২০০৪ সালে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর কালীভক্তি নিয়ে ওঠা বিতর্ক থেকে ২০১১-র নির্বাচনে আলিমুদ্দিন থেকে কালীঘাটে ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তন : পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসে যে সূক্ষ্মতম পরিবর্তন খানি ঘটেছিল তার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটল অনেক পরে। ২০১৬-র নির্বাচনের পরের সরকার যেমন ভদ্রলোক-পরবর্তি রাজনীতির সূত্রপাত ঘোষণা করেছিল, তেমনই পিছু পিছু এসেছিল হিন্দুত্বের রাজনীতি, যা প্রকাশ পায় ২০১৯ ও ২০২১-এর নির্বাচনে। সারা ভারতব্যাপী হিন্দুত্বের উত্থানের সাথে সাথে প্রান্তীয় মধ্যমপন্থী দলগুলির কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল যে পরম হিন্দুত্ব ও চরম বামপন্থার দুই কৌণিক দুরত্বের আদর্শগত দ্বিমেরুতার মাঝে দোদুল্যমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধারণাটি নিয়ে। বেশ কয়েক বছর থেকে অরবিন্দ কেজরীওয়াল, রাহুল গান্ধি-সহ বহু বিরোধী নেতৃবৃন্দের মধ্যেই তথাকথিত ধর্ম ও রাজনীতির মেলবন্ধনের যে চেষ্টা দেখা গেছে তা আসলে এই আদর্শগত দ্বিমেরুতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা; কারণ শুধু ভোট রাজনীতি বললে তার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। তবে, এক্ষেত্রে ভয় থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে পড়ার। পশ্চিমবঙ্গের বাম-পরবর্তী রাজনীতিতে প্রাত্যহিক ধর্মাচার ও রাজনৈতিক জীবন দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে এই জটিলতাটিকে। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির প্রধান সমস্যা ছিল হিন্দুপ্রধান জনসংখ্যার মধ্যে থেকে দলীয় আদর্শগত ‘ধর্ম’ ও ‘রাজনীতি’-র মধ্যে দুরত্ব বজায় রাখা, বিশেষ করে যেখানে নিজের নেতৃবৃন্দ পরোক্ষভাবে ও সমর্থকদের মধ্যের বড় একটি অংশ সারাসরি প্রাত্যহিক জীবনে পারম্পরিক ধর্মাচারের থেকে কোন দূরত্ব রাখেনি। বাম-পরবর্তী সময়ে সরকার-কর্তৃক সম্প্রদায়-নির্বিশেষে দৈনন্দিন ধর্মাচারে রাজনৈতিক সাহায্য, পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রথা থেকে সরে আসার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তা অভিনব। দেখার মত বিষয় হল যে দুই পক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক আদর্শে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র কথা বলেছে, কিন্তু দুপক্ষের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন।
আশীষ নন্দীর ‘Anti-Secularist Manifesto’-র মতে, রাজনীতিকে ধর্মবিযুক্ত করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণা পশ্চিমি, যেখানে গান্ধীর ন্যায় রাজনীতির মধ্যে সকল ধর্মের সম্মানজনক সহাবস্থানের ধারণা প্রাচ্যদেশীয়। নন্দীর বক্তব্যানুসারে, অশোক বা আকবরের নিরপেক্ষতার নীতি কখনো লেনিন বা নেহেরুর মতো অবিশ্বাসীর মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত ছিলনা, বরং তাঁদের নিজ নিজ ধর্মাচারের মধ্যেই সহাবস্থানের ধারণা ছিল। মূলগত পরম্পরার স্তরে ‘ধর্ম’ মূলত সংশ্লেষাত্মক; যা অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইউরোপে যে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধ শেষ পর্যন্ত যে বিযুক্তিসাধন করে, তা ভারতে কখনো ঘটেনি। দুয়েকটি বাদে প্রায় সকল ভারতীয় ধর্মসমূহ আচরণের স্তরে; প্রাতিষ্ঠানিক উপরিকাঠামোর ভার কম। ঐতিহাসিক ভ্যান ডর ভিরের (Peter Van der Veer) মতে, — ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পশ্চিমি ধর্মবিযুক্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র আমদানী করে ভারতীয়দের রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করল এবং তারই ফলস্বরূপ ‘ধর্ম’ সামূহিক পরিচিতির গ্রন্থিত রূপ হয়ে ফেরত এলো। এটিই ভারতে ‘ধর্ম’ ও ‘রাজনীতি’-র সমন্বয়তন্ত্রী অতীত থেকে বিচ্ছিন্নতার সময়, যা গান্ধিও জোড়া লাগাতে পারেননি। বিদেশি চেতনার সমস্যাই হল তার অর্থগুলি বিদেশ থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে আসে; দেশিয় বাস্তবতার সাথে মিশে দিনে দিনে সে যে কত নতুন অর্থ আধিগ্রহন করে তা কখনো পূর্বকল্পিত সংজ্ঞায় ধরা পরেনা। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির আভ্যন্তরীণ বহুস্বর, ‘Secularism’-এর মধ্যে প্রকাশ পায়না।
সাম্প্রতিক কালে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র সমচ্চারিত ভিন্নার্থকতারূপ বিতর্কটি আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। বলাইবাহুল্য দুপক্ষই রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণাটি নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যপন্থার দুই দিক থেকে ভাবছে। অবশ্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র এই পারস্পরিক বিরোধ বঙ্গের কলেজ চত্বরে নতুন নয়। ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন সিটি কলেজে সরস্বতী পূজা নিয়ে গোল বেঁধেছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের মাঝে। ১৯২৮ সালে, ৫০ বৎসরপূর্তি উপলক্ষে ছাত্ররা সরস্বতী পূজো করতে চাইলে ব্রাহ্মমতাদর্শি কলেজ কর্তৃপক্ষ অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্রের নেতৃত্বে বাধা দেন। সুভাষচন্দ্র সহ নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের পক্ষে ও রবীন্দ্রনাথ-সহ ব্রাহ্ম ব্যক্তিবর্গ ছাত্রদের বিপক্ষে আসরে নামলে বিষয়টি সে সময়ের অন্যতম চর্চিত বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯২০-এর দশকে চিত্তরঞ্জনের পরই অন্যতম তরুণ নেতা হিসাবে উঠে আসা সুভাষচন্দ্র ১৯২৫ সালে বহরমপুর জেলে সরস্বতী পূজো করতে জেল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাই ব্রাহ্ম অপৌত্তলিক চত্বরে বাগদেবীর আরাধনার প্রকল্পে সুভাষচন্দ্রের উৎসাহ ছিল স্বাভাবিক। স্বভাববিরুদ্ধ ঠেকেছিল রবীন্দ্রনাথের বিরোধীতা, যার মূল কারণ অবশ্যই তাঁর পৌত্তলিকতার বিরোধীতা। তাঁর ভয় ‘ধর্ম’ নয়, বরং ‘ধর্মতন্ত্র’-এর; যেখানে ব্রাহ্ম সংখ্যালঘুত্ব ‘হিন্দুয়ানী’-র বাড়বারন্তে পীড়িত। সুভাষের কাছে ব্রাহ্মরা হিন্দুধর্মের বাইরে নয়। রবীন্দ্রনাথের আক্রমণের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বক্তৃতায় যে কথা বলেন তাতে বর্তমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র তাত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু আলোকসন্ধান পাওয়া যায়। অ্যালবার্ট হলের বক্তৃতায় সুভাষ বললেন, — ‘প্রত্যেকের অধিকার স্বীকার করিয়া লইয়া তবে মীমাংসা ও সমন্বয় করিতে হইবে’। যদিও সে মীমাংসা বা সমন্বয়, কোনটাই হয়নি, কারণ শেষ পর্যন্ত পূজো হয়নি। তাবলে সুভাষের সরস্বতী পূজার চেষ্টা তাঁকে হিন্দুত্ববাদী করে দেয়না। ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টেই চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ চাকুরিক্ষেত্রে মুসলিম সংরক্ষণের কথা ভেবেছিলেন। তবে সুভাষের উদাহরণটি রাজনীতির মধ্যে সকল ধর্মের সম্মানজনক সহাবস্থানের ধারণাটির বঙ্গীয় ঐতিহ্যের কথাই বলে। পারস্পরিক সম্মানজনক সহাবস্থানের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই কি চল্লিশের কলিকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে কলিকাতা মুসলিম লিগের সাথে চুক্তি করেন? লাহোর প্রস্তাব প্রসঙ্গে জিন্নাহ-কংগ্রেস মৈত্রীর চেষ্টা করেন? অনেকে, এমনকি জাতীয়তাবাদী মুসলমান চিন্তকেরাও এই পদক্ষেপকে সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ বলে মনে করেছিল। মুসলমান জাতীয়তাবাদী নেতা আবুল মনসুর আহমেদ অনুযোগ জানালে, সুভাষ বলেছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যর জন্য যেহেতু জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ব্যর্থ, মুসলিম লিগ ছাড়া উপায় নেই। ১৯২০-এর দশকের সুভাষ ১৯৪০-এর দশকের সুভাষ থেকে অনেকখানি আলাদা একথা মাথায় রেখেই বলা যায় যে ধর্ম ব্যতিরেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র কথা সুভাষ ভাবেননি; হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থেই ভাবেননি। গান্ধিও ভাবেননি। তাতে সমস্যা কমেছে কিনা বলা মুশকিল, কারণ তারপরও সাম্প্রদায়িকতা থামেনি।
অবশ্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র কথা রাজনৈতিক পাব্লিক স্ফিয়ারে যে ব্যাখ্যানেই আলোচিত হোক না কেন, তা কি কখনো ভারতীয় পরম্পরানির্ভর সমাজের প্রাক-ঔপনিবেশিক সমন্বয়বাদকে ছুঁতে পেরেছে? চাকা যেমন পিছন দিকে ঘোরে না, তেমনই মাড়িয়ে আসা পথের ধুলো তাতে লেগেও থাকে। এখানে সরস্বতী পূজো নিয়ে সুভাষ-রবীন্দ্রনাথের তরজার থেকেও বড় হয়ে ওঠে অন্য এক পূজোর গল্প। একবার সরস্বতী পূজোর দিনে এক উপবাসী বালিকার কথা ভেবে এবং অবিভাবককে নিজের পরিচয় না দিয়ে, সৈয়দ মুজতবা আলী সংস্কৃত মন্ত্রে বাগদেবীর উপাসনা করেছিলেন। পূজো সেরে ফেরার পথে আলীর স্বগতক্তি যে উপোসী শিশুর কথা ভেবে মা সরস্বতী বিধর্মীর পূজোয় অসন্তুষ্ট হবেন না; এই বোধ কি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র সংজ্ঞায় ধরা যায়! আলীর উদাহরণটি প্রাক-ঔপনিবেশিক সমন্বয়বাদের বহুস্বরীয় বহমানতাকেই দেখায়, যা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র নৈর্ব্যক্তিক একস্বরের তলায় চিরন্তনী ফল্গুধারার ন্যায় বয়ে চলে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র একস্বরীয় ভাষ্য যেমন কোন কোন ক্ষেত্রে ‘Irreligious’, তেমনই ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতাবোধক। বছরখানেক আগে ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির মুখপাত্র নবাব মালিক বলেছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র নামে পারস্পরিক ধর্মের গণ্ডী ভাঙলে চলবে না। কিন্তু আলীর সংস্কৃত মন্ত্রে বাগদেবীর উপাসনা তো গণ্ডীভঙ্গেরই স্বরূপ। আসলে সমস্যা হল কেউ কেউ যেটিকে প্রাচীর ভেবেছেন এবং তা টিকিয়ে রাখাকেই সহাবস্থান ভাবছেন, সাধারণ মানুষের আচারের জগতে বেশীরভাগ সময়েই তা মিলনরেখা মাত্র। পরম্পরাগত জগতে বহুস্বরীয় ‘ধর্ম’ সমন্বয়মাত্রিক; তা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ন্যায় স্পর্শকাতর নয়। পরম্পরার ফল্গুধারাকে অস্বীকার করে ‘ধর্ম’-এর একমাত্রিকতা যতখানি মৌলবাদী স্বরূপ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র বহুস্বরীয় ভারতীয়ত্বকে ত্যাগ করাও ততখানিই রক্ষনশীলতা। ‘Irreligious’ রক্ষনশীলতা পক্ষান্তরে বিপ্রতীপকোনে উগ্র ধর্মান্ধতারই জন্ম দেয়। সমস্যা হল ঔপনিবেশিকতার ফসল ভদ্রবিত্ত পরম্পরার এই সহজ সত্যটি বুঝল না।