গ্রাফিটি থেকে দক্ষিণের গ্রাফিটি আলাদা। দক্ষিণে রয়েছে বিমূর্ততা, উত্তরে সে অনেক সহজ সরল। বাগবাজারের দেওয়ালে দেখি “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে। দেখব এবার জগৎটাকে” কিংবা মাইকেলের “হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন” এর মত লাইন।

পায়ে পায়ে গ্রাফিটি

গ্রাফিটির সঙ্গে গ্রাম্যতার কোন সম্পর্ক নেই। এর চালচলন একেবারেই নাগরিক। গ্রাফিটি মানে শহর। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লির মত দেশের বড় শহরগুলিতে তা দেখা যায়। একদশক আগেও কলকাতায় গ্রাফিটি প্রায় ছিলনা বললেই চলে। এখন শহরের প্রায় সব জায়গাতেই তা দেখা যাচ্ছে। তবে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতাতে গ্রাফিটি বেশি, উত্তরে কম। মধ্য কলকাতার সদর স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, এলগিন রোড, দক্ষিণ কলকাতার লেক গার্ডেনস, গলফ গ্রিন, আলিপুর, খিদিরপুর, ভবানীপুর, মোমিনপুর, পূর্ব কলকাতার পার্ক সার্কাস, কুমোরটুলি, হাতিবাগান এমনকি সল্টলেকেও গ্রাফিটির দেখা পাচ্ছি আমরা।

খোলা আকাশের নিচে দেওয়াল চিত্র, তাই স্থায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই কম। আবার অনেক সময় দেওয়ালের মালিকদের পছন্দ না হওয়ায় তা মুছে দেওয়া হয়। মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার বেশ কয়েকটি বিখ্যাত স্কুল চত্বরের চারপাশে একসময় দারুণ কিছু গ্রাফিটি ছিল। এখন তার আর কিছুই প্রায় নেই, রঙ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় আবার পুরনো ছবি বদলে নতুন ছবি আঁকা হয়। তবে এভাবে গ্রাফিটি মোছা যায়না। মানুষের মনের অ্যালবামে স্থায়ী হয়ে থাকে তার তির্যক ব্যঙ্গ বা কোন অব্যবস্থার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ও প্রতিক্রিয়া।

গ্রাফিটির অন্দরে

চলার পথে এমন ছবি আপনারা অনেকেই দেখেন। অবাক হয়ে ভাবেন, কারা আঁকেন এমন ছবি!রাজনৈতিক দলের লোক তো নয়ই, কারণ তাদের আঁকার কায়দা এবং ছবিতে যেসব ঘোষণা তারা করেন তার সঙ্গে এই ছবির কোন মিলই নেই। আঁকার বিষয় ও আঙ্গিক একান্তই নাগরিক। গ্রাফিটি একটা শহরের নাগরিক মননের মাপকাঠি। শহরে খুব বেশিদিন এধরণের ছবি দেখা যাচ্ছে এমন নয়, এসব খুবই হালফিল সংযোজন।

শহরের গ্রাফিটির সেরা ঠিকানা হল মধ্য কলকাতার গ্রাফিটি লেন মানে মির্জা গালিব স্ট্রিট থেকে শুরু করে এম ডি ইশাক রোডের সরু রাস্তা। এই পথের দুদিকের দেওয়াল গ্রাফিটি শোভিত। এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। স্প্রে পেইন্ট দিয়ে আঁকা নানা ধরণের কিম্ভূত অবয়ব ও তাদের চোখমুখের উদ্ভট অভিব্যাক্তি। মাঝে মধ্যে ত্রিমাত্রিক লেখা, আপনি যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছেন। রঙ এত নিখুঁত যে মনে হয় গোটা দেওয়ালটায় যেন একটা ডিজিটাল প্রিন্টআউট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কোন উচ্চকোটির শিল্পরসিকদের গ্যালারি কিংবা ওয়ার্কশপ নয়, ব্যস্ত শহরে চলতে চলতেই আপনি যেন ঢুকে পড়েছেন এক প্রদর্শনীতে।

