তির তির করে বয়ে চলেছে বেহুলা। শীর্ণকায়া বেহুলা বর্ষায় যৌবনবতী হয়। একটু আগে গিয়ে গা ভাসিয়েছে গাঙ্গুরের জলে। সেটাও নদী। স্থান কালনার বৈদ্যপুর। গ্রামের নাম তালা। বৈদ্যপুর রথতলা স্টপেজ থেকে এক কিমি রাস্তা। গ্রামের বুক চিড়ে কুচকুচে কালো আঁকাবাঁকা শরীরটা টানটান হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। দু-পাশে সবুজ গালিচায় ঢাকা। চারা ধানগুলো সবে মাত্র কৈশোর পেরেয়ি যৌবনে পা দিয়েছে। হেমন্তে মিলন ঘটবে, বুকে দুধ জমবে। তারপর পৌষে সোনালী ধানে ভড়ে যাবে গোটা অঞ্চল।
যে কথা বলছিলাম, এই তালা গ্রামের দুপাশে দুই নদী বেহুলা আর গাঙ্গুর। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যে কিংবা কবিকঙ্কন মুকুন্দদাসের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বা কবিবল্লভের শীতলামঙ্গল কাব্যে বৈদ্যপুরের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যে এই গ্রামে যে বৈদ্যদের বাস ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগরের কাহিনী মনে থাকলে দেখবেন মনসার অভিশাপে লক্ষীন্দরকে সর্প দংশন করে বেহুলা তাঁর স্বামীকে নিয়ে ভেলায় চড়ে গাঙ্গুরের জলে ভাসেন। এখানেও গাঙ্গুর নদী রয়েছে। বেহুলা ভেলা থামিয়ে বৈদ্যপুরে এসেছিলেন বৈদ্যের খোঁজে। সেই বেহুলা নদীর তীরেই ঘর ছাড়াদের স্বপ্নের আবাসস্থল ‘বেলাশেষে’ বৃদ্ধাশ্রম। এর কারিগর প্রণব রায়।
সাদামাটা চেহারার ছোট্ট মানুষটাকে দেখলে মনেই হবে না তিনি এই রকম একটা কাজ করতে পারেন। এর জন্য তো অনেক সাধনা করতে হয়। মানুষের ভাল করতে চাওয়া এটা একটা মহৎ কাজ। সেটা সকলের দ্বারা সম্ভব নয়। কৃচ্ছ সাধনা করতে হয়। বছর চারেক আগে প্রথম দেখা। সাধারণ মানের মানুষটার মধ্যে যে অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে সেটা বিশ্বাস করা যায় না। যে তাঁর এই কাজের অনুপ্রেরণা সেই প্রাক্তন মন্ত্রী কালনার ভূমিপুত্র আবদুস সাত্তার মারা যাওয়ার চার বছর আগে জন্মেছেন প্রণব।
কিন্তু ছোট থেকে তাঁর মহৎ কাজের গল্প শুনে শুনে মগজে খোদাই করে নিয়েছিলেন আবদুস সাত্তার মহাশয়কে। তাঁর কথায় দেখিনি ঠিক, কিন্তু গুরুজনদের মুখে তাঁর গল্প শুনে তাঁকেই আমার কাজের প্রাণ পুরুষ বলে মনে নিয়েছি। তৈরি করেছি আবদুস সাত্তার স্মৃতি রক্ষা কমিটি। এই যে বৃদ্ধাশ্রম এটা ওই ব্যানারেই। বর্তমান সাংসদ দু-বার টাকা দিয়েছেন। বাকি এই অঞ্চলের সকলের সাহায্যে তৈরি হয়েছে। বলতে পারেন তিলে তিলে তিলত্তমা। এখনও সকলের সাহায্যেই চলছে এই বৃদ্ধাশ্রম। কেউ খাবারের বন্দবস্ত করে দিচ্ছে। কেউ লাইটের বিল দিচ্ছে। কেউ আবার আবাসিকদের ওষুধ কেনার পয়সা দিচ্ছে। মোট কথা চলে যাচ্ছে। বর্তমানে ১৬ জন আবাসিক তার সঙ্গে দেখভালের ৪ জন। ২০ জনের চার বেলার খাওয়ার জোগাড় করে এরাই।
২
শেফালিদেবীর কথা মনে পড়ে আপনাদের? শেফালি মজুমদার, আন্দুলের পানিয়াড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা।
স্বামী বিজয়রতন মজুমদার মারা যান বছর কুড়ি আগে। দুই ছেলের মধ্যে একজন মারা যান ২০০৩ সালে। শেফালিদেবী অবসর নেন ২০০১ সালে। এককালীন পেনশনের টাকা পেয়ে হাওড়ার শিবপুরে জমি কিনে বাড়ি করেন। ২০০৬ সালে ছোটো ছেলের বিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যে ছেলের বিবাহবিচ্ছেদ হলে ফের বিয়ে দেন পরের বছর। সেই ছেলেই চরম অপরাধ করলেন মায়ের সঙ্গে। ব্যবসার জন্য টাকা লাগবে বলে বাড়ি বিক্রি করে তিনি মাকে বলেছিলেন, ব্যবসায় উপার্জন হলে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনব। কিনেও ছিলেন কলকাতার হাতীবাগান এলাকায়। মাকে নিয়ে এসে কয়েকদিন রেখেও ছিলেন।
