অশীতিপর ভাই কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে শয্যাশায়ী। আর তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বোন বলছেন, ‘দাদা একবার দেখ, তোকে আমি ফোঁটা দিতে এসেছি। ভগবান করুন, আমি যেন তোকে বছর বছর ফোঁটা দিতে পারি। তুই ভালো থাকিস দাদা।’ ভাইফোঁটার সকালে এই সুন্দর দৃশ্যটা ভাই ও বোনের সম্পর্ককে বড় মধুময় করে তুলল। বোন নিজের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে দাদার কপাল মুছে দিল। তারপর ঘি, চন্দন আর প্রদীপের কালি থেকে তৈরি করা চুয়াচন্দন মিশিয়ে দাদার কপালে টিপ দিল। ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা…।’ তিনবার মন্ত্র পড়ে ফোঁটা দিলেন। প্রদীপের তাপ নিয়ে দাদার গালে, কপালে, বুকে দিলেন। মিষ্টির কোণ ভেঙে দাদার ঠোঁটের কোণে দিলেন। কান্নাটা গলার কাছে ভেঙে আসছে, তবুও এক তৃপ্তির বোধ বোনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। এই আনন্দটুকু তিনি বছর বছর পেতে চান। বাস্তব পরিস্থিতি সবই বোঝেন তিনি। কিন্তু তবুও মনে হয় ভাইফোঁটার এই মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানটুকু যমের হাত থেকে দাদাকে আগলে রাখুক।
বাঙালির এই ভাইফোঁটা অনুষ্ঠান বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের ভিড়ে ভাইফোঁটা হল সম্পর্কের বন্ধনে প্রজ্জ্বলিত এক নিবিড় ভালোবাসার অনির্বাণ শিখা, যা বারবার ফিরে আসে নতুন শুভেচ্ছায় আর মঙ্গল কামনায়।
পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার উল্লেখ আছে। সেখানে যম ও যমীকে ভাইবোন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষ্ণকে তাঁর বোন সুভদ্রা ভাইফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করেছিলেন। কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে ফিরে আসার পর সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করেন। ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন তাঁর ‘কৃত্যতত্ত্ব’ বইতে ভাইফোঁটার উল্লেখ করেছেন।
বোন বা দিদি ভাইয়ের কপালে বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে কপালে ফোঁটা দেন। আসলে হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের পাঁচটি আঙুল পঞ্চভূতের প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আমাদের বাঁ হাতের কড়ে আঙুল হল ব্যোম বা মহাশূন্যের প্রতীক।
ভাইফোঁটা নিয়ে নানান পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। সূর্য ও তাঁর পত্নী সংজ্ঞার যমজ পুত্র ও কন্যার নাম যম ও যমুনা। যমুনা শ্বশুরবাড়ি গেলে দীর্ঘকাল বোনকে না দেখতে পেয়ে মন খারাপ হয় যমের। একদিন তিনি বোনের বাড়ি চলে যান। ভাইকে দেখে হাসি ফোটে দিদির মুখেও। সেখানে বোনের আতিথেয়তা ও ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে যম তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। যমুনা বলেন, এই দিনটি ভাইদের মঙ্গলকামনা করে প্রত্যেক বোন যেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালন করে। সেই বর দান করেছিলেন যম। তারপর প্রতি বছর কার্তিক মাসের এই বিশেষ তিথিতে পালন করা হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। একসময় বালির হাতে পাতালে বন্দি ছিলেন বিষ্ণু। স্বর্গের দেবতারা লক্ষ্মীকে গিয়ে এর বিহিত করতে বলেন। লক্ষ্মী বালিকে ভাই পাতিয়ে তাঁকে ফোঁটা দেন। সেই দিনটিও ছিল কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া। ফোঁটা পেয়ে খুশি বালি লক্ষ্মীকে বললেন, ‘বোন, কী উপহার চাও বল।’ লক্ষ্মী বলেন, ‘উপহার স্বরূপ তুমি বিষ্ণুকে মুক্ত করে দাও।’ ভাইফোঁটাকে ঘিরে প্রচলিত আছে কৃষ্ণ ও সুভদ্রার কাহিনিও। চতুর্দশী তিথিতে প্রাগজ্যোতিষপুরের অত্যাচারী রাজা নরকাসুরকে বধ করেন কৃষ্ণ। তারপর তিনি দ্বারকায় ফিরে এলে বোন সুভদ্রা তাঁর কপালে বিজয়তিলক পরিয়ে দেন।
চতুর্দশ শতাব্দীতে সর্বানন্দসুরী নামে এক আচার্য পণ্ডিতের তালপাতার পুঁথি, ‘দীপোৎসবকল্প’ থেকে জানা যায়, জৈন ধর্মের গুরু মহাবীরের প্রয়াণের পর তাঁর অনুগত সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তখন তাঁর বোন অনসূয়া নন্দীবর্ধনকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় রাজার কপালে রাজতিলক পরিয়ে বোন অনসূয়া ভাইকে খাবার খাইয়ে দিয়ে বলেন, ‘হে রাজন, এই অসুস্থতা আপনার পক্ষে বেমানান। প্রজারা আপনার পুত্রসম। তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব আপনার। আমি আপনার কপালে রাজতিলক এঁকে দিলাম। এই তিলক আপনাকে নিয়ে যাবে মঙ্গলের পথে। উজ্জীবিত হোন নব প্রতিজ্ঞায়।’ বোনের এই প্রেরণায় নতুন সংকল্পে জেগে উঠেছিলেন রাজা নন্দীবর্ধন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে এই ভাইফোঁটা উৎসব পালন করা হয়। কোথাও তার নাম ‘ভাইটিকা’, কোথাও ‘ভাইদুজ’, কোথাও আবার ‘ভাই বিছিয়া’। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, ওড়িশা, দক্ষিণ ভারতে এই উৎসব পালন করা হয়। বাংলাদেশ, নেপালেও তা পালিত হয়। নেপালের ‘ভাইলগন’ রীতিটা একটু অন্যরকম। ভাইরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, বোনেরা ভাইয়ের কপালে দেয় পোড়া চালের ফোঁটা।
অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেখা হয় নাই’ বই থেকে জানতে পারি, ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে গ্রাম বাংলায় একটি মেলা বসে। সেটা নদীয়ায় বিরহীর কাছে মদনমোহনের এক মন্দিরকে ঘিরে। ‘বালিকা, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধার এত বিশাল সমাবেশ পাড়াগাঁয়ে বড় একটা দেখা যায় না। মেলার আনন্দে অংশগ্রহণ করা তাঁদের গৌণ উদ্দেশ্য হলেও আসল অভিপ্রায় ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে মদনগোপালের কপালে বা তাঁর উদ্দেশে ফোঁটা দেওয়া। মর্ত্যের মানবীরা স্বর্গের দেবতাকে এভাবেই ভ্রাতৃত্বে বরণ করে নেন। …কৃষ্ণ তাঁদের কাছে অজ্ঞেয় স্বর্গলোকবাসী প্রবলপ্রতাপ দেবতা নন, আদরের ভাই।’
