“বারো মাসে বারো ফল, না খেলে যায় রসাতল।” মা ঠাকুমাদের মুখে মুখে বলা এমন অনেক ছড়া আসলে স্বাস্থ্য সচেতন মানসিকতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অধুনা গৃহকর্ত্রীদের মতো ইন্টারনেটে ডায়েট চার্ট নিয়ে আলোড়ন তুলে তথ্য সংগ্রহ না করলেও কিংবা সঠিক বৈজ্ঞানিক যুক্তি তাদের কাছে জানা না থাকলেও, দিন প্রতিদিনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে তারা বলতে পারতেন কোন মরশুমে কোন ফলটা, কোন খাবারটা খেলে কার সহ্য হবে কিম্বা কোন অসুখে কোন খাবারটা খুব সহজপাচ্য।
আমাদের রোজের খাদ্য তালিকায় যতই ভাত, ডাল, রুটি, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম গুরুত্ব পাক না কেন ফল ততটা পায় না। অথচ আমরা কমবেশি সকলেই জানি যে সিজিনাল ফ্রুটসের গুরুত্ব অপরিসীম। ভিটামিনে ভরপুর ফল আমাদের রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখে, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়, শরীর সতেজ রাখে। ফল ছাড়া ব্যালেন্স ডায়েট সম্পূর্ণ হয় না।
শীতে কমলালেবু, কুল, আঙুর, বরই, জলপাই, আমলকি, সপেদা, পানিফল…. গ্রীষ্মে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, বর্ষায় আনারস আর আপেল, কলা, পেয়ারা, শশা, পেঁপে সে তো সারা বছরই পাওয়া যায়। আজ শীতের ফল নিয়েই কিছু ফলকথা।
কমলালেবু : শীতের অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ সুস্বাদু কমলা লেবু। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চীন দেশে প্রথমে কমলা লেবুর চাষ শুরু হয়। তারপর পর্তুগিজ নাবিকদের হাত ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে কমলার চাষ। কমলালেবুর সংস্কৃতি সম্ভবত তার আদি বাসস্থান থেকে ভারত এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে এবং সেখান থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নাকি ছড়িয়ে পড়েছিলো। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের যাত্রা করার সময় ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর পরিমান কমলা গাছ ছিল।
খোসা ছাড়ানো ১০০ গ্রাম কমলালেবুতে কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি৬, ফোলেট (বি-৯), কোলিন, ভিটামিন-সি, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড এবং শক্তিমাত্রা ৪৮ কিলো ক্যালরি হেসপিরাটিন নারিনজেনিন ক্রিপ্টোজেনথিন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট ধর্মী ফাইটোকেমিক্যালসের উপস্থিতি কারণে কমলালেবুর বিশেষ রোগ নিরাময়ী ক্ষমতা আছে।
কমলালেবু তে হেসপিরিডিন নামক এক ধরনের ফ্ল্যাবনয়েড থাকায় উচ্চ রক্তচাপকে বশে রাখতে সাহায্য করে। ডায়েটারি ফাইবার ও ফাইটো নিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ থাকায় লেবুতে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে। কমলালেবুর লিমনিনয়েড যৌগ ত্বক মুখবিবর স্তন ফুসফুস পাকস্থলী ও কোলন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ে। মিষ্টি হলেও ডায়াবেটিকরা নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় কমলালেবু খেতে পারেন, তবে রস করে নয়, গোটা ফল হিসেবে। ইউরিনালি ট্রাক ইনফেকশন ও কিডনি অক্সালেট স্টোন ফর্মেশন এর আশঙ্কা কমায় কমলালেবু।
প্রকৃতিগতভাবে কমলালেবু টক জাতীয় ফল তাই গ্যাস্ট্রোইসোফেগাল রিফ্লাক্স রোগে (GIRD) এটি না খাওয়াই ভালো। অকাল বার্ধক্য, উজ্জ্বল ত্বক, দীর্ঘ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের জন্য খাদ্য তালিকায় এই ফলটি অতি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
কুল : পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে তাজা রসালো টক মিষ্টি কুলের কথা ছাড়া শীত যেন সম্পূর্ণই হয় না আর কুলের সঙ্গে আমাদের সরস্বতী পূজার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ছোট্ট ফলটি দেবীকে নিবেদন না করে আমরা সহজে খাই না। আমাদের দেশে এখন প্রায় ৯০ রকম প্রজাতির কুলের কথা জানা যায়, এর আদি বাসস্থান চীন। মরশুমের তাজা ফল ছাড়াও অসময়ে কূলে আচার চাটনি হিসেবে আমরা খাই। আয়ুর্বেদ চিকিত্সায় পাকা শুকনো কুলের কথা বলা হয়েছে। কম বেশি সবারই প্রিয় ফলটির রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা।
১০০ গ্রাম তাজা কূলে জলীয় অংশ প্রায় ৮১ থেকে ৮৩ গ্রাম, এ ছাড়া কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন-সি, আয়রন, পেকটিন, সাইট্রিক এসিড ইত্যাদি থাকে। ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ হওয়ায় টনসিলাইটিস জিভ বা ঠোঁটের কোনে ঘা ইত্যাদি সংক্রামক রোগ দূর করে কুল। ট্যানিন ও অন্যান্য ফাইটোকেমিক্যালস সমৃদ্ধ কুল বাতের ব্যথা নিরাময় ইত্যাদি চিকিৎসায় সেই প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সিজন চেঞ্জ-এর সময় জ্বর সর্দি কাশি সমস্যা প্রতিরোধ করে কুল। জীবের স্বাদ আনার পাশাপাশি হজম শক্তি বাড়ায় কূল। শুকনো কূলে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি থাকায় আর্থারাইটিস রিউমেটিজম গাউট ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে উপকারী।
