১৩৪৮ সনের শ্রাবণ মাসের একুশ তারিখ। রাত দশটা। আকাশে মেঘ নেই। ঝলমল করছে চাঁদের আলো। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো। কাল রাখী পূর্ণিমা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দোতলা থেকে নেমে এলেন নির্মলকুমারী মহলানবীশ। যাঁকে সকলে ডাকে ‘রানি’ বলে। জোড়াসাঁকো থেকে যেতে চান নি রানি। তাঁকে জোর করে পাঠালেন মীরা। কারণ রানির স্বামী প্রশান্তচন্দ্রও অসুস্থ। সারাদিন রানির কেটেছে জোড়াসাঁকোতে। এবার একবার বাড়ি যাওয়া দরকার। দেখা দরকার স্বামী কেমন আছেন।
তবে মীরা বলে দিয়েছেন, দরকার হলে রানিকে খবর দেবেন তিনি। রানিও সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবেন। দোতলা থেকে নামতে নামতে রানি পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন বার বার। কবির ঘরটির দিকে। এতক্ষণ তো সেখানেই ছিলেন। পুবদিকে কবির মাথা। তিনি বসেছিলেন পায়ের দিকটিতে। জানালা দিয়ে ঢুকছিল চাঁদের আলো। কবির মুদ্রিত চক্ষু আজ চাঁদের আলোর সুধাপান থেকে বিরত। জ্যোৎস্না রাতে বনে যেতে চান যিনি, তিনি আজ মৌন মূক।
মনে পড়ছে কবিরাজমশাইএর কথা।
নগেনবাবুর সঙ্গে রানি গিয়েছিলেন কবিরাজমশাইএর বাড়িতে। সকালবেলায়। অপারেশনের বিপক্ষে ছিলেন কবিরাজমশাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেশন হল। তাই কবিরাজমশাই বললেন যে এখন তাঁর কিছু করার নেই। রানি কাতর হবে বারবার অনুরোধ করতে তিনি রাজি হলেন। রানির কেমন যেন মনে হয়েছিল পূর্ণিমার যোগটা কাটাতে পারলে কবির বিপদ কেটে যাবে। তাই তিনি বিমলানন্দ কবিরাজকে এত কাতর অনুরোধ করছিলেন। কবিরাজ রাজি হলেন কিন্তু বললেন এম বি ৬৯৩টা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে কোন কাজ হবে না তাঁর ওষুধে। কবির ছেলে রথীকে বলা হল। রথী বললেন ডাঃ বিধান রায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে। কবিরাজের কথা শুনে রেগে গেলেন বিধান রায়। তিনি জানিয়ে দিলেন কোনভাবে এম বি বন্ধ করা যাবে না।
কি করবেন রানি!
কু ডাকছিল তাঁর মন। ডাকতেই থাকল। তাহলে কি পূর্ণিমার যোগ কাটবে না! নাঃ, আর কোন আশার আলো নেই। কবি নিজেও রাজি ছিলেন না অপারেশনে। কবিরাজি চিকিৎসায় আশার আলো দেখেছিলেন। সে আলো আর নেই।
গাড়িতে উঠলেন রানি। এতক্ষণ আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। এবার মনে পড়ল বাড়ির কথা। তাঁর স্বামী প্রশান্তচন্দ্রও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আজ সারাদিন কোন খোঁজ নেওয়া হয় নি তাঁর। অবশ্য জীবনবাবু ছিলেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর স্বামীর পরিচর্যার ভার ছিল জীবনবাবুর উপর। যাচ্ছেন বটে বাড়িতে, কিন্তু কতক্ষণ থাকতে পারবেন, তা জানেন না। কু ডাকছে তাঁর মন। অকারণে তো নয়। তিনি যে দেখে এসেছেন। দেখে এসেছেন দেবকান্তির উপর কেমন ম্লান পাণ্ডুর ছায়া। একেই কি বলে মৃত্যুর ছায়া? কে জানে?
