মাসমাইনে পাঁচ টাকা, সেই সঙ্গে বছরে ছ’খানা ধুতি ফ্রি। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পুরোহিত রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। সে যুগের নিরিখে যা ছিল বাজারছাড়া মাইনে।
এখনও দু’শো বছর হয়নি, তবু রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দির কেন ভক্তজনের হৃদয়ে এই ভাবে বিশেষ স্থান অধিকার করে বসল এবং কেন এই মন্দির-মহিমা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, তা খোঁজ করা সহজ কাজ নয়। এই মন্দিরের ইউএসপি কী তা নিয়ে নানা মহলে নানা মতামত। অনুসন্ধানীদের কাছে যে কারণটি শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, মন্দিরময় ভারতে এত দিন কেবল প্রতিষ্ঠিত দেবতা অথবা দেবীরই আধিপত্য এবং জয়ধ্বনি। কিন্তু গঙ্গাতীরের দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক পাগল পুরোহিতও জগন্মাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভক্তজনের হৃদয়ে এমন একটি স্পেশ্যাল স্থান অধিকার করে বসলেন, যা আগে কোথাও হয়েছে বলে কেউ শোনেনি। এই একমাত্র জায়গা যেখানে পাঁচ টাকা মাইনের পুরোহিতও দেবতার আসনটি অধিকার করে বসলেন।
মাইনে দিয়ে মানুষের মাপ করার রীতি এ দেশে অনেক কাল থেকে চলেছে, তাই ঠাকুরের মাইনের পরিমাণটা অনেককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। কেউ যখন শোনে সত্যিই মাসিক স্যালারি ফাইভ রুপিজ তখন একটু অস্বস্তি হয়, একটু খোঁজখবর একটু বিশ্লেষণ পাওয়ার জন্য অনেকে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
ঠাকুরের মাইনের পরিমাণ, তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এ সব কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে? যা জানি, তা সবিনয় নিবেদন করছি।
কথামৃত রচয়িতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর কথামৃতের শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকথা সংক্ষেপে বলতে গিয়ে একটি বিস্তারিত ফুটনোটের অবতারণা করেছেন এবং সেখানেই তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। ১৮৫৮ সালে রানি রাসমণির বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী আমাদের ঠাকুর ওরফে ‘রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য’ মাইনে পাচ্ছেন মাসিক পাঁচ টাকা। তাঁর ভাগ্নে ‘পরিচারক’ হৃদয় মুখার্জির বেতন সাড়ে তিন টাকা। এঁর বাড়তি দায়িত্ব ছিল ফুল তোলার। এ ছাড়া বরাদ্দ তিন জোড়া কাপড়, যার মূল্য সাড়ে চার টাকা। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খোরাকি হিসেবে সিদ্ধ চাল, ডাল, তামাক, কাঠ ও দু’খানা পাতা।
এত বড় ধনবতীর মন্দিরে পুরুতের মাইনে ‘মাত্র’ পাঁচ টাকা দেখে যাঁরা ইদানীং নাক বেঁকান, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, সে কালে ভুবনবিদিত বেঙ্গল ব্যাঙ্কের কেরানিরাও এর থেকে বেশি মাইনে পেতেন না। ‘দখিনশোর’-এর তৎকালীন শ্রীশ্রীরাধাকান্তজির পুরোহিত তো সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন বিনামূল্যে বাসস্থান! পরে কাশীপুর পর্বে লীলাপ্রসঙ্গে ঠাকুর নিজেই বলছেন, রানির আমলেই তাঁর মাইনে দাঁড়ায় সাত টাকা। পরে তা মাসিক পেনশনে দাঁড়ায়, যাকে ঠাকুর ‘পেন্সিল’ বলতেন, সেই সঙ্গে অবশ্যই দেবতার প্রসাদ।
প্রথম পর্বে শ্রীশ্রীকালীর পূজক ছিলেন ঠাকুরের খুড়তুতো ভাই হলধারী অর্থাৎ রামতারক। কথামৃতকারের সংযোজন: বলিদান হয় বলিয়া পরের বছর দায়িত্ব বদলাবদলি, হলধর (রামতারক ভট্টাচার্য) রাধাকান্তের সেবায় এবং শ্রীরামকৃষ্ণ কালীঘরে। বলা বাহুল্য, এই সময়েই (১৮৫৯) তাঁর বিবাহ। পাত্রীর আদি নাম ক্ষেমঙ্করী, পরে পারিবারিক কারণে নাম পরিবর্তন করে সারদামণি (কথামৃতকার শুরুতেই এই সম্পর্কটিকে ‘নামমাত্র’ বিবাহ বলেছেন!)
