সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়, মধুবাবু এখনো আসেনি। এমন তো হবার কথা নয়। জগতের অন্যান্য ক্রিয়াকর্মে মধুবাবু কর্তব্য অবহেলা, আলসেমি থাকলেও প্রাক-সন্ধ্যায় সাত তাড়াতাড়ি কাঁঠালতলায় বছির মিয়ার এ গেরেজ উপস্থিতি নিরানব্বই শতাংশ। মধুবাবু শ্যামগঞ্জ চা বাগানের টালি ক্লার্ক। পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অফিসের সব কাজ-কর্ম গুছিয়ে দে ছুট রেলস্টেশনে। পাঁচ কিলোমিটার পথ। ট্রেনে উঠলে দশ মিনিটের মতো লাগে। আবার ট্রেন লেট করলেও চিন্তা নেই। সুরকি বিছানো পথ ধরে টেম্পুতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে বছির মিয়া ঐতিহাসিক গেরেজে ফুলবাবুর মতো হাসতে হাসতে ঢুকেই বলে, ‘কী গো, রাজসিংহাসন এমন পরিত্যক্ত থাকলো তো চলবে না। যে কোনো সময় বেদখল হবার সম্ভবনা। মিস্ত্রিসাব আসে নাই?’
গেরেজ মালিক বছির মিয়া জানে মধুবাবু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বেলাল শেখকে সহ্য করতে পারে না। সব সদস্যই জানে। তাই ব্যাঙ্গ করে মিস্ত্রিসাব বলে ডাকে।
চিত্রকর সাজু ভাই বলে, ‘মধুবাবু, আপনার এ কথা শোনলে বেলাল মিয়া তো আপনার টিকি ঝাঁপটে ধরবে।’
মধুবাবু কোনো মন্তব্য করে না। শুধু উশখুশ করে। নিজকে মিলাতে পারে না। সন্ধ্যেবেলাটা তার নিকট মিথ্যে মনে হয়।‘কবি সাব আসে নাই?’
বছির মিয়ার একান্ত অনুগত কাজের ছেলে ফজল বলে, ‘না কাকা আজ তো কারো সাক্ষাৎ দেখছিনে? তবে এসে যাবে? আপনি চা-তামাক খেতে শুরু করেন। উনারা এসে যাবেন।’
‘মতিন সাহেবের ঠেকা পরছে আসার জন্য। কী এমন ব্যবহার তোমার বছির উদ্দিন আহমেদের। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই জীবনে আর আসবো না।’
‘বাবু না আসলেই পারেন।’
‘এক চড় দিয়ে দাঁতের হালি ছুটিয়ে দেবো। বদমাইশ মুখে মুখে কথা বলে। বেয়াদব।’
ফজল জানে, আর দু’মিনিট পর বাবু বলবে, ‘বাবা ফজল, নারকেলের সোবা, কাটনি, কলকে একটু দাও তো সোনার বাপ আমার।’ মধুবাবুর বয়স তিরিশ। বিয়ে করেছিলো, ব্রাহ্মণ কন্যা অর্চনাকে। অর্চনা এসএসসি পাস। সুন্দরী। কৃষ্ণ নয়না। বিয়ের প্রথম বছর কন্যা বিমলাকে জন্ম দিয়েই খালাস। এক বছরের কালে অর্চনা জাত-ধর্ম ত্যাগ করে, বিমলাকে সাত সমুদ্দুরে নিক্ষেপ করে অফিসের তরুণ অফিসার সোহান কাজীর সঙ্গে ভাগ গিয়া।’
কন্যা বিমলা এখন মধুবাবুর মা’র সঙ্গে সহবতপুর থাকে। সপ্তাহান্তে মধুবাবু কন্যা এবং জননীকে দেখে আসে।
না না মধুবাবুর বিয়ের শখ মরে গেছে। কী দরকার আবার ক্যাঁচাল জন্ম দেয়া। কী অপরাধ ছিল মধুবাবুর তা সে নিজেই জানতে পারেনি!
শুধু অর্চনা মাঝে মাঝে বলতো, ‘তোমার মতো একজন গাইয়া ভূতের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, এটা মনে পড়লেই আমার গা ঘিনঘিন করে ওঠে।’তারপর কাজী সাহেব অর্চনাকে নিয়ে লাপাত্তা। শ্যামগঞ্জের চা বাগান পরিত্যাগ করে অন্য কোম্পানি চলে গেছে। সঙ্গে গেছে অর্চনা। না মধুবাবু আইনি জটিলতায় যায়নি। লাভ কী! মধুবাবুর কেন যেন মনে হয়েছিলো, নারীরা চলে গেলে ফিরে আসে না। শুনেছে অর্চনা সুখেই আছে। সন্তান সম্ভাবা। না বিমলার খোঁজ রাখেনি। প্রথমদিকে খোঁজ রাখার আগ্রহ পোষণ করলেও মধুবাবু তাতে রাজি হয়নি।
বছির মিয়ার গেরেজের সদস্যবৃন্দ মধুবাবুর এ বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে না। মাতালদের মতো বিশ্রীরকম কান্নাকাটি করে। যত্তোসব ছেলেমানুষি আচরণ।বছির মিয়ার গেরেজের বৈশিষ্ট্য হলো ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা ঘেঁষে বিল পারে। সামনে বিস্তৃত ধানি জমি। ইরি ফলন করেছে। রাতের বেলায় চারদিকে ব্যাঙ ডাকাডাকি করে। টেম্পু, মোটর সাইকেল মেরামতের একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। বছির মিয়ার গেরেজের যে কোনো কাস্টমার জানে সব দেন-দরবার বেলা পাঁচটার আগে। তারপর কোনো বাণিজ্যে নেই। গেরেজের কারিগর দু’জন জানে না। কিন্তু ফজল জানে। সারাদিন ফজলের কোনো ডিউটি নেই। সন্ধ্যে পর ওর যত ডিউটি।
গেরেজের সদস্য সংখ্যা অত্যন্ত কম। পারমানেন্ট চারজন। টেম্পেরারি দু’জন। দু’জন আবার সরকারি দলের নামকরা ক্যাডার। হোন্ডায় চলাফেরা করে। হয়তো ইয়ারদের নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। মধুবাবু কান্নাকাটি করছে। কবিসাব তার সর্বশেষ লিখিত কবিতা পাঠ করছে। এ সময় হুইসেল বাজিয়ে তারা আসে।
অত্যন্ত সম্ভ্রম নিয়ে বলে, ‘বছির ভাই, আপনার এখানে শান্তি আছে?’
বছির মিয়া অত্যন্ত মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ‘কী বলেন ভাই! আপনারা হলেন গিয়ে এমপি সাবের লোক! আমার এই গেরেজ ধন্য।’
না না ভাই, বড়োই অশান্তি থাকি। কোথাও শান্তি পাই না। আপনার এখানে পাই।’
মধুবাবু মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘মুরব্বি গো জায়গা আহে ক্যা?’
ওরা কিছুই বলে না। হাসে।
কবি সাধ বলে, ‘হ্যালো, ইয়ংম্যান কবিতা হচ্ছে গিয়ে রাজনীতির একমাত্র হাতিয়ার।’
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সাজু ভাই বলে, ‘চিত্রকলা হচ্ছে এনশিয়েন্ট শিল্প মাধ্যম। পাঁচ হাজার বছর আগে ইলোরা অজান্তায় নির্দেশনা আছে। আর পিকাসে’র ‘গোয়ের্নিকা’ তো স্পেনের গৃহযুদ্ধের দলিল।’
এ সময় ইঞ্জিনিয়ার বেলাল শেখ বলে, ‘খুব তো গফ মারতাছেন। বিদ্যুৎ না বানাইলে তো ইটাক্ষেতে বসে হাগতে অইতো। দশ তলা বাড়ি বানাইলে কী, পানি উঠতো না। বাসিন্দারা হুড়মুড় কইরা ইটাক্ষেতে।’
সঙ্গে সঙ্গে মধুবাবুর রাগ চড়ে যায়।
কটমট করে তাকিয়ে বলে, ‘কী ফজল বাবা, তোগো মিস্ত্রি সাবের সব গেছে। দে ডিপ্লোমা ভাই সাবরে কড়া করে এক চিলিম দে!’