ঠাকুরবাড়িতেও ভাইফোঁটা দেওয়ার প্রথা ছিল। ব্রাহ্ম হলেও রবীন্দ্রনাথের ছোটদিদি বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথকে ফোঁটা দিয়েছিলেন। বর্ণকুমারী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের সবথেকে ছোট মেয়ে এবং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সবথেকে ছোট ছেলে। তখন দেবেন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের মধ্যে কেবল এই দু’জনই জীবিত ছিলেন। বর্ণকুমারী দেবী চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে, ‘ভাইটি আমার, শুনলুম তুমি জোড়াসাঁকোয় এসেছ। সেইখানে গিয়ে ভাইফোঁটা দেব ভেবেছিলুম, কিন্তু হল না। বিকেলে লোক পাঠালুম জানতে। সে এসে বল্লে, তিনি সকালে চলে যাবেন।’ সেই চিঠির সঙ্গে দিদি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন ভাইফোঁটার উপহারও। সেই চিঠিতে বর্ণকুমারী আরও লিখলেন, ‘আমি বড়, তোমায় কিছু পাঠাতে হবে না।’ সেই চিঠি আর উপহার পেয়ে খুশি রবীন্দ্রনাথ দিদিকে লিখলেন, ‘ভাই ছোড়দি, তোমার ভাইফোঁটা পেয়ে খুশি হয়েছি। আমাদের ঘরে ফোঁটা নেবার জন্য ভাই কেবল একটিমাত্র বাকি আর দেবার জন্য আছেন এক দিদি। …আমার প্রণাম গ্রহণ করো।’
বর্ণকুমারী দেবীর সেই সাধ পূর্ণ হল পরের বছরে। সেই বর্ণনা পাই রাণী চন্দের ‘গুরুদেব’ বইতে। ১৯৪০ সাল। আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিয়েছিলেন ৮৪ বছরের দিদি। কালিম্পং থেকে কিছুদিন আগে ফিরে এসেছেন অসুস্থ ভাই। বর্ণকুমারী তাঁর অশক্ত দেহ নিয়ে কোনওরকমে দাঁড়ালেন। দু’জনে ধরে তাঁকে সাহায্য করলেন। ‘গৌরবর্ণ একখানি শীর্ণ হাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন।’ করলেন আশীর্বাদ। অসুস্থ ভাইয়ের মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?’ দিদির কথা শুনে কৌতুক করার সুযোগ ছাড়লেন না রবীন্দ্রনাথ। হেসে হেসে বললেন, ‘না, আর কখনও ছুটে ছুটে যাব না, বসে বসে যাব এবার থেকে।’
এই ঘটনার অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ একটি গল্প লিখেছিলেন ‘ভাইফোঁটা’ নামে। সেটি বাংলা ১৩২১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সবুজপত্র’-এ। সেই গল্পে অনসূয়া বা অনু তাঁর জীবনের শেষ ভাইফোঁটাটি দিয়েছিল সত্যধনকে। অসাধারণ এক গল্প এটি। সম্পর্কের নতুন ব্যাখ্যায় তার মনস্তত্ত্ব নতুনভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে নানা কবিতা, গান ও লৌকিক ছড়ায় উঠে এসেছে ভাইফোঁটা প্রসঙ্গ।
একটা সময় একান্নবর্তী পরিবারে বাবা, কাকা, জ্যাঠা, পিসি, তাঁদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসতেন। হইহই করে চলত ফোঁটা পর্ব। চলত খাওয়া দাওয়া। গমগম করতে পরিবার। বহু জমিদার বাড়িতে বসত ভিয়েন। এখন কমতে কমতে এক সন্তানের পরিবার। পিসি, মামারা হারিয়ে যাচ্ছে, ভাইফোঁটার সুযোগও কমে যাচ্ছে। এখন হোটেলে টেবিল বুক করেই চলে ভোজনপর্ব।
আবার এই ভাইফোঁটাকে ঘিরে অনেক বিষাদের গল্পও আছে, আছে মন ভেঙে যাওয়ার আপাত ট্র্যাজিক কাহিনি। পাড়ার বুল্টিকে দেখে মনে মনে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল কাল্টু। কোনও এক বছরে বন্ধুরা ধরে তাকে বসিয়ে দিয়েছিল ভাইফোঁটার আসরে। বুল্টির হাতে ফোঁটা নিয়ে বিবাগী হয়ে গিয়েছিল কাল্টু। পাড়ায় পাড়ায় একসময় এমন অনেক বুল্টি আর কাল্টুর অস্ফুটিত প্রেমগাথার বিনাশ হয়েছে ভাইফোঁটার দিনেই। তবুও এই দিনটি ভাই ও বোনের মধুর সম্পর্কের বার্তা আজও প্রচার করে চলেছে। হাজার হাজার বছর ধরে তার এগিয়ে চলা। পুরাণ থেকে ইতিহাস অতিক্রম করে সমকালকে ছুঁয়ে তার পরিক্রমণ মহাকালের পথে।