দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুর্মুখরা নানা বিতর্কের সৃষ্টি করতে চাইছেন। আসলে এই মন্দির নির্মাণের ভাবনা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, পর্যটন শিল্প কিংবা বাণিজ্যিক দিক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বড় মাস্টার স্ট্রোক। সত্যি কথা বলতে কী, রামমন্দির নিয়ে হিন্দি বলয়ে আলোড়ন হলেও বাঙালির আবেগকে তা খুব বেশি মথিত করতে পারেনি। কেননা শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে বাঙালির কিছুটা দূরত্ব আছে। বরং বাঙালির অনেকখানি প্রাণের দেবতা প্রভু জগন্নাথ। বাংলার বাইরে পুরীর জগন্নাথ, কাশীর বিশ্বনাথ, অসমের দেবী কামাখ্যা কিংবা কাশ্মীরের অমরনাথের প্রতি বাঙালির অসীম টান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বহুমাত্রিক উদ্দেশ্যপূরণে সফল হয়েছেন।
মমতার এই পদক্ষেপ কতটা সুচিন্তিত, তা আগামী দিনে মানুষ বুঝতে পারবেন। অবশ্য সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক ভাবনার দাসত্ব করলে, তা বোঝা সম্ভব নয়। তবে এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, বারবার মন্দির নির্মাণ ও সংস্কারে এগিয়ে এসেছে দেশের নারীশক্তি। রাজধর্ম পালনের পাশাপাশি মহীয়সী নারীরা ধর্মের সম্ভ্রম রক্ষায় ব্রতী হয়েছেন। তবে তাঁদের কাছে ধর্ম কখনওই আগ্রাসনের অস্ত্র হয়ে ওঠেনি। বরং তাঁদের কাছে ধর্ম ছিল শাসকের বরাভয়, কল্যাণের পথ এবং মানবতার মন্ত্র।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে মহীয়সী নারীর কথা বলতে হয় তিনি হলেন মালওয়া রাজ্যের রানি অহল্যাবাঈ হোলকার। এবছর তাঁর ত্রিশত জন্মবার্ষিকী। ১৭২৫ সালে তাঁর জন্ম। মালওয়ার রাজা মলহার রাও হোলকার চলেছেন পুনের পথে। যাত্রাপথে বিরতি নিলেন চৌণ্ডিতে। এক মন্দিরের পাশে তাঁবু গাড়লেন। সেখান থেকে মন্দিরের দৃশ্য দেখে তিনি চমৎকৃত হলেন। দেখলেন একটি আট বছরের মেয়ে মন্দিরে অনেক ক্ষুধার্ত দীনদরিদ্র মানুষকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। ওইটুকু মেয়ের মধ্যে সাহস, দয়া এবং মাতৃরূপ দেখে মলহার সিদ্ধান্ত নিলেন, এই মেয়েকেই তিনি পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে যাবেন। সেই মতো তিনি তাঁর পুত্র খান্দেরাওয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। স্বামী, শ্বশুর এবং একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর অহল্যাবাঈ যখন সিংহাসনে বসেন, তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। তাঁর প্রজ্ঞা, রণকৌশল এবং ধর্মপ্রাণ সত্তাকে সম্মান জানিয়ে ব্রিটিশরা তাঁকে ‘দ্য ফিলোজফার কুইন’ নামে অভিহিত করেন।
অহল্যাবাঈ হোলকারের কথা বললেই চলে আসবে বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির প্রসঙ্গ। বারাণসীর মন্দিরের ক্ষতি হয়েছিল কুতুবুদ্দিন আইবকের হাতে। তিনি ছিলেন মহম্মদ ঘুরির সেনাপতি। ঘুরি তাঁকে পাঠালেন বারাণসী জয় করতে। যুদ্ধে প্রাণ দিলেন বারাণসীর রাজা জয়চন্দ্র। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দির সংস্কার করেন ইলতুৎমিস। এরপর মন্দিরের আংশিক ধ্বংস করেন সিকান্দার লোধি। পরবর্তীকালে মন্দিরের সংস্কার করার জন্য আকবর নির্দেশ দেন টোডরমলকে। তার জন্য রাজকোষ থেকে বরাদ্দ করা হয় ৪৫ হাজার দিনার। আরও পরে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব বলেন, ‘আমাদের অর্থসাহায্যে এটা তৈরি হয়েছে। তাই আমরা এটা ভেঙে মসজিদ বানাব।’ সেই লক্ষ্যে ১৬৬৯ সালে মন্দির ভেঙে সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণ করেন।
তার ১১১ বছর পর ১৭৮০ সালে বারাণসীর ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের নবনির্মাণ ও সংস্কার করেন ইন্দোরের রানি অহল্যাবাঈ। কথিত আছে, একদিন রাতে অহল্যাবাঈ স্বপ্নাদেশ পেলেন। তাঁকে শিব বললেন, ‘নর্মদা নদীতে গিয়ে প্রথম প্রহরে তুই স্নান করবি। স্নান করার সময় তোর হাতে উঠে আসবে একটি শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গকে আমি আমার জ্যোতি দিয়ে জ্যোতির্লিঙ্গ করে তুলব।’ সেই নির্দেশ মেনেই তিনি মন্দিরে শিবের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯১ সালে তিনি মণিকর্ণিকা ঘাটের পুনর্নির্মাণ করেন।
অহল্যাবাঈ দ্বারকায় সোমনাথ মন্দিরেরও সংস্কার সাধন করেন। ১৬৬৫ এবং ১৭০৭ সালে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেন ঔরঙ্গজেব। এখানেও মন্দিরের সংস্কার করেন অহল্যাবাঈ। ১৭৬৩ সালে তিনি সেখানে আর একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেটির নাম অহল্যাবাঈ শিবমন্দির। সারাদেশে তিনি শতাধিক মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন। তীর্থযাত্রীদের জন্য নির্মাণ করেছিলেন ধর্মশালা। রাজকোষের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ তিনি ব্যয় করতেন মন্দির নির্মাণ এবং সংস্কারের কাজে। অহল্যাবাঈ ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর সমস্ত রাজকীয় ঘোষণাপত্রের শিরোনাম হিসাবে লেখা থাকত ‘শ্রীশঙ্কর’।
আর একটু পিছিয়ে যাই। দিল্লির মসনদে তখন মুঘল সম্রাট আকবর। বর্তমান হাওড়া এবং হুগলি জেলা নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট রাজ্য। ভবশঙ্করীর জন্ম হাওড়ায় খুব সাধারণ ঘরে। তাঁর বাবা ছিলেন পেঁড়ো দুর্গের সেনাপতি। তাই ছেলেবেলা থেকেই তিনি শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়া, অস্ত্রবিদ্যা। সেই সঙ্গে রাজনীতি, কূটনীতি এবং শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ। একদিন তিনি যখন জঙ্গলে শিকারে গিয়েছিলেন। সেই সময় দামোদরে নৌকায় চেপে যাচ্ছিলেন ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ। তাঁর চোখে পড়ে একটি মেয়ে জঙ্গলের মধ্যে বুনো মোষের সঙ্গে লড়াই করছেন। তাই দেখে তিনি স্থির করেন, এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন। বিয়ের পর রাজকুমার প্রতাপনারায়ণের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন মৃত্যু হয় রাজার। বিধবা ভবশঙ্করী নিজের হাতে তুলে নেন রাজ্যশাসনের ভার।
তাঁর বীরত্বের সামনে পরাস্ত হন পাঠান সেনাপতি ওসমান খান। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আকবর তাঁকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধি দিয়ে একটি সোনার তলোয়ার উপহার দেন। রাজবংশের কুলদেবতা ছিলেন রাজবল্লভী। তাঁর নামেই রানি ভুরশটের রাজধানীর নামকরণ করেন রাজবলহাট। তিনি রাজবল্লভীর অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। বিধূভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর ‘রায়বাঘিনী ও ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী’ বইতে লিখেছেন, ‘রক্তবস্ত্র পরিহিতা এই রমণী যখন শূলহস্তে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করতেন, মনে হতো, মানবীরূপে মহেশ মনোমোহিনী মহা শক্তিরূপিনী, মহিষমর্দিনী দুর্গা দনুজ দলন করবার জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন।’