অমমধুর মেজাজ নিয়ে যখন ওরা গেরেজ থেকে বের হয় তখন রাত দশটা বেজে যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এক রিকশা ভ্যানে কবিসাব, সাজু ভাই, ইঞ্জিনিয়ার সাব বাড়ির পথ ধরে।
কোনো কোনো দিন বছির মিয়া গেরেজের তেল চিটচিটে তক্তোপোষের ওপর ঘুমিয়ে যায়। তার একান্ত ফজল মিয়া রাত জেগে তাকে পাহাড়া দেয়।
গোধূলি লগ্ন শেষ হবার সাথে সাথে এক ঘড়ির একটু খোয়া গোল চাঁদ উঠে এলো দূর পাহাড়ের গায়। ঈষৎ লালচে চাঁদ। রাতের কালো প্রকৃতির গায় দপদপে শাদা আলো ছাড়িয়ে দিচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার নৈশ সংগীত শুরু হয়েছে। এর মাঝে বিকট চিৎকার করে টেম্পু, লরি ছুটে যাচ্ছে।
ঠিক এ সময় মধুবাবু এলেন। ভ্যানে করে।
‘বাবা ফজল, ফুসফুস বাতাস চাইছে। বাপ ধন।’
কবি সাব তখন মুখ দিয়ে ভকভক করে ধোঁয়া ছেড়ে কলকে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘বাবু প্রথম এলেন। এক টান দিন।’
‘নিচিন্তপুর গিয়েছিলাম। বেগমের মাল নিয়ে এসেছি। দু’দিন যে কী মাল খেলাম। কোনো পিনিক হয়নি।’
ইঞ্জিনিয়ার সাব একটু শ্লেষ মিশিয়ে বলে, ‘আপনার এতো পিনিকের দরকার কি? ঘর নাই, সংসার নাই।’
মধুবাবু এ কথায় কান না দিয়ে বলে, ‘বাবা ফজল, তুমি আমাকে আগুনের আঙড়া দাও।’
বছির মিয়া বলে, ‘বড়ো ভাবনায় ছিলাম, বাবু আসবেন কি না?’
‘আরে আজ আসতে চাই নে। বলিভদ্র গিয়ে ছিলাম টিলা বাবুর জন্য কবিরাজ বন মণ্ডলের অলিপুক ব্যারামের ডাব পাড়ার জন্য। টিলা বাবু তো গনকেজ। বঙ্গ সেবন করে করে লিভার নাই হয়ে গেছে। লোক দিয়ে ডাব পড়া পাঠিয়ে দিয়েই নিচিন্তপুর বেগমের নিকট। ক্লাস সিদ্ধি।’
ছোট একটি রোল ফজলের দিকে এগিয়ে দেয় মধুবাবু। মুচকি হাসি দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাব বলে, ‘আদা একটু কম দিসরে ফজল। আদার রস দিয়ে ভিজিয়ে নিস। নইলে তো অজ্ঞান হয়ে থাকবো। বউ-পোলাপান কান্তে কান্তে পথে নামবে। অনেকের তো এ সমস্যা নেই।’
কবি সাব বলে, ‘চুপ করেন ভাইসাব। ভালো মাল খাইবেন, আবার পা পাড়া দিয়া ফ্যাসাদ করবেন। তা হবে না। এমন চান্দিনা রাইতের জন্য মধুবাবু সহি মানুষ!’
‘এ সোহানী কা রাত! আহ! মধুবাবু আমার পিতামহ!’ সাজু ভাই বলে।
‘খাওনের আগেই মাল-ক্রোক। নাবালক। বাবা ফজল। কলকের আগে একটু রং চা চাই?’
