ভারতীয় সিনেমার সর্বশেষ্ঠ সিনেমা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত পথের পাঁচালী। এই চলচ্চিত্র সৃষ্টির পিছনে ছিলো সত্যজিৎ রায়ের এক স্বপ্ন জয়ের লড়াই। পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রকে আমরা সবাই মনে রেখেছি কিন্তু জানেন কি এই ছবিকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, একদা কলকাতার মহানাগরিক, ধন্বন্তরি চিকিৎসক যাঁর দুর্ধর্ষ ক্লিনিক্যাল আই ছিল প্রশ্নাতীত — ডা. বিধান চন্দ্র রায়।
পথের পাঁচালী নির্মাণে সত্যজিৎ রায়কে বেচে দিতে হয়েছিল সহধর্মিনী বিজয়া রায়ের গয়না, জীবনবীমার পলিসি, নিজের দুষ্প্রাপ্য গানের রেকর্ডের সংগ্রহ এবং আরো কিছু। তবুও ফিল্ম তৈরির পুরো বাজেট সংগ্রহ করতে পারছিলেন না। পথের পাঁচালী নির্মাণ যখন মাঝপথে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভগবানের ছদ্মবেশে সেই মুশকিল আসান করতে পাশে দাঁড়ান বিধান চন্দ্র রায়।
কথায় বলে, সময় খারাপ হলে সব দিক থেকেই হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণ যখন বন্ধ হয়ে আসছে তখন সিনেমার প্রযোজক অনিল চৌধুরী সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে যাতায়াত বন্ধ করে দেন এবং পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে বিকল্প প্রযোজক খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিলনা। তিনি প্রায় আট মাস পলাতক ছিলেন। হঠাৎই একদিন অনিল চৌধুরী উপস্থিত হলেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটি প্রস্তাব নিয়ে।
রাইটার্স বিল্ডিং-এর একজন কেরানিকে অনিল চৌধুরী চিনতেন এবং তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ছবিটি সম্পূর্ণ করার জন্য অর্থ জোগাড়ের জন্য ড.রায়ের কাছে যাবার। এই কথাবার্তা আলোচনা হচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায়ের উপস্থিতিতে।
কিভাবে ডা. রায়ের কাছে যাওয়ার জন্য যখন ভাবা হচ্ছে তখন সুপ্রভা দেবী বললেন, ‘আমি কিন্ত ডাক্তার রায়ের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় জানি, আমার বন্ধু বেলার মাধ্যমে’।
বয়সে সামান্য ছোট হলেও বছর পঞ্চাশের কাছাকাছি মিসেস বেলা সেন ছিলেন সুপ্রভা রায়ের বান্ধবী, Co. JJ Sen-এর স্ত্রী। ডা. রায়ের মতো সেনেরাও ছিলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মসমাজ একটি ছোট সম্প্রদায় হওয়ায় বেশিরভাগ পরিবার একে অপরকে চিনত অন্তত কিছুটা। ডা. রায় একজন ব্যাচেলর ছিলেন এবং তিনি সেন পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সুপ্রভা রায়ের অনুরোধে বেলা ডা. রায়ের কাছে বিষয়টি জানাতে রাজি হয়েছিলেন। কয়েকদিন পর মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খবর এল যে ডা. রায় পথের পাঁচালী নিয়ে আলোচনা করতে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।
বেলা সেনের প্রচেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্রকে এই অর্ধসমাপ্ত ছবি দেখানো হয় এবং তিনি সন্তুষ্ট হয়ে নির্দেশ দেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ছবি সমাপ্ত করার দায়িত্ব নেবে। এর আগে কোন রাজ্য সরকার চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামেননি। মুখ্যমন্ত্রীর চিফ সেক্রেটারি বলেছিলেন, ‘এর জন্য কোন বাজেট নেই। কোন বিভাগ থেকে এই খরচ বহন করা হবে?’ তখন বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন যখন ‘পথের পাঁচালী’ তখন অবশ্যই ‘রোড ডেভেলপমেন্ট।’ শোনা যায় পরে সরকারের গ্রাম উন্নয়ন খাত থেকে এই টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিলো।
এই গল্প আরো দীর্ঘ হয়েছে। সরকারি সাহায্যে তৈরি হওয়ার পরে বিধানচন্দ্র রায় নাকি এই ছবিটির শেষটা দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘সরকারি পুনর্বাসনে এত সুযোগ থাকতে একটা গ্রামীন পরিবার কেন ভিটে ছেড়ে চলে যাবে?’
এই মন্তব্য পরিচালককে বলার ফলে তিনি বলেছিলেন মূলগল্পে এমনই আছে। অবশেষে ১৯৫৫ সালে ২৬শে আগস্ট বসুশ্রী সিনেমা হলে মুক্তি পায় এই ছবি। পথের পাঁচালী যে শেষ পর্যন্ত বিশ্বজয় করেছিলো তা বিধানচন্দ্রের ঔদার্য ও দূরদৃষ্টির ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
বাণী সিনেমায় বিধান রায় এই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মজা করে সত্যজিৎ রায়-কে বলেছিলেন, ‘অস্কার না পেয়ে যাও’। সেই কথাটাই ফলে গিয়েছিল। লাইফ টাইম অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের নাতি, সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায়।
শোনা যায় এই প্রদর্শিত পথে ইন্দিরা গান্ধী একসময় রিচার্ড অ্যাটেনবরোর গান্ধী ছবিতে আর্থিক বিনিয়োগ করে বিপুল সাফল্য লাভ করেছিলেন।
বিশ্ববরেণ্য নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরকে ডা. বিধান চন্দ্র রায় সরকারি তহবিল থেকে অনুদান দেন। কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
অনেকে মনে প্রশ্ন জাগে বিধানচন্দ্রের সঙ্গে সাহিত্যের জগতের কোন যোগাযোগ ছিল কিনা! অনেকই বলেন, এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাকি নাম মনে রাখতে পারতেন না। একবার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে তারাকালী বা তারাকিংকর বলে ডেকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু কলেজস্ট্রিট পাড়ায় লেখকদের প্রতি তাঁর নিবিড় ভালবাসার প্রমাণও রয়েছে।
একসময় লালবাজারে একটি বিভাগে শাসক বিরোধী লেখার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গল্প উপন্যাস পড়ার ব্যবস্থা ছিল। স্বাধীনতার পরে সেই বিভাগের নজর পড়েছিল অশ্লীল লেখার উপর এবং একসময় কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের রচনায় অসন্তুষ্ট হয়ে তারা আইনি মামলা চালু করার হুমকি দিতে থাকেন। এসব বিশিষ্ট লেখকেরা হাজতে থাকার আশঙ্কায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারস্থ হন এবং তিনি সাহিত্যিকদের সঙ্গে বিধানচন্দ্রের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন।
শোনা যায় কীর্তিমান রাইটারদের রাইটার্সে দেখে বিধানচন্দ্রের খুবই খুশি হন এবং তিনি লেখকদের আশ্বাস দেন স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সাহিত্য রচনা করার জন্য। তখন লেখকেরা তাঁদের লালবাজারে পুলিশদের ঘরে হাজতবাসের আশঙ্কার কথা বলেন। তখন তিনি তার আই সি এস সেক্রেটারিকে ডেকে পাঠালেন এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেক্রেটারি নাকি লেখকদের বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি অশ্লীল লেখা লেখেন তাহলে আইন তার নিজের পথেই চলবে।’
ডা. রায় তখন বলেছিলেন, ‘তোমরা বোম্বের হিন্দি ফিল্মের বিরুদ্ধে কি স্টেপ নিয়েছো?’
সেক্রেটারি কিছু উত্তর দিতে পারছেন না দেখে বিধানচন্দ্র বললেন, ‘আমি বাড়ি ফেরার সময় যেসব উত্তেজক ফিল্মি পোস্টার দেখি তার বিরুদ্ধে স্টেপ না নিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের আতঙ্কিত করার কোন মানে হয় না।’
তারপর তিনি সাহিত্যিকদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘কিছু ভাববেন না মনের আনন্দে লিখে যান’। গল্প কিনা জানিনা, কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় প্রচলিত আছে, এই বিধানকাহিনী পুলিশকে এরপর থেকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নাক গলানোর প্রচেষ্টা করতে দেখা যায়নি।
হ্যারিসন রোডের নতুন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় একসময় নিজেই উপার্জন বাড়ানোর জন্য চেম্বার থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি চালাতেন কিছুক্ষণের জন্য। শোনা যায় গাড়ি চালানো একসময় তার বিশেষ শখ ছিল। বিধানচন্দ্রের সময়ে কলকাতা রাস্তায় বাঙালি চালিত বেবি ট্যাক্সির যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিনে অনেক কলকাতাবাসি স্বাগত জানিয়েছিল একে, যদিও বা এখন আর তাকে কেউ বেবি বলে ডাকে না।
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বাবা প্রকাশচন্দ্র রায় পেশায় শুল্ক পরিদর্শক হলেও তিনি ছিলেন একজন উদারমনা সমাজসেবী। মা অঘোরকামিনী দেবী ছিলেন ভারতের নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের পথিকৃৎ। এমন বাবা মায়ের সন্তানের মধ্যে সমাজসেবার বীজ বপন থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিধানচন্দ্রের জীবনব্যাপী সব সাফল্যর সঠিক কোন হিসেব নেই। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে কত মানুষ কে তিনি নতুন প্রাণ দিয়েছেন কত নবীন চিকিৎসককে অতুলনীয় করেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আজ অবধি কেউ দিতে পারেননি।
দুর্গাপুর, কল্যাণী, সল্টলেক, সত্যজিৎ রায়, বেবি ট্যাক্সি – সবকটি ছিল ডাক্তার রায়ের অক্ষয় কীর্তি। সাফল্যের বিশাল ঝুড়ি মাথায় করেও দেশপ্রেমী বিধানচন্দ্র আমাদের বিস্মিত করেছিলেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় বিধানচন্দ্র রায় যা সম্মান পেয়েছিলেন তা তাঁর দেহাবসানের পর। তার আগে জুটেছে যথেষ্ট অবহেলা, অপমান এবং আঘাত।
পয়লা জুলাই আমরা বাঙালিরা তাঁর মূর্তিতে মাল্য দান করে বা কোন রাস্তা অঞ্চলের নাম পাল্টে তাঁর নাম রেখে, নামমাত্র ডাক্তার দিবস পালন করে, সমাজের প্রতি তাঁর অবদান থেকে নিজেদের ভারমুক্ত করি। তবু প্রতিবার আমাদের এই মানসিকতার তোয়াক্কা না করে জন্ম মৃত্যু দিবসের আলিঙ্গনে ১লা জুলাই আসে। বিধানচন্দ্র ছিলেন তুলনাহীন। লেখার শেষে নত মস্তকে তাঁকে প্রনাম জানিয়ে বলি —
“আজ আসিয়াছে কাছে
জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোঁহে বসিয়াছে,
দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবনপ্রান্তে মম”।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সত্যজিত রায়ের লেখা “My Years with Apu”, শংকরের লেখা, উইকিপিডিয়া।।
অতি মূল্যবান তথ্য সমৃদ্ধ রচনা, অনেক অজানা কে জানা হোলো, অভিনন্দন জানাই।
থ্যাঙ্ক ইউ দাদা 🌹
পড়ে খুবই ভালো লাগলো
অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।