আসন্ন দুর্গোৎসব দোরগোড়ায়….কলকাতা সহ জেলা সেজে উঠছে মা আসার আনন্দে। বছরকার এই কটা দিন আমরা বাঙালিরা ফিরি এক চিরন্তনী সংস্কৃতির আমেজ মাখা উৎসবের আয়োজনে। তারপর আবার অপেক্ষা একটা গোটা বছরের। এই রীতিই চলে আসছে কত যুগ ধরে তার সঠিক খোঁজ কেউই জানে না। এই উৎসবই একমাত্র মাধ্যম যা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আরজিকরের ডাক্তার মেয়েটির সঙ্গে যা ঘটেছে তা সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যাক্কারজনক। মেয়েটি আর ফিরবে না। আমারই মেয়ের বয়সী মেয়েটির সঙ্গে ঘটা ঘটনায় আমরা সকলেই স্তম্ভিত। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মত বাংলা নয়। এখানে যে নারীকে শক্তিরূপে পুজো করা হয়। সেখানে এই ঘটনা বাঙালি মননে ধাক্কা দিয়েছে। দ্রুত বিচার আমাদের সকলের লক্ষ্য। সেখানে পক্ষ বিপক্ষ বলে কিছু নেই।
কিন্তু এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার বিগত মাসাধিক কাল আমরা স্নান, খাওয়া, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম করিনি ? স্কুল, কলেজ, অফিস যাই নি ? রক্ষা করিনি লোক লৌকিকতা ? সবকিছু করেছি। করতেই হয়। তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর উৎসবে ফেরার কথার সূত্র ধরে বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসবকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা কেন ?
ঘটনা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী সহজ কথা অতি সহজ করে বলেন। তাতে ওনার বিরোধীদের কুৎসা কটাক্ষ করতে খুব সুবিধা হয়। তাছাড়া ওনাকে কটু কথায় হেনস্থা করার রীতিটা আজ নতুন নয় বিগত ত্রিশ বছর ধরেই চলছে।
অথচ উনি এসবের বাইরে সামাজিকভাবে রাজ্যের মানুষের সার্বিক কল্যাণকর বিষয়ের ভিতরেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন। তাই উৎসবে ফেরার বক্তব্যটা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বলেই রেরে করে ওঠার আদৌ কিছু নেই।
জানি, রাজনীতির তুল্যমূল্য হিসাবের খাতায় লেখা অনেককিছুই হচ্ছে যা আজ দৃশ্যতই স্পষ্ট। কিন্তু দুর্গোৎসব রাজনৈতিক মাইলেজের জায়গা নয়। কারণ বাংলার এই উৎসব শুধু আনন্দের নয় এর সাথে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। বছরের এই কটা দিন সামাজিক মিলনোৎসবটির রোশনাইয়ের আনন্দ ভাগ হয় প্রতি বাঙালির ঘরে ঘরে।
পুজোর কেনাকাটা, লাইট, প্যান্ডেল, ঢাকি, পুরোহিত সহ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এই দুর্গাপুজো একটু বাড়তি আয় উপায়ের সময়। ফলে উৎসবই বাংলার মানুষের চোখে মুখে জ্বেলে দেয় উমা আসার আলো। সেখানে রাজনীতির সূক্ষ্ম চালে উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোকে বড্ড হেয় করা হচ্ছে।
যে চলে যায় সে কখনোই আর ফেরে না। তারজন্য আমাদের স্বাভাবিক জীবনও থেমে থাকে না। একটা সময় পর আমাদের যাবতীয় সামাজিক কাজের ভিতরে ফিরতে হয়। হ্যাঁ, কষ্ট থাকে। তিলোত্তমার কষ্টও থাকবে। থাকতেই হবে। এমন ঝকঝকে একটি মেয়ের এমন নির্মম পরিণতি তো কাম্য নয়।