গ্রাফিটি সম্রাট

গ্রাফিটি নিয়ে আলোচনায় অনিবার্যভাবে আসবে ব্যাঙ্কসির কথা। তাকে এককথায় গ্রাফিটির সম্রাটও বলা চলে। আত্মপরিচয় গোপন রাখা এই শিল্পীর কাজ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ব্যাঙ্কসিকে চেনা যায় তার কাজ দিয়ে। স্প্রে পেইন্ট ও স্টেনসিলের ব্যবহার যাকে বলে তার সিগনেচার স্টাইল। উপস্থাপনার অভিনবত্বের সূত্রে ৯০ এর দশকের শেষ দিক থেকে তার জনপ্রিয়তার সূচনা। বোমা ছোড়ার ভঙ্গিতেই ব্যাঙ্কসির গ্রাফিটির চরিত্র ছুঁড়ে দেন ফুল। নাপাম বোমা বিধ্বস্ত ভিয়েতনামে আতঙ্কিত পলায়মান কিশোরীর দু’হাত তুলে ধরে সহাস্য বদনে দাঁড়িয়ে থাকে মিকি মাউস ও ডোনাল্ড ডাক। সে ব্যঙ্গ দেওয়াল থেকে উঠে এসে মানুষের মর্মে গিয়ে বেঁধে। তার ‘বেলুন উইথ আ গার্ল’ নামে আরেকটা গ্রাফিটিতে দেখি উড়ন্ত লাল বেলুনের দিকে তাকিয়ে আছে এক শিশু। ধন্ধে পড়ে যেতে হয়, বেলুন উড়ে যেতে দেখে সেকি দুঃখ পেয়েছে নাকি বেলুনের মুক্তিতেই তার আনন্দ?

প্রতিটি গ্রাফিটিতে সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ব্যাঙ্কসি। কিন্তু সে প্রতিবাদের কোন চিৎকার নেই। তার আঁকা চরিত্রগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায় চিত্রভাবনার স্বাতন্ত্র্য। ‘এস্কেপিং প্রিজনার ইন অ্যাট রিডিং প্রিজন’ তার একটা অন্যতম বিখ্যাত গ্রাফিটি। ইংল্যান্ডে এই রিডিং জেলেই বন্দী ছিলেন বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড।এটা সেই জেলের দেওয়ালেই আঁকা। তাতে দেখা যাচ্ছে কাপড় দিয়ে পাকানো দড়ির সাহায্যে জেল পালাচ্ছে এক বন্দী। দড়ির নিচে ঝুলছে একটা টাইপরাইটার। ছবি আঁকার সময় কি ব্যাঙ্কসি ভাবছিলেন কারারুদ্ধ অস্কার ওয়াইল্ডের কথা? মনে পড়ছে, ব্যাঙ্কসির ‘নেকেড ম্যান’ নামে গ্রাফিটি। ব্রিস্টলের পার্ক স্ট্রিটের এক যৌনচিকিৎসা কেন্দ্রের দেওয়ালে আঁকা এই গ্রাফিটিতে দেখা যাচ্ছে একহাতে বাড়ির জানলার কার্নিশ ধরে ঝুলছেন এক উলঙ্গ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে পালাতে গিয়ে তার এই দুরাবস্থা। বাড়িতে কেউ ঢুকেছিল কিনা তার খোঁজ নিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন এক ব্যাক্তি।তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক স্বল্পবাস রমণী। ব্যাঙ্কসি তার দর্শকদের অঙ্কনশৈলী ও উপস্থাপনার জাদুতে এভাবেই এক মুহূর্তের মধ্যে বন্দী করে ফেলেন। তার জনপ্রিয়তার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।

গ্রাফিটির বৈশিষ্ট্য

ত্রিমাত্রিক অঙ্কন এবং সামাজিক বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক শিল্পকলাই গ্রাফিটির বৈশিষ্ট্য। শহরের দেওয়ালকে তা ভাষা দেয়। কথা বলে তির্যক ব্যঙ্গ আর ক্রোধের ভাষায়। যে কথা আমরা কেউ বলতে পারিনি, হয়তো বলতে পারতামও না সেটাই আমাদের হয়ে বলে দেন গ্রাফিটি গেরিলারা। চমকে দেওয়া ছবি, মন্তব্য, উদ্ধৃতি এসবই গ্রাফিটির ভূষণ। চলতি সবকিছুকেই সে অন্য চোখে দেখে এবং মানুষকে দেখতে শেখায়। সামনে না এসেই গ্রাফিটি শিল্পীরা একাজ করে চলেন।

কখন আঁকেন তা বোঝা যায়না, আত্মপরিচয় দিতেও এদের প্রবল অনীহা। তাই বলে গ্রাফিটি শিল্পীদের সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষ বলে ভাববেন না। জীবনের সমস্যাগুলিতে এরাও আলোড়িত হন। কোভিডকালে মানুষকে সচেতন করতে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন লন্ডনের নাথান বাওয়েন এর মত গ্রাফিটি শিল্পীরা। নিজের সিগনেচার অঙ্কন শৈলীতেই তিনি লিখেছেন – WE CAN BEAT THIS TOGETHER – A BIG THANKS, সিস্টেম মানতে না চাওয়া এই শিল্পীরাই কোভিডের সময় পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে দেওয়ালে লিখেছেন – Stay home, stay safe ।পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে একই ভূমিকা পালন করেছেন গ্রাফিটি শিল্পীরা। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন গ্রাফিটি মানেই কোন জীবন বিচ্ছিন্ন বা জনবিরোধী ব্যাপার নয়, শুধু আলাদা এই শিল্পীদের দেখার চোখ ও তার উপস্থাপনা।