রানির মনের পর্দায় ভেসে উঠছে কবিতার কয়েকটি লাইন :
দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত
অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।
যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক
শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা,
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি—
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।
অপারেশনের আগের দিন মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন কবি। ভয়ের মুখোশকে, মিথ্যা কুহককে উপেক্ষা করেছেন তিনি, আত্মসমর্পণ করেন নি তাদের কাছে। কম মৃত্যু, কম বিচ্ছেদ তো আসে নি তাঁর জীবনে। কি ভাবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন সে সব! কিভাবে তিনি অবিকম্পিত কণ্ঠে বারবার বলেছেন : ভালো মন্দ যাহাই আসুক / সত্যেরে লও সহজে!
এই যে আজ, সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুদূত, প্রতি মুহূর্তে অঙ্কিত হচ্ছে ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি, তিনি নিশ্চয় তা অনুভব করতে পারছেন। জীবন ও জগত থেকে সেই আসন্ন বিচ্ছেদকে প্রসন্ন মনে গ্রহণ করেছেন তিনি। তা না হলে অপারেশনের দিন সকালে তিনি রানির কাছে সেদিনকার খবরের কাগজে যুদ্ধের খবর জানতে চান কি করে! যখন শুনলেন রাশিয়ান সৈন্যদের অগ্রগতির খবর, তখন তাঁর মুখে ফুটে উঠল হাসি, বললেন, পারবে, ওরাই পারবে; ভারি অহংকার হয়েছে হিটলারের!
নিশুতু রাতে গাড়িতে যেতে যেতে রানি কবির জীবনবোধের কথে ভেবে আশ্চর্য হতে থাকেন। দুঃখ, যন্ত্রণা সহ্য করার কি অপরিসীম শক্তি তাঁর। মৃত্যুর সাত দিন আগেও তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন কি করে! আর যা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তাতে তো ভয়ের কথা কিছু নেই। ছেলে রথীকে ডেকে তিনি বললেন, ‘অপারেশন কবে হবে?’ রথী বললেন, ‘কাল- পরশু।’ তারপর রানি চন্দকে ডাকলেন তিনি। মনে আসছে একটা কবিতা। রানি চন্দ সেটা লিখে নেবেন। কবি বলে যেতে লাগলেন তাঁর শেষ কবিতা :
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চির সমুজ্জ্বল। …
কবিতা বলা শেষ হয়ে গেল, এলেন ডাঃ ললিত। ডাঃ বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো। আজই অপারেশন সেরে ফেলি, কি বলেন?’ কবি তাঁর কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজই?’ একটু থেমে বললেন, ‘তা ভালো। এরকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।’
অপারেশনে মত ছিল না কবির। তবু সকলের অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। হাসপাতালে নয়, কবির ঘরের পুব দিকের বারান্দায় আয়োজন করা হয় অপারেশনের। বেলা এগারোটায় শুরু হয় অপারেশন, শেষ হয় এগারোটা কুড়িতে। লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে অপারেশন হয়েছিল। অপারেশনের পরে কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন রানি। তাঁর মুখে ছিল যন্ত্রণার ছাপ। কবি রানিকে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছিল। বলেছিল আমার কিছু লাগবে না। কিন্তু আমার খুব লেগেছে। এত কষ্ট হচ্ছিল যে আমি জোর করে ঠোঁট চিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম — পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনরকম আর্তনাদ বেরিয়ে যায়।’
কবির সেই যন্ত্রণাকাতর মুখ বড় কষ্ট দিয়েছে রানিকে ও তাঁর স্বামীকে। তাঁরা অমঙ্গলের আশঙ্কায় কাতর। কেন জানি, রানির বার বার মনে হচ্ছে অপারেশন না হলেই ভালো হত। শুধু কবিরাজ মশাই নন, এতে মত ছিল না সত্যসখা এবং রানির মেজোমামা ডাঃ নীলরতন সরকারের। ডাঃ অমিয় সেন ও ললিতবাবু অপারেশন করেন। তাঁদের ডাকে থাকতে হয়েছিল সত্যসখাকে। সত্যসখাদার মনোভাব বুঝেছিলেন বলেই রানির মনে এত ভয়।
সেই ভয় আরও বেড়ে গেল দু’দিন পরে।
দারুণ হিক্কা শুরু হল কবির। সন্ধেবেলা রানি যখন দেখতে এলেন কবিকে, তখন কবি অনুযোগের সুরে তাঁকে বললেন, ‘একটা কিছু করো। তুমি তো হেড নার্স, দেখতে পাচ্ছ না কি রকম কষ্ট পাচ্ছি। তোমার দাদাকে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে বলে। ’ রানিকে কবি হেড নার্স বলে সমবোধন করতেন। কবির কথা শুনে রানি খুব লজ্জা আর দুঃখ পেয়েছিলেন সেদিন।
সুধাকান্তবাবু যখন কবিকে ইন্দুবাবুর ওষুধের কথা বললেন, তখন কবি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ ওসবে কিছু হবে না। আমি টের পেয়েছি ওরা কিছু ধরতে পারছে না, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছে শুধু। ’
তারপর তিনি রানির দিকে তাকিয়ে কাতরভাবে বললেন, ‘তুমি কি এসব দেখছ না? তুমি আমার কিরকম হেড নার্স? আমার কষ্ট কমিয়ে দাও তুমি।’
রানি বুদ্ধি করে কবিকে মিছরি আর এলাচগুঁড়ো দিলেন। সাময়িকভাবে হিক্কা কমল বটে, কিন্তু পরের দিন আবার শুরু হল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, অবনতি শুরু হয়েছে। কবিকে ওষুধ বা পথ্য দিলে তিনি বলে উঠছেন, ‘আমাকে আর জ্বালাস নে।’
অপারেশনের পর চারটে দিন কেটে গেছে। বিশে শ্রাবণ কবিকে দেখে ভয় করতে লাগল সবার। একেবারে অচৈতন্য, আচ্ছন্ন। সেদিন বিকেলে রানির মেজোমামা ডাঃ নীলরতন সরকারকে নিয়ে এলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। কবির জ্ঞান আছে কি না দেখার জন্য ডাঃ রায়ের কথায় রানি কবির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘একটু জল খাবেন?’ কোন সাড়া নেই। রানি দ্বিতীয়বার আর একটু জোরে সেই কথা বলতে কবি যেন চমকে উঠলেন। কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। এবার ডাঃ রায় বললেন,’মুখে একটু জল দাও, দেখি খেতে পারেন কি না!’ রানি তখন ওষুধ খাবার গ্লাসে একটু জল নিয়ে কবির মুখে দিলেন। অল্প কিছুটা মুখের ভেতর গেল, বেশির ভাগ গড়িয়ে পড়ল বাইরে।
রানির মেজোমামা তখন কবির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বার বার রানি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন মেজোমামার মুখের দিকে। সে মুখ কেমন বিষণ্ণ, হতাশ। চলে যাবার সময় তিনি ফিরে ফিরে দেখছিলেন কবিকে। অচৈতন্য কবি কি বুঝতে পেরেছিলেন বন্ধুর সেই বিদায়? হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তা না হলে মেজোমামা চলে যাবার পরে কেন কবির মুদ্রিত চোখ থেকে বেরিয়ে এল দু ফোঁটা অশ্রু?
বরানগরে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল রানির গাড়ি।
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে রানি ঘরে ঢুকলেন। তাঁর স্বামী শুয়েছিলেন বিছানায়। রানিকে দেখে চমকে উঠলেন। প্রচণ্ড উদ্বেগে বিছানা থেকে উঠে বসে বললেন, ‘কি? কি হল? কি খবর?’
