আজ থেকে একশো বছরেরও বেশী সময় আগে বাংলা ছিলো অন্যরকম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনও নোবেল পুরস্কার পান নি। বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে গড়ে উঠছে একের পর এক বিপ্লবী সমিতি। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্নভাবে গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছিলেন শরীরচর্চার উপর। স্বামীজি মারা যান ১৯০২ সালে। কিন্তু বীরসন্ন্যাসীর রেখে যাওয়া সেই মন্ত্র কোনোদিনও ভুলতে পারেনি বাংলা, ভুলতে পারেনি ভারত। বীরমন্ত্রে অবগাহন করে বাংলায় গুরুত্ব আরোপ করা হলো কুস্তি, মুগুরভাঁজার উপর। বিভিন্ন বিপ্লবী সমিতিতে ডন-কুস্তির আসর করা হলো বাধ্যতামূলক।
এমন সময় ১৯১৩ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বসলো জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগীতার আসর। লড়াইয়ে নামলেন “দ্য স্কট জায়ান্ট” খ্যাত জিমি এসন। আর তাঁর বিপক্ষে নামলেন বছর বাইশের এক বাঙালী — উচ্চতা ছয় ফুট এক ইঞ্চি, ওজন ১৩১ কেজি। “দ্য স্কট জায়ান্ট”-কে হারাতে মাত্র ৩৯ মিনিট লেগেছিলো সেই বাঙালীর। সেই শুরু। তারপর টানা চোদ্দ বছর ধরে সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াতে থাকলেন সেই বছর বাইশের বাঙালী আর তাঁর কুস্তির দল। আত্মবিস্মৃত বাঙালীর ইতিহাস থেকে আর এক ভুলে যাওয়া নাম, খেলাধুলোয় বাঙালীর প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন — যতীন্দ্রচরণ গুহ ওরফে গোবর গোহ।
চলুন, পৌঁছে যাই আরও আট বছর পর। সময়টা ১৯২১। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বাংলা উত্তাল। কুস্তি-চ্যাম্পিয়ন গোবর গোহের কীর্তি তাদের কতোটা প্রভাবিত করেছিলো এ বিষয়ে আমার পড়াশোনা যথেষ্ট কম, কিন্তু করেছিলো এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বাংলায় গজিয়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান কুস্তির আখড়া তার বড়ো প্রমাণ। শুধু যে গোবর গোহ তা নয়, ওনার একটা কুস্তির টিম ছিলো যার স্রষ্টা গোবর গোহ নিজেই। সেই টিমে ছিলেন ভারতবিখ্যাত সব কুস্তিগীরেরা — গুলাম মহম্মদ বকশ, ইমাম বকশ, গামা পালোয়ান, গামা পালোয়ানের ভাই, গামু এবং গোবর গোহ নিজে। অনেক আগে থেকেই এই কুস্তির দলটি গোটা বিশ্ব পরিক্রমা করে বেড়াতো। এই দলটির তৈরি হওয়া নিয়ে একটা অন্য ঘটনা আছে, সেটি পরে বলবো। এখন আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯২১ সালের ৩০শে আগস্ট সানফ্রানসিসকো। তাঁর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ হয় মার্কিন কুস্তি চ্যাম্পিয়ন এড স্যানটেলের (১৮৮৭–১৯৬৬)। তাঁর আসল নাম কিন্তু এডলফ আর্ন্সট (Adolf Ernst), জন্মসূত্রে জার্মান। এটি একটি বিখ্যাত যুদ্ধ। আয়োজক ছিলে কাউফম্যান নামে এক জার্মান। গোবর গোহ আর তাঁর দল গেলেন সেই আসরে। ফাইনালে মুখোমুখি অ্যাড স্যানটেল আর গোবর গোহ। দু ঘন্টার বেশী যুদ্ধ হয়। দুই রাউন্ডের এই যুদ্ধে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর স্যানটেল হার মানেন এই বাঙালীর কাছে। তখন স্যানটেল ছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তাঁকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেলেন গোবর — “The World Light Heavyweight Champion”। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম। এবং তিনি শেষ। তাঁর এই কীর্তি এখনো অক্ষত। এই জয়ে গুরুদোয়ারা থেকে সমর্থন করতে আসা পাঞ্জাবী দেশোয়ালি ভাইয়ারা আনন্দে উত্তাল হন। জনশ্রুতি — এরপর নাকি তাঁকে বারংবার তাঁদের কাছে শুনতে হয়েছিল, ‘আপ বঙ্গালী — কভি নেহি’!