গ্রাফিটি গেরিলা

আমি জানি আপনাদের মনে এখন যে প্রশ্নটা আসছে, কারা আঁকেন এমন ছবি। সত্যি এটা একটা বড় প্রশ্ন। তার কারণ, এদের প্রায় কাউকেই প্রকাশ্যে আঁকতে দেখা যায়না। ছবি দেখেই মনে হয় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আঁকা হয়েছে এক দেওয়াল জোড়া ছবি। বেশিরভাগ আঁকাই হয় রাতে বা এমন কোন সময়ে যখন রাস্তায় লোক চলাচল খুবই কম। গ্রাফিটি শিল্পীরা নিজেদের অপরিচয়ের অন্ধকারে রেখে শিল্পকর্মকে তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী। আঁকাটা তাদের কাছে একটা নিজস্ব প্রতিবাদ। গ্রাফিটি শিল্পীদের ভাষায় ‘বম্বিং’। হ্যাঁ, প্রায় অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে রাতারাতি দেওয়াল ভরিয়ে ফেলাকে এই নামেই ডাকেন তারা। আঁকতে বেরোন প্রায় একটা বিশেষ মিশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিরুদ্ধে গ্রাফিটি যেন এক যুদ্ধ। অনেকেই মনে করেন এখন তেমন কোন কড়াকড়ি না থাকলেও, দেওয়ালে আঁকা এবং লেখা একসময় আইনত দণ্ডনীয় ছিল। বাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিকও তাদের দেওয়ালে এই আঁকা বরদাস্ত করতেন না। সেই আইন এখনও থাকলেও এই গোপনীয়তার বর্ম এখন অনেক শিথিল।

ছবি দেখলেই বোঝা যায় গ্রাফিটি শিল্পীদের কাজে একধরণের ক্ষিপ্রতা আছে। অবশ্য স্প্রে পেইন্ট দিয়ে যে পদ্ধতিতে এরা আঁকেন তাতে দ্রুত আঁকার একটা সুবিধা আছে। এটা শুধু ভারত বা কলকাতা নয়, সারা পৃথিবীর গ্রাফিটি শিল্পীদের একই রীতি। গ্রাফিটি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ব্যাঙ্কসি এই রীতিকে জনপ্রিয় করেন। গ্রাফিটি শিল্পীরা নিজেদের খুব একটা প্রকাশ্যে আনতে চান না। ছবির পাশে বড়জোর Srek, Shik, Shock, জাতীয় ছোট ছোট ডাকনামের বেশি আর কোন পরিচয় জানাতে চান না তারা।

গ্রাফিটি কি শিল্প

শুধু সাধারণ মানুষ নন, এনিয়ে দ্বিমত রয়েছে শিল্পী, শিল্প সমালোচক ও সমঝদারদের মধ্যেই। গ্রাফিটি নিয়ে গোঁড়ামি অবশ্য আগের তুলনায় এখন অনেক কম। গোটা বিশ্বে গ্রাফিটির জনপ্রিয়তা দেখে তা বোঝা যায়। তবুও এখনও কেউ কেউ একে উচ্চ পর্যায়ের শিল্প বলে মানতে রাজি নন। অনেকের মতে এটাকে বড়জোর একটা মাস আর্ট বলা যেতে পারে।কিন্তু কোন স্থায়ী শিল্প মূল্য এর নেই।

অনেকে একে শিল্প বলে মানতে রাজি নন আবার অনেকের মতে গ্রাফিটি অবশ্যই শিল্প। যে যাই বলুক, সারা পৃথিবী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পের সবচেয়ে বড় সমঝদার। বিদেশে গ্রাফিটিকে শিল্প বলেই ধরা হয়। আমেরিকা, লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, সুইডেনের মত শহরে গ্রাফিটি বেশ জনপ্রিয়। তরুণদের ভাবনার সঙ্গে গ্রাফিটির বাঁধনছাড়া অঙ্কনরীতি বেশ খাপ খেয়ে যায়।

গ্রাফিটি ও স্ট্রিট আর্ট

রাস্তায়-ফুটপাথে-দেওয়ালে রঙিন চক দিয়ে বা তুলি দিয়ে অনেকেই ছবি আঁকেন, সবই কি গ্রাফিটি? সাধারণ স্ট্রিট আর্টের সঙ্গে কি গ্রাফিটির কোন তফাৎ আছে? জটিল প্রশ্ন, আরও জটিল এর উত্তর। এককথায় বলতে গেলে এই তফাৎ খুব সূক্ষ্ম। গ্রাফিটি মূলত শিল্পীর ব্যাক্তিগত অনুভূতি বা অভিব্যাক্তির প্রকাশ। চলতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্পী চান তার কাজটা নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া হোক, তারা প্রশ্ন করুন। তা নিয়ে চরম বিতর্ক বা ঝগড়াঝাঁটিতেও তার কোন আপত্তি নেই। সাধারণ স্ট্রিট আর্টে তা হয়না। ফুটপাথে আঁকা কালীর ছবি দেখে লোকে প্রণাম করে চলে যায়। স্ট্রিট আর্ট বড়ই স্পষ্ট এবং সরল। তা দেখতে তেমন কোন চোখ লাগেনা। কিন্তু গ্রাফিটি বুঝতে লাগে একটা স্বাভাবিক শিল্পবোধ, একটা সচেতন মন।

গ্রাফিটির একটা নিজস্ব ভাষা আছে। তাকে ধীরে ধীরে চিনতে হয়। গ্রাফিটির সঙ্গে স্ট্রিট আর্টের আরেকটা বড় তফাৎ হল অঙ্কন শৈলীর তফাৎ। অনেক সময় বেআইনিভাবে বা গোপনে আঁকা কিংবা প্রতিবাদী চরিত্র এবং বিদ্রুপের তীব্রতার কারণে গ্রাফিটি অনেকের কাছে ভ্যান্ডালিজম। অন্যদিকে স্ট্রিট আর্ট কিন্তু মোটামুটিভাবে জনরুচির দাসত্ব করে। স্ট্রিট আর্ট ছবি নির্ভর কিন্তু গ্রাফিটিতে লেখা/মন্তব্য একটা বড় ব্যাপার। লেটারিং এর জোরে গ্রাফিটি চোখ টানে। গ্রাফিটি এবং স্ট্রিট আর্টের মধ্যে মিল একটিই – তা হল দুটোই আর্ট মুভমেন্ট।

বিশের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়ার সাবওয়েতেই আজকে আমরা যাকে গ্রাফিটি বলি সে ধরণের ছবির দেখা পেয়েছিল মানুষ। আঁকার শৈলী, প্রতিবাদের চিহ্ন সবমিলিয়ে আজকের গ্রাফিটির তারাই পূর্বপুরুষ এমনই বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বিশেষ অঙ্কন শৈলীতেই ছিল সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক। মানুষ বুঝতেন এ আঁকার জাত আলাদা। এ হল ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা। তা বলে গ্রাফিটি যে সামাজিক দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে এসেছে তা নয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন এটা একধরণের সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম।

মাদকাসক্তি, এইডস, লিঙ্গ বৈষম্য থেকে শুরু করে কোভিড অতিমারিও তাদের আঁকার বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে এই প্রতিবাদের ধরণেও তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য যে বজায় রেখেছেন সেটা তাদের কোভিডকালের গ্রাফিটিগুলি দেখলেই বোঝা যায়।

বদলেছে দেওয়াল

গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি অবধি যদি আমরা একটা সরলরেখা টানি তাহলে দেখবো সময়ের ধাক্কায় কীভাবে বদলে গেছে দেওয়াল চিত্র। ভারত, ইজিপ্ট, রোম, গ্রিসের গুহাচিত্রে ধরা পড়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের যৌথ জীবনের স্পন্দন। আজকের গ্রাফিটিতে দেখছি ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণা। সাধারণভাবে এই দুইয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও সবমিলিয়ে এটা মানুষ এবং শিল্পের একটা যাত্রা।

আমরা দেখছি কালের যাত্রায় আকার ও অন্তঃসারে কীভাবে বদলে গেছে ছবির বিষয়, শৈলী, রঙের ব্যবহার এবং আঁকার সময়। স্টুডিওর নিরাপদ বলয় থেকে বেরিয়ে আক্ষরিক অর্থেই রাজপথে নেমে এসেছেন শিল্পীরা। তার মধ্যেও তারা বজায় রেখেছেন নিজস্বতা। সময়ের ধাক্কা শিল্পীদেরও আলোড়িত করে। কিন্তু সেই অনুভূতির প্রকাশটা একেবারে নিজস্ব। আধুনিকতা তো এই নিজস্বতাকে স্বীকার করতে শেখায়। নিজেকে দেখাতেও শেখায়। একসময় অবাক হয়ে তাকালেও এখন দেওয়ালের গ্রাফিটি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেন মানুষ। গ্রাফিটির সঙ্গে মানুষের দূরত্ব কমছে, বলতে পারেন গ্রাফ বদলেছে গ্রাফিটির। শিল্প তো এভাবেই জীবনের কাছে আসে।

পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন