ছোটবেলায় যাত্রা দেখতে যেতাম। পাশাপাশি রামযাত্রা, নিমাইসন্ন্যাস, মনসামঙ্গল, কবিগানেরও আসর বসত। গ্রামের মানুষের কাছে এগুলি ছিল আনন্দ-বিনোদনের খোরাক। এখন এগুলি প্রায় দেখতে পাই না। কালের বিবর্তনে হারাচ্ছে। আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রামের মানুষ। সাত-আটের দশকেও এই সমস্ত আনন্দ-বিনোদনের অনুষ্ঠান পুরোদমে দেখেছেন পল্লী-গাঁয়ের মানুষ। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখন এসব তারা দেখতে পায় না।
যাত্রাপালা এখনও দেখতে পাওয়া যায় কিছু কিছু জায়গায়। তবে তাও আগের গরিমা হারাচ্ছে। এককথায় গ্রামবাংলা লৌকিক সংস্কৃতি হারাচ্ছে। বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ কারও নেই। দেখতাম, প্রায় প্রতিটি গ্রামের গাজনতলা, শিবতলা, কালীতলা, হরিসভা ইত্যাদি জায়গায় গ্রামের ছেলে-ছোকরারা নিজেরাই যাত্রার আসর বসাত। বড় করে যাত্রার আসর বসত ধান কাটার পর ন্যাড়া খেতে। কিংবা ফুটবলের মাঠে। সামাজিক, ঐতিহাসিক কিংবা পৌরাণিক যাত্রাপালা বেছে নেওয়া হত। সন্ধে হলে যাত্রাতলায় গিয়ে আসরের সামনে চাটাই, মাদুর কিংবা বস্তা পেতে রেখে আসতাম। বাড়ির রাতের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে মা-কাকীমারা যাত্রাতলায় হাজির হতেন। যাত্রার স্টেজ তখনও সাজানো হত। এখনও মনে আছে স্টেজের চার কোণে হ্যাজাক লাইট ঝুলত। কিংবা আর একটু অত্যাধুনিক আলো ঝোলানো থাকত। যাত্রাপালা শুরু হওয়ার পরই হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, কে কোথায় বসবে! এ নিয়ে বহুবার ঝগড়া-অশান্তি হয়েছে। কিন্তু যাত্রা থেমে যায়নি। আলাদা আনন্দ-অনুভূতির স্বাদ পেয়েছি। আজ সে সব গল্প!
শহরের কলোনি এলাকা কিংবা মফসসলের অলি-গলি, দালানেও যাত্রা-নাটক-লোকসংস্কৃতির প্রচলন ছিল। শহরের পেশাদার দল কিংবা ক্লাবের যুবকেরা মিলে যাত্রা কিংবা নাটক করত। এও দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ যাত্রাপালায় পুরুষ মহিলা সেজে অভিনয় করছেন। দিনমজুরের ঘরের ছেলে রাজা সেজেছেন, কিংবা জমিদার সেজে অভিনয় করছেন সাধারণ ঘরের ছেলে। একটা দিনের রাজা বা জমিদার হওয়া চরিত্র সারাজীবন গ্রামের মানুষজনের কাছে ‘রাজা’ কিংবা ‘জমিদারে’র তকমা পেয়ে যেতেন। এও দেখেছি, একটা শান্ত-ভদ্র ছেলেকে, যে কোনও দিন মিথ্যে কথা বলত না, সেই ছেলে ভিলেনের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করছে। দেখতে মজা পেতাম। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক- যে যাত্রাপালাই হোক না কেন, গ্রামের মানুষের কাছে আলাদা আনন্দ-অনুভূতি। যাত্রা দেখতে গিয়ে খালি পায়ে ধানজমির নাড়ার উপর বসেছি। ধানের নাড়ায় শরীরে কষ্ট দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যাত্রা দেখে সেই কষ্ট চাপা পড়েছে।
এমন দিনও গিয়েছে, ৩০ কিলোমিটার দূরে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কলকাতার যাত্রাদলের যাত্রা দেখতে গিয়েছি। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘মা মাটি মানুষ’, ‘শাঁখা দিও না ভেঙে’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘অচল পয়সা’, ‘মেঘনাদ বধ’, ‘মীরার বঁধুয়া’, ‘সোনাই দিঘি’, ‘আমি সুভাষ বলছি’, ‘বাদশা আলমগীর’, ‘ভগবানবাবু’, ‘এক পয়সার মা’, ইত্যাদি যাত্রাপালা দেখে নদীর পাড় হয়ে বাড়ি ফিরেছি। তার পরদিন সকালে বসে সেই যাত্রাপালার কাহিনি পাড়ার ছেলেদের বলেছি। আবার গ্রামের যুবকরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেরাই চাঁদা তুলে যাত্রা করত। যাত্রার স্ত্রী-চরিত্রের অভিনেত্রীদের ভাড়া করে আনা হত। তাদের টাকাও সকলে মিলে তুলে দিতে হত, তবুও যাত্রা বন্ধ হয়নি। সামাজিক যাত্রাপালা দেখতে দেখতে আমাদের ঘরের কথাই বার বার মনে হত। কখনও আপন মনে ভাবতে ভাবতে দু’চোখ ভরে জল চলে আসত। কত ঠাকুমা, মা-কাকীমাদের দেখেছি, পাড়ায় যাত্রা দেখতে দেখতে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে, আবার এও দেখেছি, দাদু-ঠাকুমাদের ফোকলা দাঁতের হাসি।
আর গ্রামের নববধূরা ঘোমটার আড়ালে একে অপরের সঙ্গে আনন্দ-দুঃখ ভাগ করছেন। এটা বেশ মনে আছে, রথের সময় শহরের যাত্রাপালা সংস্থাগুলির শুভ উদ্বোধন হত। আর দুর্গাপুজো এলেই সমারোহে জেলায় জেলায় যাত্রার বুকিং হত। সারা শীতকালটা ছাড়াও বসন্তের পুরো সময়টাও যাত্রাপালা চলত, আলু ওঠার মুখে গ্রামেগঞ্জে কিছু সম্পন্ন পরিবারের দু’হাতে টাকাপয়সা থাকত। এই সময়টা তাই যাত্রা হত। ব্রজেন দে, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশিরভাগ লেখা যাত্রা আজও মনে পড়ে। এছাড়া পাড়ায় পাড়ায় রামযাত্রা, নিমাই সন্ন্যাস, চণ্ডীমঙ্গল, তরজা গান, শীতলা গান, ধীবরের গান, মনসা গানের আসর বসত। এগুলি প্রায় সবই এখন বন্ধ। কেবল কোথাও কোথাও সামাজিক যাত্রাপালা টিকে আছে। তাতে প্রাণ নেই। আছে রাজনৈতিক ছোঁয়া। দেখতে যেতে ভাল লাগে না। তাই পুরানো দিনের যাত্রাপালা, কবিগানের কথা মনে পড়লে মনটা খারাপ হয়। পুরানো লোকসংস্কৃতি আর কি ফিরে আসবে না? যা থেকে গ্রামের মানুষ শিক্ষা পেতেন! রুচিবোধ, নৈতিকতা বোধ তৈরি হত মানুষের মনে। আজ সে সব হারাচ্ছে।