শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, তবে শিক্ষককে বলা হবে শিক্ষার মেরুদণ্ড। শিক্ষক হলেন ন্যায়নীতি ও আদর্শের প্রতীক। এমনই এক শিক্ষক আরামবাগের বুকে নীরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। ১৯৯৬ সালে কর্মজীবনের পথচলা শুরু। যা আজও থেমে নেই। এই শিক্ষক এখন সমাজের চোখে ‘রিভার মুন’ নামে পরিচিত। আসল নাম নদীয়া চাঁদ মুর্মু। তাঁর মননে ধ্যানজ্ঞান হল ছাত্রছাত্রীদের সেবা। স্কুল হল মন্দির। আর সমাজের সকল মানুষ তাঁর কাছে দেবতা। এসব নিয়ে আনন্দে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেছেন। দুঃস্থ অসহায় ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে পড়াশোনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া, আবার স্কুলছুটদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফেরানোর আনন্দের তাগিদ অনুভব করেন। এখানেই শেষ নয়, স্কুলের টেবিল, বেঞ্চ, চেয়ার ভেঙে গেলে নিজেই তখন শিক্ষক থেকে কাঠমিস্ত্রি হয়ে যান। আবার এও দেখা যায় স্কুলের সামনে কিম্বা গ্ৰামের ভাঙাচোরা রাস্তা সারানোর কাজে দিনমজুরের রূপ। কেবল স্কুল নয়, আশেপাশের গ্ৰামের সকলের কাছে একটাই পরিচয় সত্যিকারের একজন আদর্শ শিক্ষক। সমাজের চোখে তিনি ‘সর্ব ঘটের কাঁঠালি কলা’।
প্রসঙ্গত, স্কুলই তাঁর প্রাণ, তাঁর আনন্দ। এই নিয়েই বেঁচে থাকতে চান আরামবাগের পুড়া উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক নদীয়াচাঁদ মুর্মু। নিজে দিন মজুরের ছেলে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন। অনাথ, দুঃস্থ কিংবা স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের খুঁজে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসাই তাঁর কাজ। শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে এবং ওই সমস্ত ছেলেমেয়েদের যুক্ত করে তিনি আনন্দ পান। ১৯৯৬ সালের ২৬ জুন যেদিন পুড়া হাই স্কুলে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছেন, সেদিন থেকেই দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু করতে তাঁর মন ব্যাকুল।
বাঁকুড়ার খাতড়া মহকুমার ঝারি গ্রামের সাঁওতাল পরিবারে জন্ম নদীয়াচাঁদের। সারাদিন গোরু চরাতেন। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে অ আ বই নিয়ে বসতেন। শ্লেট, পেনসিল ছিল না। বালির চরে বসে নিরক্ষর থেকে সাক্ষর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বালি আর হাতের আঙুল দিয়ে লেখা শিখেছিলেন। অতীতের সেই দিনগুলির কথা নদীয়াচাঁদ ভুলে যাননি। তাই শিক্ষক হয়েই তিনি দুঃস্থ, অনাথদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেবল বই কিনে দেওয়া নয়, ছাত্র ভরতি করার জন্য আজও নিজের পকেট থেকে অনায়াসে টাকা বের করে দেন। তাই সাতমাসা গ্রামের নূর আলম, মিঠু হালদার, পুড়া গ্রামের শমিতা মণ্ডল, কিসমত খেদাইলের নিবেদিতা মালিক, নারায়ণপুর গ্রামের মেধাবী ছাত্র মানস খাঁটি, শিবশংকর দাস আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত। এরা কেউ দুঃস্থ, কেউ বা অনাথ। কেউ কেউ অর্থের জন্য সোনা বা জরির কাজে লেগে গিয়েছিল। তাদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে এনেছেন। এখানেই তিনি থেমে নেই। সমাজের বিধবা থেকে শুরু করে দুঃস্থ অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন।
মাতৃভাষা সাঁওতালি হলেও সুন্দর বাংলা বলেন নদীয়াচাঁদ। তিনি বলেন, কর্মের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা– এই তত্ত্বেই বিশ্বাস করি। তাই যে সব ছেলেমেয়ের কেউ নেই, নিরক্ষর কিংবা অর্থের অভাবে পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের পাশে সর্বদা থাকতে ভালোবাসি। কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই।
উল্লেখ্য, শারীরশিক্ষার শিক্ষক নদীয়াচাঁদ যখন নিজেই স্কুলে কোদাল, শাবল, করাত, হাতুড়ি কিনে আনেন তখন সবাই অবাক হন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই রাস্তায় গর্ত বোজান। স্কুলের ভাঙা বেঞ্চি নিজেই সারান। এ দেখে স্কুলের শিক্ষক থেকে সকল মানুষ অবাক হন। আদর্শ শিক্ষকের সংজ্ঞা জানা নেই এই আদিবাসী শিক্ষকের। ভালোবাসেন গান করতে, নাটক লিখতে। ইতিমধ্যেই লিখেছেন দু’খানি জনপ্রিয় সাঁওতালি নাটক। ‘সহাগ দু-লাড়’ এবং ‘মালিন চাম্পা’। নিজে অভিনয় করেন, গান করেন। খেলার মাঠেও দেখা যায়। তাই গ্রামাঞ্চলের আদিবাসী মানুষ তাঁকে ‘রিভার মুন’ বলে ডাকেন। আর আরামবাগের মানুষ বলেন, ‘কাজ পাগল শিক্ষক’।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সহশিক্ষকরা জানান, অনেক আগে থেকে নদীয়াবাবু এসেছেন। উনি কাজকে ভালোবাসেন। নিয়মিত স্কুলে আসার পাশাপাশি নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ানোর দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে নদীয়া চাঁদ কেবল শিক্ষক নন। উপযুক্ত একজন অভিভাবক ও বন্ধুও বটে। দুঃখের বিষয় চাঁদের কপালে এখনও ‘শিক্ষারত্ন’ জোটেনি।
I am proud of your works