২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের গড়ে ওঠার পর্বটি বেশ চমকপ্রদ। নদিয়া জেলার চাপড়া জনপদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস অধিক। তুলনামূলকভাবে একটু পিছিয়ে পড়া জনপদ এটি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এই জনপদে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছে। তবে একবিংশ শতকের আগে পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই জনপদে ছিল না। উদ্যোগ যে গ্রহণ করা হয়নি তা নয়। ১৯৮৯ সালে চাপড়ার নাগরিক কমিটি হাট চাপড়া কিং এডওয়ার্ড হাইস্কুলে একটি নাগরিক কনভেনশন করে উচ্চশিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। জমির অভাব ছিল একটি বড়ো সমস্যা। উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী নতুন কলেজ স্থাপনের জন্য কমপক্ষে চার একর জমি প্রয়োজন ছিল। তাই বিভিন্ন কারণে তখনকার সেই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীতে বাঙ্গালঝি বাজার বারোয়ারী কমিটির কাছ থেকে সেই জমি পাওয়া যায়। বাঙ্গালঝি বাজার বারোয়ারী কমিটির পক্ষ থেকে শ্যামসুন্দর তরফদার, রাধিকাপ্রসাদ সাহা, গোপালচন্দ্র কুণ্ডু, উদয় কুণ্ডু, কার্তিক দত্ত, আনন্দময় কুণ্ডু এবং নিমাই প্রামাণিক কলেজের জন্য ৪.৬ একর জমি দানের লিখিত সম্মতি প্রদান করলে চাপড়া এলাকায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ২০০০ সালের ২৮ জুন চাপড়া সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের নামে সেই জমি রেজিষ্ট্রি হয়। উচ্চশিক্ষা দপ্তরের আরো যেসব শর্ত ছিল, সেগুলি মেনে অবশেষে ২০০১ সাল থেকে পার্শ্ববর্তী বাঙ্গালঝি স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস শুরু হয় এবং এভাবেই চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় গড়ে ওঠে। আর এই প্রতিষ্ঠানের সেই ইতিবৃত্তই লিপিবদ্ধ হয়েছে ইসমাইল শেখের লেখা ‘চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়: স্থাপনকল্পের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে।
‘চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়: স্থাপনকল্পের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি স্বল্প কলেবরের হলেও, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়কে নিয়ে এহেন গ্রন্থভাবনা এই প্রথম। সেই কারণে এই উদ্যোগকে প্রথমেই কুর্নিশ জানাতে হয়। লেখক ইসমাইল শেখ ছোটো ছোটো এগারোটি অধ্যায়ে গ্রন্থটিকে সাজিয়েছেন। প্রথম অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, দ্বিতীয় অধ্যায়: মহাবিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশে আয়োজিত প্রথম সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ, তৃতীয় অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের নামকরণ, চতুর্থ অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের নামে দানপত্র দলিল রেজিস্ট্রিকরণ, পঞ্চম অধ্যায়: উচ্চ শিক্ষা দপ্তরে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব প্রেরণ, ষষ্ঠ অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের আঁতুড়ঘর বাঙ্গালঝি স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির, সপ্তম অধ্যায়: মহাবিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ, অষ্টম অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের অনুমোদন, নবম অধ্যায়: মহাবিদ্যালয়ে পঠনপাঠন শুরুর প্রস্তুতি, দশম অধ্যায়: অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ এবং একাদশ অধ্যায়: চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। এরপরে রয়েছে গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশটি, যেখানে নাতিদীর্ঘ তিনটি লেখা স্থান পেয়েছে। পরিশিষ্ট ১-এ রয়েছে ‘উন্নয়নে অধ্যক্ষের ভূমিকা’: জাহানদার শেখ (কলেজের প্রধান করণিক)। পরিশিষ্ট ২-এ রয়েছে ‘কি করে কলেজ হল এবং কতটা হল’: মিরকাশেম মণ্ডল (সভাপতি, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় পরিচালন সমিতি), এবং পরিশিষ্ট ৩-এ রয়েছে ‘পুরানো সে দিনের কথা’ : মমতাজ মল্লিক (শিক্ষাকর্মী, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়)।
এই গ্রন্থে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা-পর্বটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। চাপড়া জনপদের এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমাহার হয়ে রইল এই গ্রন্থটি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, সেটি হলো যাঁদের বদান্য আর্থিক অনুদান চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। লেখক ইসমাইল শেখের দেওয়া সেই তালিকাটি এইরূপ — ১) তরফদার অ্যান্ড সন্স, ২) কৃষ্ণনগর লরি মালিক সমিতি, চাপড়া শাখা, ৩) চাপড়া থানা পাট ব্যবসায়ী সমিতি, ৪) চাপড়া থানা তহবাজার সমিতি, ৫) হাটখোলা হাই মাদ্রাসা, ৬) বেতবেড়িয়া জুনিয়র হাই স্কুল, ৭) বড় আন্দুলিয়া হাই স্কুল, ৮) পুখুরিয়া হাই স্কুল, ৯) ছোটো আন্দুলিয়া আঞ্চলিক বিদ্যাপীঠ, ১০) বাঙ্গালঝি স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির, ১১) বহিরগাছি বাগমারা হাই স্কুল, ১২) মধুপুর এফ. পি. এ. হাই স্কুল, ১৩) হাতিশালা হাই স্কুল, ১৪) হুদা বিদ্যাপিঠ হাই স্কুল, এবং ১৫) হাট চাপড়া গার্লস হাই স্কুল।
গ্রন্থের প্রথম ও চতুর্থ প্রচ্ছদ জুড়ে রয়েছে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের ছবি। চতুর্থ প্রচ্ছদে কলেজের ছবির পাশাপাশি লেখকের ছবি-সহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও রয়েছে। গ্রন্থটি চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের প্রাণপুরুষ প্রয়াত মীরকাশেম মণ্ডলের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছেন চাপড়া-নিবাসী যতীন্দ্র-রাজেন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের (আমতলা, মুর্শিদাবাদ) ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কুতুবউদ্দিন বিশ্বাস। গ্রন্থটির প্রকাশক নতুন গতি প্রকাশনী (৮৮ তালতলা লেন, কলকাতা-১৪)। গ্রন্থস্বত্ব রয়েছে আছিয়া শেখের নামে। গ্রন্থের অক্ষর বিন্যাসে গতি লেজার প্রিন্ট (৮৮ তালতলা লেন, কলকাতা ১৪) এবং মুদ্রণে পারফেক্ট সার্ভিসেস (৫বি এন্টনিবাগান লেন, কলকাতা-৯)।
উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটি নির্মাণে তথ্যসূত্র হিসেবে লেখক একাধিক উপাদান ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের রেজোলিউশন খাতা, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ, মহাবিদ্যালয়ের দলিল দস্তাবেজ, বার্ষিক পত্রিকা ‘চরৈবেতি’ প্রভৃতি। বাঙ্গালঝি স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসমাইল শেখের তৃতীয় মৌলিক গ্রন্থ এটি। তিনি প্রধান শিক্ষক থাকাকালেই তাঁর স্কুলে চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল। আর সেক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর বিশেষ ভূমিকার কথাও স্বীকার করে নিতে হয়। সবশেষে এই গ্রন্থ সম্পর্কে আরেকটি বিষয় বলতেই হয় যে, নদিয়া জেলার চাপড়া জনপদের এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রজতজয়ন্তী বর্ষ (২০০১—২০২৫) যেখানে নীরবে অতিবাহিত হচ্ছে, সেখানে তার ইতিহাস অনুসন্ধানের এহেন প্রচেষ্টা এককথায় অনবদ্য। স্থানিক ইতিহাসচর্চায় এই গ্রন্থ তার স্বতন্ত্র জায়গা অর্জন করে নেবে নিশ্চয়।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়।