এই ১৯২১ সালে আমেরিকায় তোলা গোবর গোহের একটি ছবি খুবই বিখ্যাত হয়। স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস পরে পোজ দিচ্ছেন একশো বছর আগেকার ভারতের বাঙালী সুপারস্টার আর চওড়া শরীরে শোভা পাচ্ছে ৫২ ইঞ্চির ছাতি। এহেন গোবর গোহকে নিয়ে শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই পরে গিয়েছিলো শোরগোল। দুটি ঘটনা তার প্রমাণ-
১৯২১ সালে আমেরিকায় এক মস্ত স্টোরি বেরোলো — “Invasion of ‘Hindu Menace’ breeds fear among meatmen”, অর্থাৎ ভারতীয় কুস্তিগিরের দাপটে শোনা যাচ্ছে থরহরি কম্প।
আরেকটি ঘটনা হলো প্রাক্তন মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের বিপক্ষে একবার মুখোমুখি হন গোবর গোহ। সেইসময় গোবর গোহের ভয়ে ভীত সবাই। মার্কিন নিউজসাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন গুজব। এই যেমন — গোবর গোহ নাকি খাবারের সাথে সোনা রূপা মিশিয়ে খান যাতে তাঁর শক্তি বাড়ে, তিনি নাকি শরীরচর্চা করতেন গলায় ১৬০ পাউন্ডের পাথর ঝুলিয়ে। কিন্তু প্রচারিত এইসব মিথের আড়ালে গোবর গোহের অভিনব এবং বৈজ্ঞানিক কুস্তির টেকনিকটাই যেনো হারিয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় গোবর গোহকে নিয়ে কলম ধরলেন এক মার্কিন যুবতী লোরি প্র্যাট, যিনি ছিলেন একজন কুস্তি বিশেষজ্ঞ। তিনি লেখেন — ‘গোবর কোনও ভাঁওতা নয়। শুধু সোনার গুঁড়োর খেল নয়। ওঁর আসল শক্তি শ্বাস নিয়ন্ত্রণে।’
এরপর লুইস আর গোবর গোহর মধ্যে যে খেলাটি হয়, সেখানে মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই লুইসকে পা টেনে ধরে আছড়ে ফেলেন গোবর গোহ। এই ম্যাচে গোবর গোহের পদ্ধতি ছিলো প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সিবিষ্কোর আবিষ্কৃত টো-হোল্ড প্যাঁচের চেয়েও অভিনব পদ্ধতি। এই সিবিষ্কোকেও কিন্তু হারতে হয়েছিলো গোবর গোহের কাছে।
এরকম একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের বংশপরিচয় যদি ঘাঁটা যায়, তবে দেখা যাবে কুস্তির প্যাঁচ রয়েছে গোবর গোহের জিনেই। ১৮৯১ সালের ১৩ই মার্চ, দোল পূর্ণিমার এক উৎসবমুখর দিনে ৬৫, মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে ভূমিষ্ঠ হন যতীন্দ্রচরণ গোহ ওরফে গোবর গোহ। বাবা রামচরণ গুহ ছিলেন কুস্তিগির। নিজের ছেলের আলসেমি দেখে রামচরণ গুহ নিজের ছেলেকে ডাকতেন গোবর বলে। সেই নাম কোনোদিনই মুছতে পারেনি ছেলে যতীন্দ্রচরণ। আর ‘গোবর গুহ’ নামটা সাহেবদের উচ্চারণে হয়ে গেলো ‘গোবর গোহ’। কে জানতো তখন, এই নাম বাইশ বছর পর গোটা বিশ্বের মুখে মুখে ঘুরবে আর একশো বছর পর ভুলে যাবে নিজেরই স্বজাতি — বাঙালী।
