কলকাতা আসলে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে উঠে আসা ভূখণ্ড। তাই কলকাতার গায়ে সামুদ্রিক লবণের চিহ্ন পরতে পরতে লেগে আছে।
শ্যামবাজার যে নুনের বাজার ছিল তার পরোক্ষ প্রমাণ আছে। শ্যাম মানে সামুদ্রিক লবণ। শ্যামবাজারের বসুপরিবার আঠেরো শতকে নুনের ব্যবসায় নাম করেছিল। শ্যামবাজার অঞ্চলে কৃষ্ণরাম বসু স্ট্রিট এখনও আছে ।
সল্টলেকের শ্যামবদল নামক অঞ্চলটি শ্যাম-অর্থে নুনের প্রমাণ বহন করছে। তার পাশেই নোনাডাঙা।
কলকাতার গঙ্গাতীরবর্তী নিমতলা অঞ্চল যে আগে নিমকতলা ছিল না, তা কে বলতে পারে! সেখানে গঙ্গাতীরে নুনের শতাব্দীপ্রাচীন গুদামগুলো এখনও বর্তমান।
বউবাজারের মলঙ্গা অঞ্চল এসেছে ‘মালঙ্গী’ থেকে। মালঙ্গী মানে লবণকর্মী। এরা নুন তৈরি করত। বউবাজারের পুরনো ইতিহাসে নুন-লঙ্কা-বাজারের অস্তিত্ব ছিল। এখানকার বিশ্বনাথ মতিলাল বিলিতি নুনের ব্যবসা করে ধনবান হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সেকালের কলকাতার অন্যতম বিত্তশালী লোক। ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ রাজকর্মচারী (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ শাখার ফ্যাক্টর) স্ট্রেনসাম মাস্টার বরানগরে শুয়োরের ফ্যাক্টরির বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্রতিদিন তিনহাজার শুয়োর জবাই করে তার মাংস নুন দিয়ে জারিত করে ইউরোপে পাঠানো হত সেখান থেকে। শ্যামবাজারের নুন সেখানে কাজে লাগত হয়ত। পুরনো কলকাতার নুনের ইতিহাস চমকপ্রদ।
প্রাচীন বঙ্গের বাণিজ্যে যে বার্টার বা বিনিময়প্রথা ছিল, তা নিশ্চিত। পণ্যের বদলে টাকা না দিয়ে আর একটি পণ্য দেওয়া-নেওয়ার চল ছিল। সুতানুটির হাটে সুতার গাঁট, কাপড় ও মসলিনের বদলে ইউরোপীয় বণিকরা অন্য পণ্য দিত। লবণের বিরাট ভূমিকা আছে বার্টারপ্রথায়। প্রাচীন গ্রীসে মাসের শেষে মাইনের বদলে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণ দেওয়া হত। একে বলা হত Salarium। তা থেকেই Salary কথাটি এসেছে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লিখে গেছেন ‘লবঙ্গের বদলে মুকুতা নিব, পিপুলের বদলে দারচিনি’। রামকুমার মুখোপাধ্যায় ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’-তেও এই বার্টার বা বিনিময়প্রথার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। আদিবাসীদের মধ্যে এই প্রথা-পদ্ধতি এখনো আছে ঝাড়খণ্ড-ছত্তিশগড় এলাকায়। পুরনো কলকাতার একটি জায়গা হল লবণহ্রদ এলাকার ‘শ্যামবদল’। এখানে আদিগঙ্গা ও বিদ্যাধরী নদী ছিল কাছাকাছি। ‘শ্যাম’ মানে সামুদ্রিক লবণও হয়। ১৭৮০তে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস লবণের উপর ট্যাক্স বসান ও দেশি নুন প্রস্তুতের অধিকার হরণ করেন জনসাধারণের হাত থেকে। এর আগে পর্যন্ত ঘরেঘরে নুন তৈরি হত। মনে হয় সেই নুন এই ‘শ্যামবদল’ এলাকাতে বদলানো হত। বিনিময়ে নেওয়া হত অন্য পণ্য। আদিগঙ্গা, বিদ্যাধরী, ইছামতী নদী ধরে চলত লবণবাণিজ্য।