রানি বললেন, ‘ না কিছু হয় নি।’
— ‘তুমি চলে এলে কেন?’
— ‘আমি আসতে চাই নি। মীরাদি জোর করে পাঠালেন।’
একটু যেন বিরক্ত হলেন প্রশান্তচন্দ্র, ‘এ রকম অবস্থায় তোমার চলে আসা ঠিক হয় নি।’
— ‘ঠিক বলেছ। মীরাদি বলেছেন তিনি ফোন করবেন। ফোন এলেই আমি চলে যাব।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রশান্তচন্দ্র বললেন, ‘আমার আফশোশের শেষ নেই। যখন আমাদের প্রিয় মানুষটা চলে যাচ্ছেন পৃথিবী ছেড়ে, তখন থাকতে পারলাম না তাঁর কাছে।’
বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তাঁর। আঁচল দিয়ে সে জল মুছিয়ে রানি বললেন, ‘সশরীরে নাই বা থাকলে, তুমি মনে মনে তাঁর সঙ্গে সব সময় তো আছ।’
প্রশান্ত বলেন, ‘এটা সান্ত্বনার কথা রানি। আচ্ছা, তুমি যদি এ সময়ে কোন কারণে তাঁর কাছে না থাকতে পারতে, ভাবো তো সে কথা।’
রানি কোন উত্তর দিলেন না। কাপড় বদলে তিনি জানালার পাশে বসলেন। দেখলেন জ্যোস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে সারা পৃথিবী। আর এই সময়ে চলে যাচ্ছেন তাঁদের প্রিয়জন। তাঁর মনে পড়ে গেল একদিন কবির মনেও এই ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর পরে তিনি যখন ফিরছিলেন, তখন জ্যোস্নার প্লাবন দেখে মনে করেছিলেন যে তাঁর দুঃখের ছায়া তো কোথাও নেই পৃথিবীতে!
অনেকক্ষণ বাদে প্রশান্ত বললেন, ‘একটা দুঃখ থেকে গেল রানি।’
এবার স্বামীর পাশে বসে তাঁর হাতটা ধরে রানি বললেন, ‘কি বলতো?’
— ‘আমাদের নতুন ঘরে কবিকে আর আনা গেল না।’
একদম ঠিক কথা। মাস ছয়েক আগের কথা। প্রশান্ত দিল্লি চলে যাবার পরে রানি এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। একদিন কথা প্রসঙ্গে কবি জানতে চাইলেন বরানগরে তাঁদের কেনা নতুন জমির কথা, সে জমিতে তাঁরা ঘর বানাবেন কি না! রানি যখন ঘর তৈরি করার কথা বললেন, তখন কবি ছদ্ম অভিমানে বললেন, ‘কতজনে আমার কাছে তাদের ছেলে-মেয়ের নামকরণের জন্য আসে। তোমাদের তো তার দরকারই হল না। এতদিন পরে তোমাদের নিজেদের বাড়ি হচ্ছে, তবু আমাকে তো বললে না একটা জুতসই নাম বেছে দিতে!’
রানি একটু রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘কি করে জানলেন আমরা বলব না! আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম বাড়ির কাজ আর একটু এগোলে আপনাকে নামের কথা বলব।’
সে কথা শুনে কবি খুব খুশি।
তক্ষুণি নাম বাছতে শুরু করে দিলেন। বরানগরের জমিতে আমগাছের প্রাচুর্য শুনে বললেন, ‘ তোমাদের বাড়ির নাম দিলুম আম্রপালি। জানো,এটা বৌদ্ধ সাহিত্যে খুব একটা বিখ্যাত নাম, যাকে বলে ক্লাসিকাল নেম। সেখানে ছিল এক বিখ্যাত নর্তকীর বাগান। সেই নর্তকীর একটিবার নাচের মূল্য ছিল এক সহস্র মুদ্রা। বুদ্ধ একবার এসেছিলেন তাঁর বাগানে বাণীপ্রচার করতে। বুদ্ধকে দেখে, তাঁর কথা শুনে সে মেয়ের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তার নবজীবনের সূচনা হল। সে তার ব্যবসা, ধনসম্পদ সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে শরণ নিয়েছিল বুদ্ধের। সেই থেকে আম্রপালি একটা পবিত্র নাম। সেই পবিত্র নামটাই দিলুম তোমাদের বাড়ির। দেখো, এমন জীবনে কিছু করো না যাতে তোমাদের ঘরের পবিত্র নামটার অসম্মান হয়।’
কবির সে কথা স্মরণ করে ব্যথায় ভারি হল রানির বুক। মনে মনে তিনি বলতে লাগলেন : আপনি যে নাম দিয়েছেন, তাকে কি অপবিত্র করতে পারি?’
ঝনঝন করে বেজে উঠল ফোন।
চমকে খাট থেকে লাফ দিয়ে নামলেন রানি। উত্তেজনায় প্রশান্তও উঠে বসেছেন। কিন্তু না, জোড়াসাঁকোর ফোন নয়। ফোন করেছেন মেজোমামা। এরকম রাতের দিকেই ফোন করেন তিনি। প্রথমে প্রশান্তর ও পরে কবির শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন।
রানি আবার এসে বসলেন স্বামীর কাছে।
প্রশান্ত বললেন, ‘আমার আরও একটা আফশোশ থেকে গেল রানি। কবির শেষ জন্মদিনে আমি থাকতে পারি নি। ছুটি পেলাম না, তাই তোমাকে একাই আসতে হল দিল্লি থেকে।’
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রানি বললেন,’ আমিও যে যেতে পারব, তার ঠিক ছিল না। মার তখন অসুখ। তাঁর কাছে থেকে যাবার কথা ভেবেছি। সে কথা আবার কবিকেও জানাতে পারছি না। তারপর পেলাম তাঁর চিঠি। তখন আর শান্তিনিকেতন না গিয়ে পারলাম না। ’
প্রশান্ত বললেন, ‘ফিরে এসে দেখেছি সে চিঠি। সে চিঠিতে একটা আশঙ্কা আর অভিমান মিশে ছিল। তিনি লিখেছিলেন : এবার আমার জন্মদিন সুহৃদশূন্য জনশূন্য হবে, এমন রিক্ততা ইতিপূর্বে কোনদিন হয় নি। সেই আশঙ্কায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তোমাদের আমন্ত্রণ করেছিলুম। তুমি খুব সংক্ষেপে লিখেছ জন্মদিনে যাব ভাবছি — যদি দ্বিধা থাকে তবে সেদিন আমার তপস্যার দিন আসবে, উপনিষদ হবে আমার সখা।’
রানি বলেন, ‘আমি যদি না যেতে পারতাম তাহলে আমার দারুণ আক্ষেপ থেকে থেকে যেত। আসলে ওই সুহৃদশূন্য জনশূন্য — শব্দগুলি আমাকে ধাক্কা মারতে মারতে চব্বিশে বৈশাখ বিকেলে হাওড়া স্টেশনে এনে ফেলেছিল। সেদিন বিকেলের ট্রেনে প্রফেসর সত্যেন বোস আর তাঁর মেয়েকে নিয়ে আমি চলে এসেছিলাম শান্তিনিকেতন। ’
রানির মনের আয়নায় ভেসে উঠল সেদিনকার জন্মদিনের ছবি।
কবির সঙ্গে দেখা হয় নি রাতের বেলায়। রানিদের পৌঁছাতে অনেক রাত হয়। কবি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরের দিন ভোরবেলায় কবিকে প্রণাম করার জন্য রানি তাঁর ঘরে ঢুকলেন। তিনি চুপ করে বসেছিলেন চেয়ারে। রানির পেছনে ছিলেন প্রফেসর সত্যেন বোস। রানি তাঁকে প্রণাম করে যখন সত্যেন বোসের কথা বললেন, তখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর মুখ। সত্যেনবাবু কবিকে প্রণাম করতে কবি বললেন, ‘ কই হে, তোমাকে তো মোটেই পাওয়া যায় না। ভেবেছিলুম দোলের সময় পাব এবং তোমাকে একটু খাটিয়ে নেব। তা ঠিক সেই সময়ে হিন্দু-মুসলমান মাথা ভাঙাভাঙি শুরু করে দিলে। যাক, এসেছ যে সেজন্য বড় খুশি হয়েছি। শরীরটাকে নিয়ে আজকাল কি রকম বন্দি হয়ে পড়েছি; তোমরা এলে একটু গল্প-সল্প করি, ভালো লাগে, এই যা। তোমার প্রমথ খুব খুশি হবে। তাদের নতুন ল্যাবরেটরিটা একবার তুমি দেখে এসো।’
অতিথিদের যত্নের ভার রানিকেই দিয়েছিলেন কবি। উদীচীর নিচের তলায় সত্যেনবাবুদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। রানি ছিলেন উদয়নে। এখানেই একতলার একটা বড় ঘরে থাকতেন কবি।
সন্ধ্যাবেলায় অনুষ্ঠানের আয়োজন। উদয়নের পুবদিকের আঙিনায় সামিয়ানার তলায় দর্শকদের বসার জায়গা আর চাতালের উপর অভিনয়ের আয়োজন। রানি কবির জন্য গরদের জোড় নিয়ে গিয়েছিলেন। কবি সেই কাপড় পরে এসে রানিকে বললেন, ‘দেখো তোমার কাপড় পরে এসেছি।’
রানি পরেছিলেন গেরুয়া রঙের চওড়া পাড় বেনারসি ধুতি। সেটা কবিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘চিনতে পারেন?’
কবি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কাপড়ের দিকে। তারপর তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চিনতে পেরেছেন। কত দিনকার আগের কথা। রানি তখন শান্তিনিকেতনে। তাঁর জন্মদিন। কবির মনে আছে। সকালবেলা তিনি রানিকে এই কাপড়টা দিয়ে বলেছিলেন, “আমার নিজের পরা পুরানো কাপড় তোমাকে দিলুম বলে কিছু মনে করো না। যদিও পুরানো কিন্তু ভবিষ্যতে এর দাম এত বাড়বে যে সে সময়ে যদি নিলেম করো, তাহলে তার মূল্যে তোমার কাছে আমার সব দেনা শোধ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে তোমার বাড়ি গিয়ে খেয়ে-থেকে যেটুকু খরচ কারাই, সেটা তো আমার শোধ দেওয়াই উচিত। তাই ভাবলুম যে কাপড়খানা ‘ফাল্গুনি’তে পরেছি, ‘বিসর্জনে’ জয়সিংহের ভূমিকায় পরেছি, সেই কাপড়খানা আজ তোমার জন্মদিনে দিই। ” তারপরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ বুদ্ধি তো নেই যে বুঝবে এর কত দাম!’
কবির শেষ জন্মদিনের আয়োজনে আড়ম্বর না থাকলেও আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কবি চাতালের একধারে বসে নাচ-গান-অভিনয় দেখছিলেন। রসিকতাও করছিলেন। সেদিন ‘বশীকরণ’ নাটকের অভিনয়ে কবির পুরাতন ভৃত্য বনমালীকে নামানো হয়েছিল। কবি তাকে লীলমণি বলে ডাকতেন। কবি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমার লীলমণির কত গুণ তাই দেখো। বাঁদরটা আমার কাছে থেকে থেকে নাটক করতেও শিখে গেছে।’
ভাবনায় ডুবেছিলেন রানি। আবার ঝনঝন করে বেজে উঠল ফোন। জীবনবাবু ফোন তুললেন। একটু পরে শোনা গেল তাঁর ডাক, ‘ রানি ওঠো। মীরার ফোন। তোমাকে বেরিয়ে পড়তে বলেছেন।
রানি তৈরি হয়েই ছিলেন। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। রাত তখন দুটো।
নিশুতি শহরের নির্জন রাস্তা দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলল গাড়ি। ভয়ে রানির বুক দুরুদুরু। কি দেখবেন গিয়ে!