আর এক মহিয়সী নারীর কথা বলতে হয়। তিনি হলেন রানি শঙ্করী। রাজা নৃসিংহদেব রায় বাঁশবেড়িয়ায় হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন ১৭৯৯ সালে। কিন্তু ১৮০২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর মন্দির নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই কাজ দৃঢ়তার সঙ্গে শেষ করেছিলেন রানি শঙ্করী। অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যের নিদর্শন এই মন্দিরটি বাঁশবেড়িয়ার গৌরব বাড়িয়েছে। এই মন্দিরের সুখ্যাতি শুনে দেখতে এসেছিলেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক তথা কবি জন আলেকজান্ডার চ্যাপম্যান। তাঁকে অবশ্য মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তিনি বাইরে থেকেই মন্দিরের সুষমা প্রত্যক্ষ করেন এবং হংসেশ্বরী মন্দির নিয়ে একটি কবিতা লেখেন। সেটি রয়েছে তাঁর ‘রিলিজিয়াস লিরিকস অব বেঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থে। কবিতার মূল কথাই হল— ‘আমি এক বিধর্মী, তাই মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে এর শিল্পসুষমা অনুভব করছি। আমি অভিভূত! এর শিল্পশৈলীর বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু নির্বাক হয়ে দু’নয়ন ভরে দেখছি আর হৃদয় দিয়ে এক পরম সত্যকে অনুভব করছি।’
এর বেশ কয়েক বছর পর আর এক মহীয়সী নারী রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেন দক্ষিণেশ্বর মন্দির। ১৮৪৭ সালে রানি রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণা দর্শনে কাশীযাত্রা করেন। কিন্তু কাশী গিয়ে তাঁর মাতৃদর্শন হল না। যাত্রার পূর্বরাত্রে দেবী কালিকা তাঁকে স্বপ্নে বলেন, ‘কাশী কেন যাবি? এখানেই গঙ্গার তীরে আমার মন্দির গড়ে আমায় প্রতিষ্ঠা কর।’ দক্ষিণেশ্বরে ২০ একরের একটি প্লট তিনি জন হেস্টি নামে এক সাহেবের কাছ থেকে কিনে নিয়ে মন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন। সেখানেই মন্দির গড়ে ১৮৫৫ সালে ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন দেবী ভবতারিণীর প্রতিষ্ঠা করলেন। তবে সেই পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। সেই সময় গোঁড়া ব্রাহ্মণরা মন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন। একজন কৈবর্ত কি না মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে! সেই রাগে তাঁরা রানির মন্দির বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস সেই ব্রাহ্মণ্য অহমিকাকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে।
নাটোরের রানি ভবানী রাজকার্যে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। নাটোরের রাজা রামকান্ত রায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু ১৭৪৮ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন। পরে জামাতাকে রাজ্যের দায়িত্ব দেন। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর পরিহাস যে, জামাতার অল্প বয়সে মৃত্যু হলে ফের তিনি রানি হন। তাঁর রাজত্বের মধ্যে ছিল নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্ঠিয়া, রংপুর, বীরভূম, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চল। এজন্য তাঁকে বলা হতো ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’।
রানি হলেও তিনি সাধারণ বিধবা বেশে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তিনি তাঁর রাজত্বে অনেকগুলি মন্দির, অতিথিশালা নির্মাণ করেন। ভক্তদের কাশী যাওয়ার সুবিধার জন্য বেনারস রোড নামক রাস্তাটি তৈরি করেন। তিনি তারাপীঠ মন্দিরের সংস্কার সাধন করেন। মুর্শিদাবাদের বড়নগরে তিনি ১০০টি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। কালের প্রবাহ তার অনেকগুলি ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে দিয়েছে।
আমাদের সমাজ পুরুষশাসিত হলেও আমরা মূলত মাতৃ আরাধনাই করি। কিন্তু ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়ে বলেছে, মেয়েরা যদি শাসক হন, তবে তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেন। ইতিহাস বলছে, ধর্মস্থাপনের কাজে পুরুষদের থেকে মেয়েরা কম গৌরব অর্জন করেননি। ইতিহাসের সেই ধারায় শেষ নিদর্শন দীঘায় জগন্নাথদেবের মন্দির।