অনুবাদকের কৈফিয়ৎ
অনুবাদক গত তিরিশ বছর ধরে বাংলার গ্রামে গ্রামে বংশ পরম্পরার কারিগরদের সঙ্গে আর গত দেশ শতক ধরে কারিগর সংগঠন বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে। ভারতের বা বাংলার কারিগরদের নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও ইতিহাস লিখিত হয় নি – এক রুশ গবেষক মুঘল আমল নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু আমাদের সেটিকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক অবস্থান হিসেবে মনে হয় নি। অনুবাদক চেষ্টা করছেন সেই ইতিহাস লেখা শেখার দিকে অগ্রসর হওয়ার। সেই পথে রমেশচন্দ্র মজুমদারের এই বইটি হাতে আসে। আমার মনে হয়েছে বইটি কারিগরদের ইতিহাস খুঁজে নিতে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। বইএর প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষে কারিগর এবং শ্রেষ্ঠী সংগঠনের ইতিহাস খুঁজেছেন। এছাড়াও তিনি সে সময়ের গণরাজ্যগুলো অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিষয়েও বিশদে আলোচনা করেছেন। আমি এই বইতে মূলানুগ হয়ে বাক্য ধরেও ধরে অনুবাদ করেছি, শব্দগুলোর ব্যবহারকে বুঝে তার কাছাকাছি প্রতিশব্দ জোগাড় এবং ব্যবহার করেছি। আমার প্রধান উদ্দেশ্য রমেশবাবুর বইটির মর্মবস্তুকে অক্ষত রাখা।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, বইটি প্রকাশ ঘটেছিল প্রায় ১০০ বছর আগে। তখন কর্পোরেট অর্থ ছিল সহযোগ অথবা সমবায়িক গোষ্ঠীবদ্ধতা – অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভূত সম্পর্ক স্থাপন করে কোনও কাজ সম্পাদন করা। আমি এই অনুবাদে কর্পোরেট বোঝাতে সহযোগ, সমবায়িক শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি।
এই কাজটি পাঠকের আনুকূল্য লাভ করলে অনুবাদকের পরিশ্রম সার্থক হবে।
মুখবন্ধ
১৯১৯এর শুরুতে আমি কর্পোরেট লাইফ ইন এন্সিয়েন্ট ইন্ডিয়া নামক একটি সন্দর্ভ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টর অব ফিলোজফি উপাধি পাওয়ার জন্যে জমা দিই। এই সন্দর্ভটি গৃহীত হয়েছিল। এর ৩০০টি নকল আমার কাছে থেকেগিয়েছিল বিক্রির উদেশ্যে। এটাই হল বইটির প্রথম সংস্করণের মূল কথা।
জনগণের উৎসাহে এবং প্রখ্যাতদের পৃষ্ঠপোষণায় উৎসাহিত হয়ে আমি পুস্তকটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে মনস্থ করি। এই কাজের জন্যে আমার গবেষণাকর্মটির বেশ কিছু জরুরি পরিবর্তন সাধন করতে হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু অতিরিক্ত শিলালেখ সূত্র ব্যবহার করেছি, যার ফলে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ অংশটিতে দক্ষিণ ভারতের গ্রাম প্রতিষ্ঠান আলোচনাটি বেশ কিছুটা সংস্কার করতে হয়েছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ জার্মান এবং সংস্কৃত উদ্ধৃতির ইংরেজি অনুবাদ এই সংস্করণে যোগ করলাম।
বইটি বিষয়ে যে সব অনুকূল সমালোচনা লেখা হয়েছে এবং নানান ব্যক্তিবর্গ বইটির গুণমান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমায় যে সব উপদেশ দিয়েছেন, তার জন্যে আমি নিম্নলিখিত প্রখ্যাত জ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ড. ভি এ স্মিথ, এফ ই পার্জিটার, ড. এ বি কীথ, ড ই ডবলিউ হপকিনস এং ড. এল ডি বার্নেট।
সবার উপরে আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ নির্দেশক স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি। তার সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই আমি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নির্ভর কাজটা শেষ করতে পারলাম। এই সাহত্যকর্মে তাঁর নাম অঙ্গীভূত করতে দেওয়ার জন্যে আমি তাঁর অনুগামী হয়ে রইলাম।
শেষে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ডি আর ভাণ্ডারকর, এম এ, রাধাগোবিন্দ বসাক, এম এ, রমাপ্রসাদ চন্দ, বি এ, এবং ড আই জে এস তারাপোরেওয়ালা, বি এ পিএইচডির প্রতি। তারা বইটি লেখার সময় আমায় অভূতপূর্ব সাহায্য করেছেন। এছাড়াও ইমপিরিয়াল লাইব্রেরির রিডিং রুমের সুপারিনটেন্ডেন্ট সুরেন্দ্র কুমারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। তিনি আমার চাহিদা মত নানান বই এবং পত্রিকা দেখতে সুযোগ করে দেওয়ায়, আমার কাজ অনেকটাই সুগম হয়েছে।
আর সি মজুমদার,
কলকাতা ২৮ আগস্ট ১৯২০
ভূমিকা
আজকে আমরা যে উন্নত সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পেরেছি, সেই রাস্তা তৈরিতে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার চরিত্রই সর্বোত্তম কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। জনপ্রিয় সরকারগুলোর নানান পরীক্ষানিরীক্ষা এবং আমাদের জীবনকে জড়িয়ে থাকা মহতী অর্থনীতির যে কাঠামো আর ব্যবস্থাপনা বিশ্ব জুড়ে তৈরি হয়েছে, তাকে আমরা আধুনিকাল হিসেবে আখ্যা দিতে পারি। যে সহযোগিতার ভিত্তিভূমি অবলম্বনে আজকের দিনে যে সাফল্যের শিখরে আমরা পৌঁছতে পেরেছি, তাকে আরও গভীরে গিয়ে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে। অনেকেই মনে করেন বিশ্বজুড়ে যে অগ্রগতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে কৃষ্টির মৌল বিষয়গুলো অধ্যয়ন করা জরুরি কাজগুলির মধ্যে অন্যতম।
জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থায় সহযোগিতা অথবা যৌথতার পরিবেশ গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করার জন্যে আমি কিছু কথা উপস্থাপন করার অনুমতি চাইছি। বর্তমান ভারতবর্ষ, কৃষ্টি বিষয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে — এরকম একটা ধারণা চালু আছে। বিপরীতক্রমে এই বইএর আলোচনায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব অতীতে ভারতবর্ষের নানান বিষয়ে আমরা আলাদাধরণের উন্নতির মাত্রা অর্জন করেছিলাম। প্রাচীন ভারতবর্ষ সামাজিক, ধার্মিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইত্যাদি প্রায় সব কটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন যুগের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ‘জাতি’ এবং সংঘ (বৌদ্ধ শ্রমনদের গোষ্ঠী) চেতনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। একই চেতনা বাকি দুটি ক্ষেত্রে গণ (রাজনৈতিক সহযোগিতা এবং শ্রেণীবদ্ধতাতেও (কারিগর সংগঠন বা গিল্ড)) অসামান্য অবদান লক্ষ্য করা যায়।
প্রাচীন ভারতের জনজীবনে সহযোগিতামূলক শ্রেণীবদ্ধ কাজকর্ম বিষয়ে আলোচনা আমাদের অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রসারিত করতে সাহায্য করবে। জীবনের নানান ক্ষেত্রে যে সব সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, এই বইতে সে সব বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। এই আলোচনা আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষের নানান শ্রেণীর মানুষের কাজকর্ম বিষয়ে সত্যকারের দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে সাহায্য করবে। আজ মোটামুটি সকলেই মানতে বাধ্য হয়েছেন [অতীত ভারতবর্ষের] সামগ্রিক জনজীবনে অথবা জীবনের ক্ষুদ্রতম ক্ষেত্রেও ধর্ম চেতনা খুব গভীরে শেকড় ছড়াতে পারে নি। এবাবদে যে সহযোগিতামূলক গোষ্ঠীবদ্ধ কাজকর্ম চলত, সেগুলিও বিচ্ছিন্ন চলক ছিল না, বরং গভীরভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিব্যপ্ত হয়েছিল।
কারিগরেরা যখন সেনাবাহিনীর অংশ ।। শ্রীলঙ্কার ভেলিক্কারা শিলালেখ
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার এই কাজের আগে প্রাচীন ভারতবর্ষের সমবায়িক মনন নিয়ে লেখকেরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হন নি। ‘সংঘ’ বা ‘গণ’ বিষয়ে বহু জ্ঞানী অতীতে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমি যেভাবে তাদের মধ্যের আত্মিক সম্পর্ক দেখাতে, বোঝাতে চেষ্টা করেছি, সেই প্রেক্ষিতটা আমার পূর্বে আবির্ভূত জ্ঞানীর ধারণায় ধরা পড়ে নি। তাছাড়া সে সব ছাড়া ছাড়া বিষয় নিয়ে আলোচনার গভীরে যাওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যদিও সম্প্রতি ‘শ্রেণী’ বিষয়ে হপকিনস ‘ইন্ডিয়া, ওল্ড এন্ড নিউ’ বইতে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, কিন্তু গভীরে গিয়ে এই কাঠামোর বিশদ ঐতিহাসিক বিন্যাস হয়ত এই প্রথম আমার বইতে নির্দিষ্টভাবে আলোচিত হল। আমার জ্ঞানগম্যি সূত্র ধরে বলতে পারি, প্রথম অধ্যায়ে যে সব অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, সে সব এর আগে এত বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয় নি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের টিকায় বেশ কিছু বিষয়ে কিছু নতুন ধারণা জুড়েছি। দক্ষিণ ভারতের গ্রাম কাঠামোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা বর্তমান বইএর নতুন এবং মৌলিক সংযোজন। রিজ ডেভিস এবং কে পি জয়সওয়ালের তথ্য ভিত্তি করে রাজা নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ আলোচনা করেছি তৃতীয় অধ্যায়ে। পাদটিকায় আমি দুই জ্ঞানীর নানান কাজ উল্লেখ করে, তাঁদের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এই সঙ্গঠনগুলির উদ্ভব এবং বিকাশ বিষয়ে আমি আলোচনা নিবদ্ধ করেছি শুধুই প্রাচীনকালের শেষ পর্ব পর্যন্ত [মধ্য যুগ শুরু হওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত — অনুবাদক]।
বৌদ্ধ মঠের চরিত্র কাঠামো নিয়ে বহু জ্ঞানী আলোচনা করেছেন। এবিষয়ে ওল্ডেনবার্গ-এর অবদান ভোলা যাবে না। চতুর্থ অধ্যায়ে প্রাচীন ভারতের শ্রেণী সংগঠনের যৌথতার সূত্রে বৌদ্ধ সংগঠন কাঠামো এবং তার ধর্মীয় যৌথতার বিস্তৃত আলোচনা নিবদ্ধ করেছি।
ওয়েবারের দশম খণ্ডের Indische Studien (Collectanea uber die Kastenverhaltnisse in den Brahmana und Sutra, ইংরেজিতে Indian Studies (Collectanea on the Caste Relationships in the Brahmana and Sutra)), Senartর অসামান্য প্রবন্ধ ‘Les Castes Dans L’inde’ (The Castes In India) ZGMGএর ৫০, ৫১ খণ্ডে জলি এবং ওল্ডেনবার্গের কাজের সমালোচনা আমায় ঋদ্ধ করেছে এবং আলোচ্য বিষয়ে তাঁরা যে সব তথ্য সরবরাহ করেছেন সেসব ব্যবহার করলেও, আমার সিদ্ধান্তটি তাঁদের নেওয়া সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় বয়েছে এবং আমি এই বইতে যেভাবে সেই তথ্য ইত্যাদি আলোচনা করেছি সেই পদ্ধতিটিও সর্বৈব নতুন। একইভাবে আমি ফিকের Die Soclale Gliedentng bn Norddstlichen Indien Zu Buddha’s Zeit (ইংরেজিতে The Soclale Linkage in Northeastern India In Buddha’s Time) ব্যবহার করেছি বৌদ্ধ আমল নিয়ে তথ্যের আকর হিসেবে। এতদসত্ত্বেও বৌদ্ধ আমল বিষয়ে আমি বহু নতুন তথ্য জোগাড় এবং এই বইতে সন্নিবিষ্ট করেছি।
বইটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য নানান তথ্যকে যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গীতে উপস্থাপন করা যাতে পাঠকের চোখের সামনে প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ও বিকাশের চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই কাজ করতে গিয়ে আমি নানান সূত্র উল্লেখ করেছি যাতে আমার সিদ্ধান্তের ভিতটিকে মূল সূত্র অবলম্বন করে পাঠক পরীক্ষা ককরে নিতে পারেন।
এই কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সাহত্যিক সূত্র থেকে আমি যে সময় সারণি তৈরি করেছি, সে বিষয়ে মন্তব্য করা দরকার। আমি মূল লেখায় সে সব আলোচনা এড়িয়েগিয়েছি, কারন আমার মনে হয়েছে তাতে লেখার প্রবাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তবে মূলত আমি দুই শ্রেণীর, ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ সাহিত্য এবং শাস্ত্র সূত্র অবলম্বন করেছি। ব্রাহ্মণ এবং সংহিতা বাদ দিলে মূল ব্রাহ্মণ্য নীতি সংকলিত হয়েছে ধর্মসূত্র এবং ধর্মশাস্ত্রগুলিতে। ধর্মশাস্ত্রর লিখন সময় নির্ধারণ খুবই সমস্যার বিষয় তবে পণ্ডিতেরা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। ধর্মশাস্ত্র উদ্ভবের সময় আলোচনায় আমি সম্পূর্ণভাবে পথ নির্দেশ অনুসরণ করেছি জে জলির প্রখ্যাত পুস্তক, Recht und Sitte (Hindu Law and custom) নির্ভর করে। শাস্ত্র বিষয়ে যুগভাগের তাঁর ভাবনা সংক্ষিপ্তাকারে নিচের তালিকায় উপস্থাপন করা গেল —
প্রাচীনতার ক্রমে সাজানো পাঠ্যক্রম | সম্ভাব্য যুগ | পৃষ্ঠা | |
ধর্মসূত্র | ১। গৌতম | ৫ বা ৬ খ্রিপূ | ৫-৬ |
২। বৌধায়ন | ঐ | ৪ | |
৩। অপস্তম্ব | ৪ বা ৫ খ্রিপূ | ৪ | |
৪। বশিষ্ঠ | ঐ | ৭ | |
ধর্মশাস্ত্র | ৫। মনু স্মৃতি | ২ বা ৩ খ্রির পরে নয় | ১৬ |
৬। বিষ্ণু স্মৃতি | ৩ খ্রির আগে নয় | ৭ | |
৭। যাজ্ঞবল্ক্য | ৪ খ্রি | ২১ | |
৮। নারদ | ৫০০ খ্রি | ২৩ | |
৯। বৃহস্পতি | ৬ অথবা ৭ খ্রি | ২৭ | |
১০। কাত্যায়ন | ঐ | ২৮ |
উল্লিখিত ধারাবাহিকতাটি বিষয়ে মোটামুটি সাধারণ ঐক্যমত্যে পৌঁছনো গিয়েছে (শ্রী কে পি জয়সওয়াল ট্যাগোর ল’ লেরকচারক্রমে অন্য একটি পথ নির্দেশ দিয়ে গৌতম, বৌধায়ন এবং বশিষ্ঠর রচনাগুলিকে ৩৫০, ২৫০ এবং ১০০ খ্রিপূতে উপস্থাপন করেছেন এবং বলেছেন এগুলি ৫০০ খ্রিপূতে প্রথম ভ্রুণাকারে শুরু হয়। বক্ষ্যমান বইটি লেখার সময় তার বক্তৃতা মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হয় নি, ফলে এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা আমার বিচারের বাইরে থেকে গিয়েছে), তবে মনুস্মৃতি নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে, আমি ব্যুহলার কৃত সময়কেই মান্যতা দিয়েছি অর্থাৎ দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়।
অন্যান্য ব্রাহ্মণ সাহিত্য যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদকে ৬০০ খ্রিঃপূর্বে প্রতিষ্ঠিত করাগিয়েছে (McDonnell—History of Sanskrit Literature, p. 226)। অর্থশাস্ত্র সঙ্কলিত হয়েছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কালে অর্থাৎ ৩২০ খ্রিঃপূ-তে (দেখুন Jolly Z. D. M. G., A vol. 67, pp. 49-96-তে জলির প্রবন্ধ; বিশেষ করে 95-96 পাতা)। রামায়ণের মূল কাঠামোটি লেখা হয়েছে ৫০০ খ্রিঃপূ-তে, যদিও দ্বিতীয় খ্রিঃপূ-তে শেষতম বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে (McDonnell (op. cit.), p. 309)। আজকে যে আকারে মহাভারতকে দেখি, সেটা ৩৫০ খ্রিঃপূ-তে সঙ্কলিত হয়ে যায় (Ibid, p. 287. ব্যুহলার এই সময়কে চিহ্নিত করেন 300-500 A. D. মধ্যে (Buhler and Kriste, contrib. to the Hist of the Mahb))। পাণিনীর সময়কে ড ভাণ্ডারেকর নিয়ে গেছেন ৭ম খ্রিঃপূ-তে (Bombay Gazeteer (1896), Vol. I, Part II, p. 141)। বৌদ্ধ সাহিত্য হিসেবে আমি মূলত জাতকের নানান উদাহরণ ব্যবহার করেছি, ফিক একে বুদ্ধের সময়কালে আর রিজ ডেভিস বুদ্ধের আগের সময়ের রচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ( Fick, pp. vi-vii ; Buddhist India, p. 207)। দুজনের কথাই মান্য করে আমি জাতকের সময় নির্ণয় করেছি খ্রিপূ সপ্তম থেকে ষষ্ঠ শতক। বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্র যেমন বিনয় এবং সূত্ত পিটককে ওল্ডেনবার্গ এবং রিজ ডেভিস উপস্থপন করছেন চতুর্থ খ্রিঃপূ-তে (S, B. E., Vol., XIII, p. xxiii. ibid, Vol. XI, p. x)। পণ্ডিতেরা কোন মতবাদ অবলম্বন করে নানান সাহিত্য শাস্ত্রের সম্ভাব্য তারিখ নির্ণয় করলেন, সেই বিতর্ক বিচার করা আমার কাজের এক্তিয়ার বাইরে। তারা যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তাকে আমি মান্যতা দিয়েছিমাত্র (সদয় হৃদয় ড. এ বি কিথ আমায় চিঠি লিখে জানিয়েছেন অর্থশাস্ত্র এবং জাতকের আমি যে তারিখ নির্ণয় করেছি তাতে তিনি একমত। ড. হপকিনসও চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন জাতক বিষয়ে তিনি আমার সঙ্গে একমত; কিন্তু অর্থশাস্ত্র সংকলনের সময় বিষয়ে তিনি আরও খোলা মনে বিচার করতে চান। সামগ্রিক বিষয়টা গভীরভাবে অধ্যয়ন এবং বিচার করে মনে হয়েছে এ বিষয়ে মতপার্থক্য রেখে আমার নিজের মতটিই পোষণ করা দরকার। কেউ হয়ত মনে করতে পারেন জাতক এবং অর্থশাস্ত্র উপরে উল্লিখিত সময়েই রচিত হয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি এই দুটিতে সমাজ এবং প্রশাসনের যে ছবি তুলে ধরা হয়েছে সেটি সেই প্রস্তাবিত সময়ের খুব দূরের নয়। এবং অর্থশাস্ত্র বিষয়ে জার্মান জ্ঞানীদের গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মনে হয় জাতক বিষয়ে ব্যুহলার, রিজ ডেভিস এবং ফিকের মন্তব্য হাল্কাভাবে সরিয়ে রাখা যায় না। তবুও আজও এই বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় আসে নি। আবারও বলব বইএর মূল ভাবের সঙ্গে সেই সব আলোচনার কোনও যোগ নেই বলেই আমি সেই সব প্রশ্ন উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়েছি)।
আমি পাঠকদের বিনীতভাবে বলতে চাই এই বইতে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে একটি মাত্র দৃষ্টিভঙ্গীর কথা মাথায় রেখে সেটি হল প্রাচীন ভারতের সমিতিবদ্ধ বা সমবায়িক [রমেশবাবু বইতে কর্পোরেট শব্দটা ব্যবহার করেছেন। গণস্মৃতিতে বা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চায় ১০০ বছর আগে কর্পোরেট বোঝতে যে বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার হত, আজ সেটা আর হয় না। অনুবাদ শুরু করার আগে বইটা নতুন করে পড়ার সময়েই বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি রমেশবাবু যদি বাংলায় বইটা লিখতেন, তাহলে তিনি কর্পোরেটের প্রতিশব্দ হিসেবে কোন বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। প্রথমে সমিতিবদ্ধ শব্দটা ব্যবহার করব ভাবছিলাম, এবং করেও ছিলাম কিন্তু অনুবাদ শুরু করে কিছুদূর এগোনোর পরে মনে হল সমবায়িক শব্দটা কর্পোরেট শব্দের কাছাকাছি হবে — অনুবাদক] জীবন বিষয়ে বিশদ তথ্য আহরণ এবং আলোচনা করতে। সে সময়ের সাহিত্যে জাতি এবং সংঘের মত সমাজ সংগঠনের নানান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থাকতে পারে, কিন্তু সেই সব চরিত্রে যেহেতু আমার মূল আলোচ্য বিষয় বিকাশে বিন্দুমাত্র সহায়ক হবে না, তাই আমি সে সব আলোচনা করি নি। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে একই কারণে এরকম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বইএর মূল বিষয় আলোচলাকালে উহ্য রেখেছি।
আবারও উল্লেখ করতে চাই আমি পূর্বের প্রত্যেক লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি পাদটিকাগুলিতে, এ বিষয়ে যদি কারোর নাম বাদ পড়ে, ধরে নিতে হবে সেটি ভ্রান্তি বশতই হয়েছে। সাধারণভাবে আমি মান্য অনুবাদ ব্যবহার করেছি এবং মূলানুগ থাকতে চেষ্টা করেছি।
১। জাতক অনুবাদটি নিয়েছি কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসের বই থেকে
২। অপস্তম্ব, গৌতম, বশিষ্ঠ, বৌধায়ন, মনু, নারদ এবং বৃহস্পতি সংহিতা নিয়েছি থেকে S. B. E., Vols. II, XIV, XXV, and XXXIII
৩। বিনয় শাস্ত্র এবং বৌদ্ধ সূত্তের অনুবাদ নিয়েছি S. B. E., Vols. XIII, XVII, XX, and XI
৪। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের অনুবাদ নিয়েছি আর শ্যামাশাস্ত্রী, বি এ’র থেকে
ইন্ডিয়ান এন্টিকুইটি পদ্ধতি অনুসারে ভাবানুবাদ করেছি
(চলবে)
ভীষণ আগ্রহ বোধ করছি পরবর্তী পর্বগুলো পড়ার জন্য।