কলকাতার ভাগীরথী-তীরে নুনের গন্ধ পেতে গেলে ঠকতে হবে। কলকাতা শহরের ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্বে। পূর্বদিকে অতি প্রাচীনকাল থেকে আছে সল্ট ওয়াটার লেক। আদিগঙ্গাই ছিল তখন গঙ্গার মূলস্রোত। ১৭৭৫-এ মেজর টালি আদিগঙ্গাকে বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে যুক্ত করেন। এই বিদ্যাধরীর সঙ্গে মিশেছে ইছামতী। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত বঙ্গোপসাগরমুখী এই বিদ্যাধরী। এই নদী দিয়েই সম্পন্ন হত লবণবাণিজ্য।
একটি জার্মান গবেষকদল সুন্দরবনে তিনশ বছরের পুরনো লবণকারখানা খুঁজে পেয়েছেন। এই সব অঞ্চলে সমুদ্রের জল থেকে তৈরি হত লবণ। বিদ্যাধরী ও ইছামতী দিয়ে সেই নুন উত্তরে চলে আসত। শ্যামপুর, শ্যামবদল, বসিরহাট, শ্যামবাজার, শোভাবাজার, বড়বাজারে বিক্রি হত সেই নুন। ১৯৩৪ এর আগে পর্যন্ত সল্ট লেকের ধাপা থেকে পোর্ট ক্যানিং পর্যন্ত বিদ্যাধরীর নাব্যতা ছিল। যার ফলে স্বদেশী আন্দোলনের সময় সল্টলেকের মহিষবাথানের প্রামাণিকদের নেতৃত্বে যে লবণসত্যাগ্রহ হয়, সেটি সম্ভবপর হয়েছিল। বিদ্যাধরীর লোনাজল ফুটিয়ে এলাকার লোক নুন তৈরি করত গত শতকের তিনের দশকেও।
‘বসির’ শব্দের অর্থ সামুদ্রিক লবণ। বসিরহাট হল ইছামতীর তীরে লবণব্যবসার মোকাম। দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রথম সরকারি পোস্টিং ছিল নিমকদেওয়ান হিসেবে বসিরহাটের বাগুন্ডিতে।তিনি বরানগর ঘাটে নৌকা চেপে যেতেন। আতিথ্য নিতেন টাকীর জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরীর বাড়িতে।
‘শ্যাম’ শব্দটির অর্থও সামুদ্রিক লবণ। গোসাবার শ্যামপুর, সল্টলেকের চৌবাগা অঞ্চলের শ্যামবদল আর কলকাতার শ্যামবাজারে নুনের আড়ত ছিল।
১৭৮০ তে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস নুনের উপর কর চাপালে দেশি নুন তৈরি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় বিলেতি নুনের রমরমা। বৌবাজারের বিশ্বনাথ মতিলাল, শ্যামবাজারের বসুপরিবার, কাঁচরাপাড়ার অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির পূর্বপুরুষরা এই বিলেতি নুনের কারবার করতেন। কলকাতার নুনের কথা একদিনে বলে শেষ করা যাবে না। রাধারমণ মিত্র কলিকাতা-দর্পণে কলকাতার পুরনোকালের বেশ কয়েকটি সরকারি নুনের চৌকির কথা উল্লেখ করেছেন।
সেগুলি এখনও বহাল তবিয়তে আছে কিনা তা পেশাদার ক্ষেত্রসমীক্ষকরা বলতে পারবেন।
মেদিনীপুরের কন্টাই বা কাঁথিতে আছে নিমকমহল। বাসুলী পদবিধারী লোকজনের পেশা যে ঠিক কী, তা জানা যায় না। মনে হয় বসির তথা সামুদ্রিক লবণের ব্যবসায়ীদের বলা হত বাসিরী। তা থেকেই অপভ্রংশে বাসুলী।