দাঁত শক্ত মজবুত রাখতে ও দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করতেও সাহায্য করে কুল। তাজা কুলে ভিটামিন-সি রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, টিউমারের মত মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে কুলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রেও কুলের উপকারিতা উল্লেখযোগ্য। খুব দ্রুত অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে।
উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যেও উপকারী কুল। ১০-১৫ গ্রাম শুকনো কুল তিন কাপ জলে সেদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সামান্য সাদা দই ও দু-চামচ আনারের রস-সহ খেলে ডায়রিয়ায় উপকার পাওয়া যায়। রক্তশূন্যতা, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদিতে কুলের জুড়ি মেলা ভার।
মৌসুমী সব রকম ফল শরীরের পক্ষে উপকারী। তবে কোনো ফল-ই ১০০ শতাংশ পেস্টিসাইড মুক্ত নয়। তাই নিজেরও পরিবারের সকল সদস্যের স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য বাজার থেকে কেনা ফল ভালোভাবে কলের জলধারায় ধুয়ে নিতে হবে এতে ফলের ত্বকে ও ত্বকের নিচে থেকে যাওয়া কীটনাশক অনেকটা মুক্ত করা সম্ভব হয়। দেখা গেছে ১০% লবণ জলে খাবার সোডা বা ভিনিগার মিশিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় ধরে ভিজিয়ে রাখলে ফলের পেস্টিসাইড থেকে অনেকটা মুক্ত হওয়া যায়। ফল কাটার আগে ধোবেন, কেটে ফেলার পর ধোবেন না কেননা এতে জলে দ্রবণীয় ভিটামিন নষ্ট হয়। ফল সবসময় ধারালো ছুরি দিয়ে কাটবেন। ভোঁতা ছুঁড়ি দিয়ে কাটলে ফলের ফাইবার ও ভিটামিন দুই নষ্ট হয়।
ফলকে আরো সুস্বাদু করে খেতে অনেকেই লবণ বা মিষ্টি মিশিয়ে খান এতে ফলের খাদ্যগুণ বা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয় না তবে বেশি পরিমাণ লবণ খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। প্রবাদ আছে, “ফল খেয়ে খায় পানি /পেট বলে আমি না জানি” অর্থাৎ ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল থাকে এরপরও বাড়তি জল খাওয়ার ফলে এনজাইম সংযুক্তিতে বিঘ্ন ঘটায়। তাই ফল খেয়ে জল না খাওয়াই ভালো। যাদের অ্যাসিডিটির ধাত আছে রাত্রে টক ফল না খাওয়াই ভালো।
আমলকী : আবহাওয়া বদলের এই মরশুমে কষা স্বাদের সরস ফল আমলকিকে শীতের উপকারী বন্ধু বলা যায়। কাঁচা চিবিয়ে খান বা সেদ্ধ করে, রস করে বা আচার করে খান সবেতেই উপকার পাবেন। জানলে অবাক হবেন, পেয়ারা কাগজি লেবু, কমলালেবু, আম, আপেলের থেকে বেশি ভিটামিন-সি রয়েছে প্রকৃতির বিস্ময়কর উপহার আমলকীতে। আমলকী রোজ একটি করে খেলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বদহজম, এসিডিটি, কনস্টিপেশন, পাইলস, কনজাংটিভিটিস, ক্যাটারাক্ট, গ্লুকোমা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, ত্বকের দাগছোপ, একজিমা, বলিরেখা, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস অনুসরণের পাশাপাশি নিয়ম করে আমলকী খান। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর হাওয়ায় শরীরে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে।
পানিফল: শরতের শুরু থেকেই বাজারে সিঙ্গারার মতো দেখতে অঢেল পানিফলের দেখা মেলে। দামে সস্তা হলেও গুনে অসামান্য। পানিফলের মধ্যে জন্ডিস, আর্থ্রাইটিস, হাইপারটেনশন, কার্ডিয়াক রিস্ক, অনিদ্রা, অ্যান্টি ভাইরাল, হাম জ্বর, ডায়েরিয়া কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে। গর্ভবতী মায়েরা নিয়মিত পানি ফল খেলে গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে।
আতা: শীতকালীন সুপরিচিত এবং সুস্বাদু ফল হলো আতা। ফলের ভিতরে থাকে ছোট ছোট কোষ। প্রতিটি কোষের ভেতরে থাকে একটি করে বীজ, বীজকে ঘিরে থাকা নরম ও রসালো অংশই খেতে হয়। পাকা ফলের বীজ কালো এবং কাঁচা ফলের বীজ সাদা এবং বিষাক্ত। আতার খাদ্য আঁশ হজম শক্তি বৃদ্ধি করে পেটের সমস্যা দূর করে। ভিটামিনে ভরপুর আতা দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। আয়রনে পরিপূর্ণ হওয়ায় অ্যানিমিয়া দুর করে। হাড় মজবুত করে, ত্বক ও চুলের যত্ন করে। আতায় থাকা ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশির জড়তা দূর করে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। তবে ডায়াবেটিক রোগীদের আতা খাওয়া উচিৎ নয়।
মরশুমী ফলের পুষ্টিতে পরিপুষ্ট হোক সকলের পরিবার। সবাইকার সুস্থতা কামনা করে ইতি টানলাম।