নয় বছর বয়সে দাদু অম্বিকাচরণ গুহের কাছ থেকে কুস্তিশিক্ষা শুরু গোবর গোহের। এরপর বাবা রামচরণ গুহ আর কাকা ক্ষেত্রচরণ গুহের কাছ থেকে কুস্তির শিক্ষা নেন। গোবর গোহকে ট্রেনিং দিতে অমৃতসর থেকে রহমানি পালোয়ানকে এনেছিলেন কাকা ক্ষেত্রচরণ। কাকার মৃত্যুর পর অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন গোবর। এইসময় পাশে পান শ্যালক শরৎকুমার মিত্রকে। শরৎকুমার মিত্র, গোবর গোহকে নিয়ে গিয়েছিলেন লাহোরে। সেইসময়ে লাহোরে বসেছিলো এক বিরাট কুস্তির আসর। “দ্য গ্রেট গামা” খ্যাত গুলাম মহম্মদ বকশের মুখোমুখি হয়েছিলো আরেক ভারতবিখ্যাত কুস্তিগির রহিম সুলতানিওয়ালা। গোবর গোহও দেখতে গিয়েছিলেন সেই ম্যাচ। এই ম্যাচটা দেখেই গোবর গোহের মাথায় পরিকল্পনা আসে, যদি ভারতের এই বিখ্যাত কুস্তিগিরদের নিয়ে একটা বিশ্বপরিক্রমা করা যায়, তবে কেমন হয়! করলেনও তাই। তৈরি করলেন ছয় জনের কুস্তির দল। যার মধ্যে থাকলেন দ্য গ্রেট গামা, গামা পালোয়ানের ভাই, ইমাম বকশ, আহমেদ বকশ, গামু এবং গোবর গোহ নিজে। এই ছয় জনের দল আস্তে আস্তে হয়ে উঠলো বিশ্বত্রাস, আর ১৯২১ এ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যান গোবর গোহ।
অবশ্য, ১৯২৭ সালে গোটা বিশ্ব জয় করে নিজ বাসভূমে ফিরে আসেন গোবর গোহ। আর তালিম দিতে থাকলেন ভবিষ্যতের গোবর গোহদের। কিন্তু কে জানতো, আর নব্বই বছর পরেই বাঙালীর প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তলিয়ে যাবেন বাঙালীর স্মৃতি থেকে …. ক্ষয়ে ক্ষয়ে সমতল হয়ে যাওয়া ভারতীয় ইতিহাসের চূড়া থেকে।
আমার স্ত্রী একবার বলেছিলেন, ইতিহাসের পাতা কখনই সীমাবদ্ধ হওয়া উচিৎ ছিলো না, ইতিহাসের পাতা হওয়া উচিত ছিলো এমন কিছু যার আদি-অন্ত কিছুই থাকবে না। না হলে, এতো এতো ইতিহাস বিজয়ীরা আঁটবে কিকরে সেখানে!
সত্যিই, আমরা পড়ে চলেছি দুই মলাটের মধ্যে জিরিয়ে থাকা কিছু পৃষ্ঠার রাশি, আর পৃষ্ঠার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো উদাসী গর্বের ঢেউ বলে চলেছে,”এর বাইরেও জগৎ আছে তোমরা জানো না”।
লুইস, জিমি, স্যান্টেল, সিবিষ্কোকে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া গোবর গোহ পারলেন কই আত্মবিস্মৃত জাতিটার স্মৃতিহীনতাকে টো-হোল্ডের প্যাঁচে কাবু করতে …. পারলেন কই!
তথ্যসূত্র : ১। ‘গোবরস্মরণে’ (সত্যেন্দ্রনাথ বসু), ২।আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩।’এই সময়’ পত্রিকা