পুতুল নাচ ভারতের এক জনপ্রিয় ও প্রাচীন ফোক পারফর্মেন্স। ঋক বেদ থেকে শুরু করে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আমরা এই পুতুল নাচের উল্লেখ পাচ্ছি। এই পুতুলের পা নেই। হাতে দস্তানা বা ঘাগরা পরে আঙুলের নাড়াচাড়ায় দুটি পুতুলের কথোপকথন, নাচ, গান, ঝগড়া সবকিছু ফুটিয়ে তোলেন বেণী পুতুল শিল্পীরা। অতীতে এরা গ্রামে গ্রামে পুতুল বিক্রি করে বেড়াতেন। এখনও গ্রাম ও শহরের বহু মানুষ ঘরের দেওয়ালে বেণী পুতুল সাজিয়ে রাখেন। সেদিক থেকে বিচার করলে এই পুতুল একটা চমৎকার ঘর সাজানোর জিনিসও বটে।
আঙুল ও হাতের কারসাজিতে পুতুল নাচানোর সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীরা “ও খেঁদি নাচবি খেঁদি রসের বিনোদিয়া” জাতীয় নানা ধরণের গান করেন এরা। তরজা জাতীয় গান ও নাটকীয় সংলাপ এই পুতুল নাচের বৈশিষ্ট্য।
পুতুলের মাথা ও হাত একটা বাঁশের লাঠির মাথার ওপরে থাকে। লাঠির নীচে থাকে ছিদ্র, সেই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সুতোর সাহায্যে এরা পুতুল নাচান। পুতুল নাচাতে তারা মূলত ব্যবহার করেন মধ্যমা ও বুড়ো আঙুল। বেণী পুতুল তৈরি হয় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে। তালের আঁটি ও মাটি দিয়ে তৈরি হয় মুখ। শিল্পীদের হাতে বাধা থাকে ঘুঙুর। সেই ঘুঙুর বাজিয়ে শিল্পীরা গান করেন। পুতুলের চরিত্র অনুযায়ী সাজপোশাক তৈরি হয়। বেণী পুতুল লোকপ্রযুক্তির একটা বড় উদাহরণ। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত অরবিন্দ ঘড়াই বেণী পুতুল নাচের এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশভাগের আগে বাংলাদেশের বগুড়া এবং রাজশাহী জেলায় এই পুতুলের উদ্ভব। এরপর এই শিল্পীরা ছড়িয়ে পড়েন নদীয়ার রাণাঘাটে, সুন্দরবন এলাকায় এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি ও তমলুক অঞ্চলে। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু গ্রামে একসময় এই পুতুল নাচের শিল্পীদের দেখা পাওয়া যেত। এখন এরা মূলত থাকেন পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেরিয়ার রাধাপুর, বাতেন্দা, ভূপতিনগরের পদ্মতামুলি, ভগবানপুরের খেজুরিয়া, বাসুদেববেড়িয়া, রসুলপুর, বৃন্দাবনচক এবং ঘোলাবার গ্রামে একসময় বহু বেণী পুতুল শিল্পী বাস করলেও এখন তাদের অনেকে অন্য জীবিকায় সরে গেছেন। পদ্মতামুলি গ্রামে এখনও এই শিল্পীরা সক্রিয়। পদ্মতামুলির বেণী পুতুল শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন বসন্ত কুমার ঘড়াই, শ্রীমন্ত ঘড়াই, পরশুরাম ঘড়াই, রামকৃষ্ণ ঘড়াই, অরবিন্দ ঘড়াই, অমল ঘড়াই, সুচিত্রা ঘড়াই এবং প্রতীক ঘড়াই প্রমুখ শিল্পীরা। এরা এখনও এই পুতুল নাচ দেখান। পদ্মতামুলি বেণী পুতুল শিল্পীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
পদবী বলছে এরা হাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ। দলিত সম্প্রদায়ের এই মানুষরা থাকেন হরিজন পল্লীতে। এদের অনেকেই আগে ছিলেন পালকি বেহারা। একসময় এই গ্রামে ৭০/৮০টি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দারিদ্র এবং কাজের সুযোগ না থাকায় অনেকে পেশা ছেড়েছেন। সুযোগ পেলেই আবার তারা এই পুতুল নাচে ফিরতে চান। অভাবের তাড়নায় শিল্পীদের অনেকেই এখন ছুতোর মিস্ত্রী, দিনমজুর, রিকশ চালানোর কাজ করেন। এই গ্রামের সেরা শিল্পী বসন্ত কুমার ঘড়াইয়েরও রয়েছে একটা মুদির দোকান।
বেণী পুতুলের একটা বৈশিস্ট্য হল, এর মবিলিটি বা পরিবহণ যোগ্যতা। যেকোন জায়গায়, যেকোন পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে এই গ্লাভ পাপেটের শিল্পীরা অনুষ্ঠান করেন। সারা পৃথিবীতেই এই পাপেট খুব জনপ্রিয়। নাটক, বিজ্ঞাপন, প্রচার, রিয়্যালিটি শো সব জায়গায় বেণী পুতুলের ব্যবহার বাড়লেও এখানে স্রেফ ভাবনা ও উদ্যোগের অভাবে এই পুতুল নাচ বিপন্ন।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বেণী পুতুল শিল্পীরা এখন অনেকটা রড পাপেটের স্টাইলে ছোট ছোট নাটক দেখাচ্ছেন। তাদের পুরনো তাৎক্ষণিক সংলাপ রচনা ও গান বাধার দক্ষতা চর্চার অভাবে কমছে। গ্রাম্য সংলাপে জায়গা নিয়েছে প্রসেনজিৎ- ঋতুপর্ণার ঝগড়া। স্থানীয় লোকশিল্পীরা এই পুতুল নাচ নিয়ে জীবিকা করতে চান কিন্তু তারা কীভাবে এগোবেন, কীভাবেই বা অবিকৃত থাকবে এই পুতুল নাচ সেটা একটা বড় সমস্যা।