জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণামে গরম আর এখন ক্যালেন্ডার মানে না। ইন্ডিয়ান মেটেরিয়োলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি) আগেই জানিয়েছে এ বছর গরমের অনুভব হবে দ্রুত ও দীর্ঘায়িত। দুপুর হলেই কার্যত আগুন ঝরাচ্ছে সূর্য। আর এই পরিবেশেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে তালগাছ সূর্যের তাপ শোষণ করলেও এর কচিতালের শাঁস কিন্তু বেশ রসালো ঠান্ডা ও তৃপ্তিদায়ক। এমন গরমে আমের জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাদা তুলতুলে রসালো তালশাঁসের চাহিদাও। রাস্তার ধারে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে তালশাঁস। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন তালশাঁসের গুনাগুনও রয়েছে যথেষ্ট। গরমে এই ফল যথেষ্ট উপকারীও বটে।
গ্রীষ্মকাল এলেই আমরা এই ফলের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। বছরে একবারই গরমের সময় তালশাস মেলে। কাঁচা তালের মধ্যে থাকা সুস্বাদু নরম জলীয় অংশটি তালশাঁস নামে খ্যাত।সাধারণত তালশাঁস নরম,হালকা নরম বা একটু শক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে। কেউ নরম শাঁস খেতে পছন্দ করেন, কেউ আবার একটু শক্ত তাল শাঁস খেতে পছন্দ করেন। পুষ্টিবিদরা বলেন তালশাঁসে প্রচুর জল (প্রায় ৮৫ শতাংশ) থাকে। তাছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফাইবার ভিটামিন মিনারেল জিংক ফসফরাস পটাশিয়াম পাওয়া যায়। এর মধ্যে সোডিয়াম কন্টেন্ট অনেকটাই কম, ফলে যারা হাইবিপি সমস্যায় ভুগছেন তারা এই ফলটি খেতে পারেন। গরমে পেট ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। অত্যাধিক দাবদহে অনেকটা ওআরএস-এর মত কাজ করে। মুখের রুচি ফেরাতে এই ফলটি যথেষ্ট উপকারি। একসঙ্গে দুর করে বমি বমি ভাবও।
ইংরেজিতে অনেক নামে ডাকা হয় এই ফলকে। তালশাঁসের সর্বাধিক প্রচলিত ইংরেজি হল আইস অ্যাপল (ice apple) এবং ওয়াইন পাম (wine palm)। এছাড়াও ডাউব পাম (doub palm), পালমাইরা পাম (palmyra palm), ট্যালা পাম (tala palm) এবং টডি পাম (toddy palm) নামেও পরিচিত এই সুশীতল ফল। এটি মহারাষ্ট্রে “তাদগোলা”, তামিলনাড়ুতে “নুঙ্গু” এবং গুজরাটে “তারি” নামেও পরিচিত।
তালশাঁসে রয়েছে
ভিটামিন : এতে বিভিন্ন ভিটামিন রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, যা শক্তি বিপাক এবং কোষের কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভিটামিন সি, একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। লিভারের সমস্যা থাকলেও পরিমিত মাত্রায় খাওয়া যেতে পারে। এটি লিভারকে ডিটক্স করতে সাহায্য করে। অ্যানিমিয়ার সমস্যা থাকলে তালশাঁস খুব উপকারী।
খনিজ পদার্থ : পটাশিয়ামের মতো খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ, যা সুস্থ রক্তচাপ এবং তরল ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, ফসফরাস এবং আয়রনের মতো অন্যান্য খনিজ পদার্থও সরবরাহ করে। গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব থাকলে এই ফল উপকারি ক্যালসিয়াম থাকার কারণে এটি হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে। তবে যারা ব্লাড থিনার ওষুধ খান, তাদের তালশাঁস না খাওয়াই ভালো।
ফাইবার : খাদ্যতালিকাগত ফাইবারের একটি ভালো উৎস, যা হজমশক্তি বাড়ায় । এটি একটি লো-ক্যালরি ফুড যাতে প্রচুর পরিমাণে জল ও ফাইবার থাকে ফলে পেট ভরানোর জন্যও কার্যকরী। আঁশ সমৃদ্ধ তালশাঁস পেটের বিভিন্ন সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট : এতে ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক যৌগ সহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মুক্ত র্যাডিকেলের কারণে কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
উপকারিতা :
তরমুজের মতো তালশাঁসে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে, তাই এটি প্রচণ্ড গরমের সেরা ফল। এগুলি শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এর হাইড্রেটিং বৈশিষ্ট্যগুলি শরীরে হারিয়ে যাওয়া তরল পূরণ করতে সাহায্য করে, আপনাকে সতেজ রাখে এবং জলশূন্যতা প্রতিরোধ করে।
শক্তির মাত্রা বাড়ায় : তালশাঁস প্রাকৃতিক শর্করা, প্রধানত ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ, দ্রুত এবং স্বাস্থ্যকর শক্তির উৎস প্রদান করে, যা ক্লান্তি মোকাবেলা বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপের পরে শক্তি পুনরায় পূরণের জন্য একটি চমৎকার খাবার।
ফাইবারের পরিমাণ : তালশাঁসের ফাইবার স্বাস্থ্যকর হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি উপকারী অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকেও পুষ্ট করে।