মধুবাবু বছির মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পিদিমের আগুনে বছির মিয়া নারকেল ছোবা পুড়ছে। ঘরশুদ্ধ পোড়া গন্ধ। ইতোমধ্যে ফজল শেষ কাটনি চালাচ্ছে সিদ্ধির ওপর। আর বছির মিয়ার আঙড়া তৈরি করছে।
‘ন্যাকড়া জল দিয়ে ধুয়ে নিস ফজল।’ মধুবাবু বলে।
‘তা তো নেবো। ভুল হবে নে বাবু।’
চাঁদ এখন গাছ-গাছালি ছাপিয়ে উঠোন জুড়ে তেরছা আলো ফেলছে। পাতার ছায়া বাটিক প্রিন্টের মতো কারুকাজ সারা উঠোন জুড়ে।
বছির মিয়া অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারের দিকে কলকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘স্যার কলকের আগুন ধরিয়ে দিন। নইলে মেছ মারতে হবে।’
শিল্পী সাজু ভাই মধুবাবুর দিকে তাকায়। মধুবাবু তখন বাইরে তাকিয়ে জোছনার মনমুগ্ধকর রূপ দেখছে।
ইতোমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার কষে টান দিয়ে শিল্পীর দিকে কলকে এগিয়ে দেয়। এভাবে কলকে ঘুরে যখন মধুবাবুর নিকট আসে, তখন কলকে বেশ গরম হয়ে গেছে। মধুবাবু মহাদেবের দিকে শূন্যে ভক্তি উড়িয়ে জোরসে টান মেরে ভকভক করে ধোঁয়া ছেড়ে ঈষৎ কাশতে থাকে।
গেরেজের চারদিক সিদ্ধির গন্ধ ম ম করছে।
প্রথম চিলিম শেষ না হতেই ফজল ছোট ছোট কাপে রং চা নিয়ে এলো। ধোঁয়া উড়ছে। সবাই হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে শব্দ করে চুমুক দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করে। ঝিম মেরে বসে আছে সবাই। শব্দহীন, প্রাণহীন। বাইরে জোছনার প্লাবনে ভেসে যাওয়া পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে কবি সাব বলে, ‘মাল সরস।’
ইঞ্জিনিয়ার তরিৎ বলে, ‘ঘোড়ার ডিম।’
মধুবাবু বলে, ‘তা তো হবেই, মাগনা মাল তো? পয়সা দিয়ে আনতে হয় নাই।’
‘তাই কী, ভালো-খারাপ বলার অধিকার সবার আছে। এটা তো গণতান্ত্রিক অধিকার।’
‘গণতন্ত্রের কথা বলছেন, গণতন্ত্র তো ফাইনালে।’ বছির মিয়া উচ্চ গলায় বলে।
‘অশিক্ষিত জাতি। গণতন্ত্র দিয়ে কী হবে?’ সাজু ভাই বলে।
‘শিক্ষিতের আন্ডা’ মধুবাবু জড়ানো কণ্ঠে বলে।
‘মুখ সামলিয়ে কথা বলবেন মধুবাবু।’ বছির মিয়ার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর।
ঠিক এমন সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। তাৎক্ষণিক সময় রুমের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। পিদিমের আলোয় প্রত্যেককে ক্যামন ক্লান্ত, বিষণ্ণ দেখায়। ফাগুন মাসের ঈষৎ শীত এতোক্ষণ পর অনুভব করে উপস্থিত বাসিন্দাবৃন্দ। ফজল মিয়া সিদ্ধির আরেক চিলিমের আনজাম করছে।
মধুবাবু অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘বছির ভাই গণতন্ত্র দিয়া কী করবেন? শোনেন নাই গণতন্ত্র কোর্টের বারান্দায় বোতলে পাওয়া যায়। স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য আবার গণতন্ত্র কী?’
‘বাবু আপনি যাই বলেন, পাকিস্তান আমলে ভালো আছিলাম।’
কবি সাব তরিৎ বলে, কী ভালো আছিলেন, তখন তো মানুষ না খেয়ে থাকতো। বিয়াল্লিশ বছর পর কেউ না খাইয়া থাকে না। আপনার গেরেজে বাতি জ্বলে।
‘বছির ভাইয়ের বয়স কত? যুদ্ধ দেখেন নাই। এখন নানা কথাই আসবো।’
সাজু ভাই বলে, ‘বছির ভাইকে হঠাৎ হঠাৎ ছাগল মনে হয়, আরে ভাই, এমন ছাগলের মতোন কথা কেউ বলে, পাকিস্তান আমলে ভালো ছিলাম। আহারে আমার ভালো থাকার নমুনা। মনে পড়লেই গা শির শির করে।’
ওই অন্ধকার-জোছনায় সবাই বছির মিয়ার দিকে তাকালো। সত্যি তো বছির মিয়াকে ক্যামন ছাগলের মতোন লাগছে।
মধুবাবু ঘর ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ঝক-ঝকে গোল থালার মতোন চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চারদিক আলোর প্লাবনে বিভ্রান্ত। আস্তে আস্তে সবাই উঠোনে দাঁড়ায়। এমন চান্দিনা রাতে সবাইকে কেমন কালো লাগছে। ঠিক এ সময় ফজল আরেক চিলিম ইঞ্জিনিয়ার বেলাল শেখকে ধরিয়ে দেয়। ‘জয় গুরু’ আর্তচিৎকার করে ওঠে সাজু ভাই।
বছির মিয়া অত্যন্ত বিষণ্ণ। আলো-আঁধারির সুক্ষ্ম কারুকাজ ছাপিয়ে তার পরাজিত, ক্লান্ত মুখ দেখা গেলো সাজু ভাইয়ের কলকে টান দেওয়ার আগুনের হালকায়।
মধুবাবু কলকে টান দিয়ে বলল, ‘আজকের এই রাত আমি অর্চনাকে দিয়ে দিলাম।’
‘বাবু মনে হয়, রাইতের ইজারা নিছেন।’
মধুবাবু কথার পিঠাপিঠি উত্তর দেয়, ‘মিস্ত্রি সাব গো নিগা ভাবের জগৎ না।’
‘ভাবের জগৎ তো কবি গো।’ কবির উত্তর।
‘এই জন্যই ফাইনালে আছেন, বয়স ভাটির দিকে বিয়া করেন নাই! খালি ভালোবাসার গাল-গল্প।’ ইঞ্জিনিয়ার সাব বলে।
চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে কতিপয় হোমোসেপিয়ান অবচেতন পৃথিবী জুড়ে যে আকাশ দিয়ে হাঁটছে তার মধ্যে বসবাস করে শূন্যতার দীর্ঘ চাদর। সেই চাদর গায়ে দিয়ে নিজকে ভাবছে এক একজন সন্ত পুরুষ। যাদের পাপ-পূন্নি’র কোনো হিসেব-নিকেশ নেই। সত্য-সুন্দর মোড়ানো পথ দিয়ে হেঁটে যায়।
ইঞ্জিনিয়ার বলে, ‘জানেন বছির ভাই, বাবার ওপর আমার কোনো রাগ নেই, তবে মা’র ওপর আছে। মা তো উত্তরা থানার বড় কর্মকর্তা। আচরণ বিধি অমাতৃসুলভ। তারপর জননীকুল। আমার প্রথমা স্ত্রী মা’র সঙ্গে অভিমান করে সুইসাইড করেছে। মা তাহমিনা কে সহ্য করতে পারতো না। তাহমিনা খুব অভিমানী মেয়ে। আহ!’
ইতোমধ্যে ফজল দুটো বেঞ্চ এগিয়ে দেয়।
চাঁদের মুখোমুখি বসে কবি সাব বলে, তাইলে আপনার ইতিহাস-ভূগোল এই। আমারে কয়, ওভার এইচ। প্রথমা প্রতারণা না করলে এক ডজন পোলার বাপ থাকতাম। ছাত্র বয়সে সংসার পাতলে বেজাল হতো না। এতোদিন পর প্রথমা ভাবনায় এলো।’
‘তা তো আসবেই। এমন রূপবান জোছনা দেখেছেন কী? দুধ দিয়ে ধোয়া। প্রথমা, দ্বিতীয়ার জন্য কতটুকু জায়গা আছে তারও ঠিকুচি শুনতে হবে। কী প্যানর, প্যানর বাবারে?
সাজু ভাই মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘প্রকৃতি নিজেই তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় না।’
বছির মিয়া কলকে কষে টান মেরে বলল, ‘উপস্থিত সদস্যবৃন্দ, আমি মূর্খ মানুষ। আপনারা জ্ঞানী লোক। আপনারা আমার গেরেজে বসেন, তাতেই আমি খুশি। আপনাগো ভালোবাসায় পড়ে আছি। দেহেন না মধুবাবু কেমন আঘাত দিয়ে কথা কয়। এটা কী ঠিক?’
মধুবাবু ব্যতীত আর সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, ‘ঠিক না।’
বছির মিয়া বলে, ‘এই গেরেজ, এই ধানি জমি আমার শ্বশুর দিয়েছে। রাহেলা গাঁয়ের মেয়ে। তরুণ বয়সে জাপানি ইয়ানামার সেলো মেশিনের এক্সপার্ট হিসেবে পরিচিত থাকায় রাহেলাকে বিয়া করা আমার পক্ষে কষ্টকর হয় নাই। রাহেলা আসার পর আমার সংসার উজাইয়া পড়ছে। অথচ রাহেলার মনঃকষ্ট। আমি নিশা-পানি খাই।’
মধুবাবু বলে, ‘বছির ভাই, আপনার কষ্ট তৃতীয় শ্রেণির। সংসারে এইটা কোনো কষ্ট হলো?’
সাজু ভাই মারহাবা, মারহাবা বলে ওঠে।
বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটতে থাকে।
‘সবাই এখন অফ যান। ভাবের জগৎ খোঁজেন।’ সাজু ভাই ঝিমুনি কণ্ঠে বলে। তার ড্যাব-ড্যাবা দুটো চোখ রক্তাভ। ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। শীতল বাতাস আসছে। সবুজে মৃদু কাঁপন।
ইঞ্জিনিয়ার বেলাল শেখ বলে, ‘সবাই হলো গিয়ে উচ্চ বংশীয় প্রথম শ্রেণির গ্যাবট। সন্ধ্যেবেলা থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষণিক সময়ের জন্য নারী প্রসঙ্গে বাদ যায়নি। এরা হলো জাত মূর্খ। এদের থেকে দূরে থাকুন।’
‘আশরাফুলকে গালে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হয়ে ছিলো। মাঙ্গির পুতের ভাবখানা এমন উইকেট থাকলে ওরে বিচ্ছুই কামরায়। কখন বিরক্ত দেখিয়ে প্যাবিলিয়নের পথে হাঁটবে। শালা বান্দির পুত। দায়িত্ব-জ্ঞান নেই। নেশন চেয়ে থাকে তোদের দিকে। ইস কী তার প্রতিদান। শালায় ঘুষ খাইছে।’ কবি এক ধারসে বলে যাচ্ছে।
বছির মিয়া অনেকটা গুহা মানবের মতো জোছনার দেখা পায়। ভীষণ আবেগী কণ্ঠে বলে, ‘মধুবাবু, আজকের মাল জগৎ সেরা!’
মধুবাবু অত্যন্ত বিনয়ী।
‘কী যে কন বছির ভাই। মিস্ত্রি সাব ক্যামন তাচ্ছিল্য করলো। এখন তো পিনিকের চোটে ক্যামন ধ্যানস্থ রবীঠাকুর হয়ে আছেন। বাঞ্চোত।’
‘এদের কথা বাদ দিন। এরা আউলা। আদম সুরত নাই। আন্দাস করে পথ হাঁটে না। ইঞ্জিনিয়ার বেলাল বলে।
‘জানেন কবি, একজন নারীকে চুমু খাওয়া হলো না।’ সাজু ভাইয়ের কণ্ঠে হতাশার সুর।
‘পঞ্চম শ্রেণির রুচি। গাড়োল।’ বেলাল শেখ বলে।
আকস্মিক মধুবাবু সষ্ঠাঙ্গে বছির মিয়ার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলে, ‘বছির ভাই আমারে মাপ কইয়া দেন, আপনার মনে কষ্ট দিছি। আমার কান্না আসছে।’
বছির মিয়া বলে, ‘কি বলেন মধুবাবু, আপনারা গুণি মানুষ। আপনাদের কষ্ট দিলে আমার কবিরা গুনা হইবে। উঠে যান।’ বলে মধুবাবুকে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
সারাঘর জোছনায় ক’জন ঘোরলাগা অসহায় পাতিক স্নান শেষ প্রাজ্ঞ শিবের মতো যজ্ঞের মধ্য দিয়ে চরাচর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে।
শুধু ইঞ্জিনিয়ার সাব বলে, ‘মাফ করবেন, ধরত্রী জননী, তোমাকে আবিষ্কার করার জন্য এই বেঁচে থাকা।’
মধুবাবু আরো কতোক্ষণ অর্চনার জন্য বিলাপ করে।
কবি অনবরত কবিতা বলছে, ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।’
এ সময় ফজল বলে, ‘সামনে একটা ভ্যান যাচ্ছে। আর কিন্তু ভ্যান পাবেনে।’
হুড়মুড় করে ওরা কতিপয় চন্দ্রাহত, এ রজনীর ঘোরাটোপে ভ্যান গাড়িতে উঠে। মধুবাবু বছির মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বছির ভাই, গণ্ডগোলের বছর কইয়েন না, যুদ্ধ বছর কইয়েন। মাটি হইলো জননী তার ঋণ শোধতে হয়।’