জোড়াসাঁকোর গলিতে ঢুকল গাড়ি। রানি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছেন। অস্বাভাবিক কিছু তো চোখে পড়ছে না। শোনা যাচ্ছে না কান্নার রোল। ধীরে ধীরে কবির ঘরে ঢুকলেন তিনি। দেখলেন পুত্রবধূ প্রতিমা বসে আছেন স্থির হয়ে। কবির ছোড়দি বর্ণকুমারী পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে। কবি পুবশিয়রি হয়ে শুয়ে রয়েছেন। অচৈতন্য। প্রত্যেকবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঘড়ঘড় আওয়াজ। রানি প্রতিমার দিকে তাকাতে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে। রানি জানেন কি ভাঙচুর হচ্ছে তাঁর বুকের ভেতর।
আস্তে আস্তে আকাশ স্বচ্ছ হয়ে আসতে লাগল।
কবি রোজ সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তেন। প্রভাতের আলোয় নতুন করে পড়তেন পৃথিবীর চিঠি। আজ সে নিয়মের ব্যতিক্রম হল। রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে প্রভাত যে হাজির হল নতুন দিনের খবর নিয়ে, সূর্যসাধক কবি তা বুঝতে পারলেন না। তাঁর কোন চেতনা নেই। ধ্বনিত হচ্ছে ব্রহ্মসংগীত। শুনতে পাচ্ছেন না কবি।
অমিতা কবির খাটের পাশে দাঁড়িয়ে কবির ঠোঁটের উপর একটু করে জল ঢেলে দিচ্ছেন আর তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ‘শান্তম শিবম অদ্বৈতম’ মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। এটাই কবির প্রতিদিনকার ধ্যানের মন্ত্র।
বেলা বাড়ছে।
লোকজন আসতে শুরু করেছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এসে প্রার্থনা করলেন। বিধূশেখর শাস্ত্রী ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্র পাঠ করলেন। রানির চোখে ভেসে উঠল এক মর্মান্তিক দৃশ্য। কবি বসে আছেন মৃত্যুপথযাত্রী কন্যার কাছে। নিবাত নিষ্কম্প। উচ্চারণ করছেন ‘পিতা নোহসি’। কত প্রিয়জনের বিচ্ছেদ সহ্য করেছেন কবি। আজ রানিদেরও সহ্য করতে হবে প্রিয়জনের বিচ্ছেদ।
কবিরাজ বিমলানন্দ রানির পাশে দাঁড়িয়ে কাতরভাবে বললেন, ‘আমি কিছুই করার সুযোগ পেলাম না। সে আফশোশ থেকে যাবে সারা জীবন। যদিও কাল আপনি আমার কাছে গেলেন, তবু শেষ ওষুধটা আমি দিতে পারলাম না।’
কবির বাড়ির টেলিফোনের দায়িত্বে ছিলেন সজনীকান্ত দাস। কবির খবর জানার জন্য নানা প্রান্ত থেকে ফোন আসছিল। সজনীকান্ত সেসব সামলাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর কাছ থেকে খবর এল বরানগর থেকে ফোন এসেছে, রানিকে এক্ষুণি যেতে হবে।
খবর পেয়ে রানির উদ্বেগ বেড়ে গেল। অসুস্থ স্বামীকে ফেলে রেখে এসেছেন তিনি। তাঁর কিছু হল না তো! কে ফোন করল বরানগর থেকে? রানির কথায় সজনীকান্ত সেখানে ফোন করলেন। লাইন পাওয়া গেল না।
এখন কি করবেন রানি!