কত উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিলো তার। কত মানুষের ভরসা হয়ে থাকতো সে। কিন্তু দিনের শেষে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। উৎসব সেই বাস্তবতার আলো। যে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তিলোত্তমাদের রক্ষা করার অঙ্গীকার নেওয়াটাই কর্তব্য।
ওইযে আমাদের একটি লোকাচার আছে, মৎস্যমুখ!!….বাবা মা স্বামী সন্তান যত প্রিয়জনই চলে যাক না কেন কয়েকদিনের বিধিনিষেধ মেনে আশৌচ কাটিয়ে আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করে কাজ করি। সেই কাজের শেষদিনে আমরা মাছ মুখে দিই।
গুরুজনদের ক্ষেত্রে আমি দেখেছি সেই ব্যক্তি যা যা খেতে পছন্দ করতেন সেগুলোর আয়োজন করে বাড়ির লোক। এর কারণই হচ্ছে, বহমান জীবনের স্বাভাবিক স্রোতকে আমরা কেউই অস্বীকার করে চলতে পারবো না।
যত শোক দুঃখই আসুক না কেন একটা সময় পর জীবনকে আঁকড়ে ধরতেই হয়। ঠিক যেভাবে আমাদের আপনজন চলে যাবার কষ্ট থাকে। পাশাপাশি কিন্তু পরিবারে নতুন সদস্য জন্মানোর আনন্দও থাকে। শোক আঁকড়ে বসে কেউই থাকতে পারে না।
এই আন্দোলনের মধ্যেই নবান্নের একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের মাতৃবিয়োগ হয়। সহকর্মীরা সকলেই কাজের ভিতরেও সময় করে মাসিমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লৌকিকতা সামিল হয়েছে।
উৎসব শোক, তাপ, বেদনা, দ্বেষ, ক্লেশকে প্রলেপ দেয়। আর দুর্গাপুজো তো আমাদের প্রাণের উৎসব। দূর দূরান্ত কর্মক্ষেত্র থেকে এসময় সকলেই ফেরে গৃহকোণে। বছরভর কাজের ক্লান্তি কাটায় পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়দের সঙ্গে কয়েকদিনের এই উৎসবের দিনগুলো।
আজ হঠাৎ একথা বলার কারণ হচ্ছে, ঠিক দুবছর আগে আজকের দিনে সকালে ঘুম ভেঙ্গেছিলো মায়ের মৃত্যুসংবাদে। মণ্ডপে মণ্ডপে যখন আগমনীর আনন্দধারা বইছে সেই তখনই দুর্গাচতুর্থীর দিন ভোরে মা চলে গেছিলো চিরকালের মত।
নিশ্চুপ নিঃস্তব্ধ ভিতরে ভিতরে এক অসহ্য যন্ত্রণা চেপেও যন্ত্রের মত আমি মায়ের ইচ্ছামত এনআরএস হাসপাতালে দেহদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেদিনও ফিরেছিলাম কাজের জায়গায়। হ্যাঁ, ফিরতেই হয়েছিলো।
মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার শৈশবের সব নাড়ীর টান ছিঁড়ে গেলেও নবনীড় আশ্রমে মায়ের মত অনেক মায়ের মাঝে বসে বসে সেদিন অনুভব করেছিলাম চলময় এই সংসারের দায়ভার শুধু তো আমার একার নয়। শোক আনন্দও আমার একার নয়। সময়ের দোলনচক্রে দুঃখ ধারণ করে চলা যায়না। এটাই সত্য। উৎসব সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে।
তাই উৎসবের আয়োজনে সকলেই সামিল হোন। বাঙালি সংস্কৃতির এই মহোৎসবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠুন। তিলোত্তমারা দখল করে রাখুক রাজপথ। তাদের হাসি গান নতুন জামার সাজগোজে কেটে যাক মনের সব অন্ধকার। মাতৃ আরাধনার এই উৎসব বাঙালির চেতনা চৈতন্যে নিয়ে আসুক মানবিকতার আত্মিক টান। রাজনীতির কলুষতা যেন সেই টানকে ছিঁড়ে না দেয় এটাই হোক মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা।