(প্রথমেই বলে রাখা ভালো বাঙালির অভাবিত নবজাগরণের উদ্ভব ঘটে পূর্বাঞ্চলে ইংরেজ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পর। আর তার বিলোপ ঘটতে থাকে ইংরেজ শাসন অবসানের সূচনা থেকে। তৎকালীন সময় নানা বই-পত্রে, চিঠিতে ইংরেজ শাসকগণ বাঙালি জাতি কেমন ছিল তাঁদের চোখে তার নমুনা রেখে গেছে। এগুলি সম্পূর্ণই বিভিন্ন শাসকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী। আমাদের চেষ্টা থাকবে তৎকালীন সময়ে বাঙলা জাতিকে কী রূপ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তার একটি কোলাজ তুলে ধরা।)
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর কয়েক দশক পর্যন্ত — অর্থাৎ রাজা রামমোহন রায়ের কাল থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পর্যন্ত শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা জাতীয় জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বাঙালি ভারতের নেতৃত্ব দিয়েছে। মুসলিম আমল বা তার আগে হিন্দু যুগে বাঙালির প্রভাব কোনকালেই দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করতে পারেনি। মহাভারতের বিশাল কর্মকাণ্ডে বঙ্গে উল্লখ অবশ্যই বিদ্যমান। তবে তা অত্যন্ত গৌণ এবং অগৌরবের। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে বঙ্গরাজ যোগ দিয়েছিলেন সত্যধর্মব্রতী পাণ্ডব পক্ষে নয়, অধার্মিক কৌরব পক্ষে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি স্বয়ং দুর্যোধনের পশ্চাদভাগ রক্ষা করেছিলেন। মোগল বা পাঠান আমলে বাংলার বাইরে বাঙালির সগৌরব উপস্থিতি নগণ্য-প্রায়। তাই বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে বাঙালির অভাবিত নব জাগরণের উদ্ভব ঘটে পূর্বাঞ্চলে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর। আর তার বিলোপ ঘটতে থাকে ইংরেজ শাসন অবসানের সূচনা থেকে। এই প্রায় শতাব্দীব্যাপী সময়ে বাংলার মণিষীগণ প্রতিভা ও সমহান চরিত্রবলে সর্বজনশ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন। বস্তুত : বাঙালির সামগ্রিক ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর ঘটনা যাকে ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন, কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ ছিল অধিকতর ব্যাপক, গভীর ও বিপ্লবাত্মক। কিন্তু এ দেশে ইংরেজ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সময়ে অথবা আরও সুস্পষ্টভাবে বলা যায় এই নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব কালে বাংলার সাধারণ মানুষের চরিত্র কেমন ছিল?
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বৃত্তির মানুষ — পরিব্রাজক, সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বিভিন্নভাবে বাঙালি চরিত্রের রূপ নির্দেশ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী পরস্পরবিরোধী। কেউ বলেছেন বাঙালি চরিত্রের রূপ নির্দেশ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী পরস্পরবিরোধী। কেউ বলেছেন বাঙালি চিন্তাশীল, বিপ্লবী; কারও মতে বাঙালি কল্পনাবিলাসী, বাস্তববিমুখী, অলস। আবার কারও কারও ধারণা বাঙালি কলহপ্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক। কোনও ব্যক্তিচরিত্রকে একটিমাত্র অভিধায় চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য। আর সমাজ তো বিচিত্র মানুষের সমষ্টি মাত্র। কাজেই দ্রষ্টার মানসিকতা, পরিবেশ ও কাল অনুযায়ী তার উপলব্ধি ভিন্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
পলাশী যুদ্ধের পনেরো বছর পর রামমোহনের আবির্ভাব। তাঁর জন্মের (২২ মে ১৭৭২) মাত্র এক মাস পূর্বে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন (১৩ এপ্রিল ১৭৭২)। তখন এদেশে ইংরেজ শাসন অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং ক্রমেই অর্জন করছে দূর্বার শক্তি। ঠিক এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মী বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বাঙালি চরিত্র সম্বন্ধে সরকারের কাছে বা কোম্পানীর সদরে যে সব গোপন রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন বা বিবরণী পেশ করেছিলেন সেগুলিতে তৎকালীন সমাজের এক রৌদ্রদীপ্ত চিত্র প্রতিভাত। এতে তাঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গভীর বিচারশক্তি ও নির্ভীক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
জন শোরের বিবরণ
আজ থেকে প্রায় আড়াই দশক আগে ১৭৮৪ সালে স্যার জন শোর (তিনি লর্ড কর্নওয়ালিসের সহকর্মী ছিলেন এবং কর্নওয়ালিসের পর ২৮ অক্টোবর ১৭৯৩ সালে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়। প্রথম কর্মজীবনে তিনি মুর্শিদাবাদে রাজস্ব বোর্ডের ও পরে রাজশাহীতে রেসিডেন্টের সহকারী হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছিলেন।) এক বিবরণীতে লিখেছিলেন — “বাঙ্গালীরা ভীরু ও দাসসুলভ। নিজেরা কিন্তু অধন্তনদের কাছে উদ্ধত। অথচ উপরওয়ালার কাছে এরা সাধারণত বাধ্য থাকে। তবে যেখানে শাস্তির ভয় নেই সেখানে মনিবের কাছেও দুর্বিনীত হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তি হিসেবে এদের মানসম্মান বোধ কুব কম। জাতি হিসেবে এদের জনকল্যাণমূলক মতোভাব একেবারে নেই। যেখানে মিথ্যা কথা বলতে এদের একটুও বাধে না। এদিকে কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই সর্বদা নিজেদের গুণগরিমার কথা বড়াই করে বলে। বাইরের লোকের কাছে বলতে হয় তাই বলে ; এর বেশী কোন মূল্য নেই।
এরা মনে করে চালাকি ও কূটকৌশল জ্ঞানের পরিচায়ক। লোকঠকানো ও ফাঁকি দেওয়া জ্ঞানী লোকের গুণ। এদের কাছে সবচেয়ে অপমানকর হল জাতিচ্যূত হওয়া। ধর্মের বিধান অমান্য করলে ধর্মগুরু এই শাস্তি দিয়ে থাকেন।
এদের সমাজে মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা, ধর্ষণ বা নরহত্যা করা জাতিচ্যুত হওয়ার মত গুরুতর অপরাধ নয়।
হিন্দুর সব কিছুই আত্মকেন্দ্রিক। আত্মস্বার্থই এদের চালিত করে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক পরের কথা। অর্থ লালসা এদের প্রেরণার উৎস। এরা যে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে পারে, চাকরের মত তোষামোদ করতে পারে, ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকি দিতে পারে এবং তা করেও থাকে সে-কথা বিশ্বাস করতে হলে এদের মধ্যে বেশ কিছু কাল কাটাতে হবে আমরা অযথা এদের মধ্যে সংস্কারমুক্ত মন, গভীর চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ খুঁজে মরি। হিন্দুদের শিক্ষা তাদের নিজ ভাষা পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মুসলমানদের শিক্ষাবস্থা কিছুটা উন্নত। তাদের কিছু নীতিকথা, রাজকার্যের কিছু মূল সূত্র শিখতে হয়, যদিও কার্যকালে সেগুলি মেনে চলে না। তাদের রাষ্ট্রশাসনের জ্ঞান ঐ পর্যন্তই। এর ব্যতিক্রম অতি বিরল। অত্যাচার ও বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে নেটিভরা যে পর্যায়ে নেমে যেতে পারে একজন ইংরাজের পক্ষে তা সম্ভব নয়; সে-কথা ভাবলেও তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। এ কথা যদি মেনেও নিই যে কোনও কোনও ইংরাজ স্বভাবদোষে বা প্রয়োজনের তাগিদে ভ্রষ্টাচারী হয়, তৎসত্ত্বেও তাদের মনে যে সামান্য নীতি ও সম্মানবোধ থাকে তাতে করে বাংলার একজন নেটিভ যে পর্যায়ে নেমে যেতে পারে তারা তা পারে না। সাধারণত রায়ত থেকে আরম্ভ করে দেওয়ান পর্যন্ত সকলেরই কাজ হল কথা গোপন করা, অন্যকে ফাঁকি দেওয়া। একটা সাদা কথার ওপরে এরাএমন একটা আবরণ জুড়ে দেয় যা মানুষী বুদ্ধির দ্বারা ভেদ করা কঠিন।”
চার্লস গ্রান্টের প্রতিবেদন
এর প্রায় এক দশক পরে চার্লস গ্রান্ট এশিয়াবাসী ব্রিটিশ প্রজাকূলের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে এক প্রতিবেদন লিপিবদ্ধ করেন। রচনাকাল প্রধানত ১৭৯২ সাল। তবে ১৭৯৭ সালের ১৬ আগস্ট তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোর্ট অব ডাইরেক্টরের কাছে সভার আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য এটি প্রেরণ করেন। গ্রান্ট এ দেশে কোম্পানীর বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন। ১৯৭০ সালে যখন দেশে ফিরে যান তখন তিনি ছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিসের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা। তিনি নিজেই বলেছেন এ দেশে কাজ করবার সময় তাঁর অধিকাংশ কাল কেটেছে প্রদেশের অভ্যন্তরভাগে দেশীয় লোকদের মধ্যে। লন্ডনে ফিরে যাবার চার বছর পর তিনি কোম্পানির ডিরেক্টার নির্বাচিত হন এবং ১৭৯৭ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত (১৮২৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়) যে ছয় বার ডিরেক্টর বোর্ডের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার প্রত্যেক বারেই তিনি জয়ী হন। তিনি তিনবার কোম্পানীর চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী পুরুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সর্ব বিষয়ে ঈশ্বরপ্রেরিত প্রতিনিধি হিসেবেই তিন কাজ করছেন। গ্রান্ট তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, —
“নেটিভদের স্বভাব-চরিত্র অত্যন্ত শোচনীয়, অশ্রদ্ধা ও করুণার উদ্রেক করে। তবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিশাল সমাজে যে ভালমন্দ থাকবে না এমন নয়, নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা প্রায় একই।
ঐ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলার অধিবাসীদের স্থান সর্ব নিম্নে। সমাজের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্য যে সমস্ত গুণাবলী প্রয়োজন বাঙ্গালীদের মধ্যে সেগুলি প্রায়শই বিস্ময়কররূপে অনুপস্থিত। তাদের মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার বড়ই অভাব। ইউরোপীয় সমাজে এর নজির মেলা ভার। সেখানে এই সব নীতিবোধকে চরিত্রবল ও সুনামের ভিত্তি বলে গণ্য করা হয়; যাদের এসব গুণ নেই তারাও অন্তত থাকার ভান করে। যারা এসব গুণে একেবারে বঞ্চিত তাদেরকে সবাই ঘৃণা করে। বাংলায় কিন্তু এমনটি ঘটে না। এই সব গুণাবলী এখানে এমনভাবে লোপ পেয়ে গিয়েছে যে সমাজে তার একটা ছদ্মবরণ রাখারও প্রয়োজন বোধ হয় না। এই গুণ অর্জনের বা রক্ষার চেষ্টাও নেই। আবার এইসব গুণ সামাজিক সম্পর্কও নিয়ন্ত্রিত করে না। যাদের এসব গুণ নেই, তা যতই প্রকট ও ঘৃণ্য হোক না কেন, সাধারণের চক্ষে তারা হেয় বলে গণ্য হয় না, অথবা এই কারণে পরিচিতদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কচ্ছেদও ঘটে না। মিথ্যাচারিতা এদের এমন স্বভাব যে কোনও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে এদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যা কথা বলা এমন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে এতে কেউ উত্তেজিত বোধ করে না। মনে করে এসব মেনে নিতে হয়। এই আচরণ মেনে চলার ফলে এটা যে দোষের সে বোধটাই চলে গিয়েছে। সাধারণ কাজেও লোক ঠকানো, ফাঁকি দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, চুরি করা এমন একটা সাধারণ ঘটনা যে হিন্দুরা একে স্বাভাবিক অনাচার বলে মনে করে। নিজেকে এ সবের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না। সত্য ও সততার লজ্জাকর অপলাপ ঘটলেও সমাজে তার কোন স্থায়ী বা গভীর প্রভাব পড়ে না। (চলবে)