একদিকে অসুস্থ কবি, আর একদিকে অসুস্থ স্বামী।
মিনু এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো বউদি। নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু।’
প্রতিমাদেবীকে বলে রানি ডাক্তার অমিয় বসুর গাড়িতে উঠলেন। শ্যামবাজারের কাছে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সত্যসখাদাদার সঙ্গে। ডাক্তার শান্তিরাম চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন জোড়াসাঁকো। বরানগরের কথা শুনে তিনি ডাক্তারকে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন রানিকে। সেই সঙ্গে এক বাক্স গ্লুকোজও নিলেন। যদি লাগে। সত্যসখা নানা কথা বলে যাচ্ছেন। সেসব কানে ঢুকছে না রানির। তিনি শুধু ভাবছেন, এ কি পরীক্ষা এল তাঁর জীবনে!
বরানগরে বাড়ির কাছে এসে দেখলেন বাড়ি নিস্তব্ধ। মালিবউ পুকুরঘাটে বসে নিশ্চিন্তে বাসন মাজছে। তাই দেখে তাঁর প্রাণ ফিরে এল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন রানি। প্রশান্ত তাঁকে দেখে বলে উঠলেন, ‘এ কি! এমন সময়ে তুমি চলে এলে!’
রানি বলেন, ‘এখান থেকে ফোন গিয়েছিল তাড়াতাড়ি আসার জন্য।’
প্রশান্ত অবাক, ‘সে কি! কে ফোন করল?’
— ‘কি করে জানব? নাম জানার আগেই ফোন কেটে গেল।’
— ‘তুমি গলা চিনতে পারো নি?’
— ‘আমি তো ফোন ধরি নি। সজনীকান্তবাবু ফোন ধরেছিলেন।’
বাড়িতে যারা ছিল, সবাইকে ডাকা হল। না, কেউ ফোন করে নি। অবাক কাণ্ড। একেবারে ভুতুড়ে ব্যাপার।
সত্যসখা বললেন, ‘যাক, প্রশান্ত যে ঠিক আছে এই ঢের। গ্লুকোজ কিনে আনাটা ব্যর্থ হল। প্রশান্ত তোমার আর কিছু লাগবে কি না বলো।’
প্রশান্ত রেগে বললেন, ‘আমার কিছু হয় নি। কিছু লাগবে না। তোমরা যাও। রানি কথা দিয়েছিল কবির কাছে শেষ পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু সে কথা বোধহয় রানি রাখতে পারবে না।’
স্বামীর শেষ কথায় দারুণ চমকে উঠলেন রানি।
সত্যই কি তাই হবে? কথা রাখতে পারবেন না রানি?
আবার গাড়ি ছুটতে লাগল জোড়াসাঁকোর দিকে। কিন্তু এ রাত নয়, দিন। দিনের বেলায় শহরে বাধার শেষ নেই।
জোড়াসাঁকোয় পৌঁছে দেখেন জনসমুদ্র। একে একে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মানুষ ছুটে এসেছেন কবিকে শেষ দেখা দেখবেন বলে।
কবির ঘরে ঢুকলেন রানি। বুঝতে পারলেন যে তিনি কথা রাখতে পারলেন না। তাঁর ঘরে ঢোকার কয়েক মুহূর্ত আগে কবি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কান্নাভরা গলায় অমিতা বললেন, ‘আর একটু আগে আসতে যদি! ঠিক শেষ মুহূর্তের আগে ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠাকাতেই হাত পড়ে গেল।’
রানি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপছে। প্রাণপণে আত্মসংবরণ করার চেষ্টা করছেন তিনি। আর মনে মনে বলে যাচ্ছেন :
মনেরে আজ কহ যে
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে
পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত