প্রকৃতি পুজো আর বৃক্ষবন্দনা ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত জনজাতির মধ্যেই প্রচলিত আছে। পৌষ মাসে ফসল কাটার নবান্ন উৎসব গ্রাম বাংলার হিন্দু মুসলমান সকলের কাছে একই মর্যাদায় পালিত হয়, আনন্দের “লবান”। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য ভারতের সমস্ত রাজ্যের বিভিন্ন পার্বণ রয়েছে। আসামের বিহু, পাঞ্জাবে বৈশাখ, বাংলায় হালখাতা— ১লা বৈশাখ বছর। কিন্তু নতুন বছরে গরমের সময়ে যাতে আমরা ভালো থাকি তার জন্য ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাজনের মত বেশ কিছ লৌকিক আচার রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম অঞ্চলে আদিবাসীদের বাদ দিয়ে কোন কথাই বলা যায় না।
বসন্তে শাল গাছের নতুন পাতা ও ফুলকে স্বাগত জানাতে নতুন বছরের শুভ কামনায় সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা, হো সবাই শাল গাছকে পুজো করে শাহরুল উৎসব পালন করে।
শীতের শেষে বসন্তকালে খোস পাঁচড়া একটা সাধারণ চর্মরোগ ছিল। খোস-পাঁচড়াকে নির্মূল করার জন্য একটা অনাড়ম্বর পুজো হল ঘেঁটু পুজো বা ঘন্টাকর্ণ পূজো। মূলত প্রান্তিক বাঙালী মানুষজন এই ঘেঁটু গাছটির পুঁজো করে আসছে ঘেঁটু ঠাকুর হিসেবে। লৌকিক দেবতা বলা যেতে পারে। ঘেঁটুর বৈজ্ঞানিক নাম ক্লেরোডেনড্রাম ইনফরচুনাটাম , বড় পাতা যুক্ত দেড় মিটার উচ্চতার গুল্ম, বসন্ত কালে হালকা গন্ধ যুক্ত সুন্দর সাদা ফুল ফোটে। পরে বীজটা যখন শুকিয়ে কালো বর্ণ ধারন করে যায় তখন বৃতির রং লাল হয়ে যায়। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে হওয়া একটি পরিচিত ঔষধি গাছ। আয়ুর্বেদ এর বহুবিধ ব্যবহার। পেট খারাপ, ক্রিমিনাশক, জ্বর নাশক, ম্যালেরিয়া, বিছার দংশনে ও খোস পাঁচড়ায় এর ব্যবহার আছে। জৈব পোকা নাশক হিসেবে ফসলের পোকা নিয়ন্ত্রনে পাতার রস জলে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়।
চৈত্র মাসের শেষ দিকে এই ঘেঁটু দেবতার আরাধনা করা হয়। সেই অর্থে কোন এর মূর্তি হয়না। আর এই পুজোতে কোন উপবীতধারী কোন ব্রাহ্মণ এর প্রয়োজন হয় না।গ্রামীণ পুরুষ-মহিলারা সবাই এই পূজো করতে পারে। উপকরণও এমন কিছু নয়। ঝুল কালিমাখা মাটির সরা/ পিতলের গামলা, তেল হলুদ চোবানো ছোট কাপড়, কয়েকটা কড়ি, তিনটে গোবরের তাল, ঘেঁটু ফুল, সিঁদুর ধান দূর্বা। নিকোনো মাটির দাবায় একটা মাটির সরা বসানো হয়। তার ওপরে তিনটে গোবরের পিণ্ড বসিয়ে দেওয়া হয় এবং তার ওপরে কড়ি, সিঁদুর, ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কোথাও কোথাও লক্ষী ও গনেশের মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হয়। উপরে ওই তেল হলুদ চোবানো বস্ত্রখণ্ড ঢাকা দেওয়া হয়। বাড়ির সামনের উঠোনে বা তিনমাথা রাস্তায় ধারে এটা রেখে বা ঘেঁটু ঠাকুর সাজিয়ে একটা কুলোতে প্রদীপ দিয়ে গান করে, ছড়া কেটে সন্ধ্যেবেলায় ২ এক দিন ভিক্ষা করে। গৃহস্থের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, আলু ও পয়সা এই সব পেয়ে থাকে। বিশেষ করে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই কাজে খুব আনন্দ পায়। এখনো হাওড়া জেলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এটা বেশ আনন্দ সহকারে পালন করা হয়।
পুজোর মন্ত্র বলতে ছড়া কেটে পুজো হয়। ঘেঁটু ঘেঁটু যায়, ঘেঁটু ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি/আস পাশ মূলোর হাড়ি/যে দিল ঘটি বাটি/তার হবে সাত বেটি/যে দেবে থালা থালা/তার হবে —/যে দেবে সরষের তেল/তার হবে সোনার দেল (দেওয়াল)। আরো কিছু ছড়া হল :—
“ধামা বাজা তোরা কুলো বাজা
এলো এলো দ্বারে ঘেঁটু রাজা।”
“ভাগ্যমানে কাটায় পুকুর চণ্ডালে কাটে মাটি
কুমোরের কলসী, কাঁসারির ঘটি
জল শুদ্ধ, স্থল শুদ্ধ, শুদ্ধ মহামায়া
হরিনাম করলে পরে শুদ্ধ হয় আপন কায়া।”
পুজোর শেষে অল্প বয়সী ছেলেরা বাঁশ দিয়ে মাটির হাড়ি/সরাটা টা ভেঙে দেয় তারপরে দৌড়ে পুকুরের জলে হাত পা ধুয়ে আসে যাতে তাদের চর্মরোগ না হয়। এখন কেই আর অত কিছু করে না। গামলাতো কেই ভাঙবে না। এরপর মহিলারা ওই বস্ত্রখণ্ডটি দিয়ে বাচ্চাদের চোখে মুখে বুলিয়ে দেন এবং সরার/গামলায় বাইরে কালি (আগে প্রদীপের আলোতে কালি করে নেওয়া হয়) কাজলের মত করে চোখে পরিয়ে দেন যাতে চোখ ভাল থাকে।