পুরোহিতের এই বাজারছাড়া বাড়তি মাইনের কারণ অনুসন্ধান করাটা অন্যায় হবে না। তখন তো পুরুত নির্বাচনে ‘মেরিটের’ তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। কারণটা জানা থাকলে দক্ষিণেশ্বর এবং সে যুগের জাতবিচার-সমস্যাটা বুঝতে সহজ হয়।
রানি রাসমণি নিষ্ঠাবতী কিন্তু তিনি শূদ্র বংশের মেয়ে ও বধূ। মন্দির তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি শাস্ত্রীয় মতে ত্রিসন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন ভোজন, মাটিতে শয়ন ও যথাশক্তি জপপূজাদি করতেন। যত শীঘ্র দেবীপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যখন ব্যাকুল, তখন বাংলার ব্রাহ্মণ সমাজের একাংশ বাগড়া তুললেন, শূদ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠার কোনও অধিকার নেই। সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি: প্রথার বিরুদ্ধে কাজ করলে ব্রাহ্মণ সজ্জনেরা নতুন দেবালয়ে উপস্থিত হয়ে প্রসাদ গ্রহণ করবেন না। এ দিকে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে নিত্য অন্নভোগ দেওয়ার জন্য রানি ব্যাকুল। দূত পাঠিয়ে নানা জায়গা থেকে তিনি পণ্ডিতদের ব্যবস্থা আনালেন, কিন্তু কেউই তাঁকে তেমন উৎসাহ দিলেন না।
এই সময় গদাধরের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ঝামাপুকুরে টোল খুলেছেন, ছোট ভাইকে কলকাতায় আনিয়েছেন এবং তিনি দিগম্বর মিত্র প্রমুখ কয়েক জন বিশিষ্ট অব্রাহ্মণের বাড়িতে নিত্যপূজা করছেন। এই রামকুমার বিধান দিলেন, রানির মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার আছে।
ভাল কাজে প্রাথমিক বাধা দেওয়ার ব্যাপারে সর্বযুগেই বাঙালিরা যে বিশেষ ভাবে অভ্যস্ত, তার আর একটি প্রমাণ এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির-উদ্বোধন। শোনা যায়, নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে রামকৃষ্ণের দাদা রানির প্রতিনিধিদের বলেন, কৈবর্তজাতীয়ার নিমন্ত্রণ ও দান গ্রহণ করলে তাঁকে ‘একঘরে’ হতে হবে।
রানি কিন্তু কৈবর্ত নন, মাহিষ্য সম্প্রদায়ের। শেষ পর্যন্ত রানির বিশ্বস্ত ও সুদক্ষ কর্মীদের হস্তক্ষেপে সমস্যার সাময়িক সমাধান হয় এবং রামকুমার তাঁর ভাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠাদিবসের এক দিন আগে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। রানির উদ্যোক্তারা আগেই বোঝেন পূজক পেতে অসুবিধা হতে পারে, তাই তাঁরা বাজারদরের থেকে সামান্য বেশি মাইনে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে ভাইপো রামলাল এবং ভাগ্নে হৃদয়রামের কিছু পরস্পরবিরোধী বিবরণ আছে। মোদ্দা কথাটা হল, উদ্যোক্তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে দাদা রামকুমার এক সময় পূজকের পদ গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যান। দাদার সঙ্গে আমাদের ঠাকুরও সম্ভবত প্রতিষ্ঠার দিনে নয়, তার আগের দিনে দক্ষিণেশ্বরে আসেন। দাদা হৃষ্টচিত্তে দক্ষিণেশ্বরের প্রসাদী নৈবেদ্যান্ন গ্রহণ করলেও ভ্রাতা গদাধর স্থানীয় বাজার থেকে এক পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনে খেয়ে, ঝামাপুকুরে ফিরে আসেন। ঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে শুনে লীলাপ্রসঙ্গের লেখক স্বামী সারদানন্দ আরও জানিয়েছেন, দক্ষিণেশ্বরের পরিবর্তে প্রথমে বালি-উত্তরপাড়ায় মন্দিরের জমি নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জমিদাররা জানান, তাঁরা অন্য জমিদারকে গঙ্গায় ঘাট তৈরি করতে দেবেন না।
বাইরে খাওয়াদাওয়া এবং নিয়মকানুনের ব্যাপারে রামকৃষ্ণ যে তাঁর থেকে ৩১ বছরের বড় দাদা রামকুমারের থেকে বেশি সাবধানী ছিলেন, তার বর্ণনা নানা জায়গায় রয়েছে। সতেরো বছর বয়সে দাদাকে সাহায্য করতে তিনি ঝামাপুকুরে এলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর বয়স ১৯ বছর। প্রতিষ্ঠার পরদিন সকালে নিষ্ঠাবান রামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে আসেন, কিন্তু দাদার পরামর্শে কান না দিয়ে ভোজনকালে আবার ঝামাপুকুরে ফিরে যান। এক সপ্তাহ পরে আবার এসে তিনি জানতে পারেন, রানির ‘সনির্বন্ধ অনুরোধে’ দাদা রামকুমার স্থায়ী ভাবে জগদম্বার পূজকের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ বারেও দাদার অনুরোধ সত্ত্বেও পূজাবাড়ির প্রসাদ নিলেন না। তখন রামকুমার বললেন, “সিধা নিয়ে পঞ্চবটীতলে গঙ্গাগর্ভে নিজের হাতে রান্না করে খাও।” এই ভাবে আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুকাল স্বপাকে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রায় এক মাস এই ভাবে রান্না চলে বলে আমাদের অনুমান। এই সময় ১৬ বছরের ভাগ্নে হৃদয় দক্ষিণেশ্বরে হাজির হয়, ঠাকুর তখন সবে বিশ বছরে পা দিয়েছেন। হৃদয়ের বিস্তারিত রিপোর্ট অনুযায়ী, শ্রীরামকৃষ্ণ দুপুরে পঞ্চবটীতে পাক করলেও রাত্রে প্রসাদী লুচি খেতেন এবং জগদম্বাকে বলতেন, “মা, আমাকে কৈবতের্র অন্ন খাওয়ালি।” লীলাপ্রসঙ্গের মতে, এক সময় গরিব কাঙালরাও দক্ষিণেশ্বরে খেতে আগ্রহী ছিল না এবং খাওয়ার লোক না জোটায় প্রসাদী অন্ন গরুকে দেওয়া হত বা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হত। (ক্রমশ)