কোলেস্টেরল কমায় : তালশাঁসের ফাইবার এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে : তালশাঁসের পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, উচ্চ রক্তচাপ এবং এর সাথে সম্পর্কিত জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সুরক্ষা : তালশাঁসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীগুলিকে মুক্ত র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে :
তালশাঁসে তুলনামূলকভাবে কম ক্যালোরি এবং উচ্চ ফাইবার থাকে, যা পেট ভরা অনুভূতি জাগায় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সহায়তা করে।
ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো :
তালশাঁসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অকাল বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ, আপনার ত্বককে হাইড্রেট করে, ব্রণ কমায় এবং আপনাকে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা পেতে সাহায্য করে। ত্বক উজ্জ্বল করতে আপনার খাদ্যতালিকায় তালশাঁস যোগ করুন। আপনি রোদে পোড়া এবং ফুসকুড়ি প্রশমিত করতে সরাসরি ত্বকে তালশাঁসের পাল্প লাগাতে পারেন।
প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব : তালশাঁসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য যৌগগুলিতে প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সারা শরীরে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: অনেকেরই কুসংস্কার আছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা পাকা তালের রস এবং এর শাঁস খেতে পারবেন না।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তালের শাঁস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে কারণ এর ফাইবার উপাদান এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি ফাইটোনিট্রিয়েন্টস, কার্বোহাইড্রেট এবং ক্যালসিয়ামের পাওয়ার হাউস। তাই অল্প পরিমানে খাওয়া যায় এটি।
আলসার-বিরোধী বৈশিষ্ট্য : কিছু ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার থেকে জানা যায় যে , এটি পেটের আলসার থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
লিভারের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তালশাঁস হেপাটোপ্রোটেক্টিভ (লিভার-সুরক্ষাকারী) বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, তবে এই ক্ষেত্রে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
সতর্কতা :
তালশাঁস নিঃসন্দেহে উপকারী একটি ফল তবে যে কোন জিনিস অতিরিক্ত খাওয়ায় অনেক রকমের সমস্যা হতে পারে যেমন অতিরিক্ত তালশাঁস খেলে বিশেষ করে শক্ত তালশার পেট গরম পেট ব্যথা বমি বমি সমস্যা দেখা যেতে পারে।
যাদের কিডনির সমস্যা আছে তাদের তালশাঁস খেলে পটাশিয়াম বেড়ে যেতে পারে তাই অবশ্যই কিডনি রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তবেই খাবেন।
যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের এটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
অত্যধিক তালশাঁস খেলে পেটে ব্যথা হতে পারে তাই যে কোন খাবার খান পরিমিত।
বিশেষ করে রাস্তা থেকে কিনেই মুখে পুরে দেবেন না। ভালোভাবে পরিস্কার করে তবেই খাবেন।
তালশাঁসকে বিভিন্ন উপায়ে উপভোগ করা যায়। আপনার খাবারে এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এখানে কিছু সহজ টিপস দেওয়া হল : —
সতেজ খাবার হিসেবে : ফলের খোসা ছাড়িয়ে জলখাবার হিসেবে খেতে পারেন।
স্মুদিতে যোগ করুন : একটি সতেজ এবং পুষ্টিকর স্মুদির জন্য কলা এবং আমের মতো অন্যান্য ফলের সাথে তালশাঁস মিশিয়ে নিন।
ফলের সালাদের সাথে মিশিয়ে নিন : তরমুজ, আনারস এবং পেঁপে সহ অন্যান্য গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফলের সালাডের সাথে তালশাঁস মিশিয়ে নিন।
এছাড়াও, এই গরমে ঘরে বানিয়ে নিতে পারেন তালশাঁসের লস্যি, জলভরা তালশাঁস, তালশাঁসের অমৃতপাক, তালশাঁসের লাচ্ছি, ক্ষীর, পায়েস কিম্বা সেক। রেসিপিগুলো দিলাম না google এ সার্চ করলেই দেখিয়ে দেবে। এই গরমে অতিথি এলে সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশন করুন আইস কিউব যুক্ত এক গ্লাস ভর্তি কচি তাল শাঁসের শরবত। বিশ্বাস করুন এত সহজে বানিয়ে নেওয়া যায় এবং এতটাই সুস্বাদু যে না খেলে বিশ্বাস করবেন না।
জেলা জুড়ে পড়েছে তীব্র গরম। সংখ্যা ও তীব্রতা হিসেবে তাপপ্রবাহ বাড়লেও কিন্তু জনজীবন থেমে থাকার নয়। এই সময় যারা বাইরে ঘোরাঘুরি কাজে ব্যস্ত থাকেন তাদের আইসক্রিমের বদলে তালশাঁস খাওয়া একান্ত জরুরী।
হাইড্রেশন থেকে শুরু করে উন্নত হজম এবং ত্বকের স্বাস্থ্য, গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা থাকার জন্য যারা প্রাকৃতিক উপায় খুঁজছেন এমন লোকেদের জন্য এটি উপযুক্ত। তবে, যেকোনো খাবারের মতো, কোনও প্রতিকূল প্রভাব ছাড়াই এর উপকারিতা সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করার জন্য পরিমিত খাবারই মূল চাবিকাঠি।