তারপরের গল্প সব এক। মা সংসারের বোঝা। তাকে নিয়ে চলা দায়। এরপর শেফালি দেবীকে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন তাঁরই প্রাক্তন সহকর্মী, আন্দুলের সন্ধ্যামণি বিশ্বাস। কিন্তু তাঁর পক্ষেও বেশিদিন শেফালিদেবীর ভার বহন করা সম্ভব হয় নি। এরপর এক বাড়িতে আয়ার কাজ নিলেও বয়সের ভারে তা ছাড়তে বাধ্য হন শেফালি দেবী। একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কিন্তু ভাড়া দিতে না পারায় বের করে দেন বাড়ির মালিক। শেষে আশ্রয় আন্দুল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।
সে সময় শেফালিদেবীর কাহিনী বেশ বড়ো বড়ো করে দৈনিকের হেড লাইন হয়েছিল। শেষে প্রণব রায়ের অকুণ্ঠ চেষ্টায় আশ্রয় মিললো বেলাশেষে। দিব্বি আছেন এখানে আর ১০ জন আবাসিকদের সঙ্গে। শেফালিদেবীর ছোট্ট জবাব, ‘‘আমার জীবনে কষ্টের কাহিনি রয়েছে। তবে সব ভুলে গিয়েছি এখানে এসে। আগের থেকে সুস্থও বোধ করছি।’’
প্রণববাবু জানান, তিনি আন্দুল স্টেশনে ফোন করে শেফালিদেবীর সম্পর্কে খোঁজ নেন। তার পরে যোগাযোগ করেন কালনা থানার সঙ্গে। কালনা ও হাওড়ার পুলিশের সহযোগিতায় সপ্তমীর রাতে বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছন শেফালিদেবী। সেটা ২০১৮ সালের গল্প।
অতীত স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে শারদোৎসবের আনন্দ পেতে উৎসবে মেতেছেন কালনা-২ ব্লকের তালা গ্রামের বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। এবার বৃদ্ধাশ্রমের দুর্গা পুজো চতুর্থ বর্ষ। পরিজনদের কাছ থেকে দূরে থাকা আবাসিকদের মধ্যে পুজোর আনন্দ যেন অতীত ভুলে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরা। কেউ মাকে পরানোর জন্য সাধ্যমতো কাগজের মালা তৈরি করেছেন। কেউ দেবীকে পরানোর জন্য নিজের জমানো টাকায় কিনে এনেছেন সিঁদুর, আলতা। কালনা-২ ব্লকের তালা গ্রামে বেহুলা নদীর পারে সুন্দর পরিবেশে আব্দুস সাত্তার সমাজকল্যাণ কেন্দ্রের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম ‘বেলা শেষে’। প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন এমন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আশ্রয়স্থল। উৎসব এলে প্রিয়জনদের কথা মনে করে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে দূরে ঠেলে দেওয়া সন্তান পরিজনদের জন্য মায়ের কাছে সুখ শান্তি কামনা করেন এমনই জানালেন আশ্রমের আবাসিক সত্তরোর্ধ্ব রাসমণিদেবী, শ্যামলীদেবী, কানাইবাবুরা।
একবুক ভাড়ি নিঃশ্বাস নিয়ে ফিরছিলাম প্রণববাবুর গাড়িতে। বার বার আবাসিকদের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শিশু সুলভ চোখ মুখ। নিজের মনে নিজে রয়েছেন সকলে। এরাই একদিন তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কতো রাত জেগেছেন। হয়তো একমাত্র সন্তানের শরীর খারপে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে পালা করে রাত জেগেছেন। ছেলে যখন ছয়মাসের শিশু, হয়তো কোন এক শীতের রাতে বিছানায় পেচ্ছাপ করে কেঁদে উঠেছে তখন শিশু সন্তানের কান্নায় বাবা কিংবা মা নিজের বুকে তার শিশু সন্তানকে তুলে নিয়ে সারাটা রাত হয়তো জেগেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সন্তান তার বাবা কিংবা মায়ের বুকের ওমে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থেকেছে। ঘন বর্ষায় রাস্তায় জল জমে গেছে। বাবা ছেলেকে কাঁধে করে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরেছেন। ছেলের জন্য বাবা মাকে কতো লাঞ্ছনা-গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। হয়তো নিজেদের ইচ্ছে না থকলেও একমাত্র ছেলের বৌকে হাসিমুখে মনে নিয়েছেন। আর আজ তাঁদের সবচেয়ে বড়ো দুর্দিনে যাদের সর্বক্ষণ পাশে থাকার কথা সে কিনা বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দেখাচ্ছে!
লেখাটা পড়ে মন ভারী হয়ে গেল। জীবনের যে কত বাঁক! কোথায় এসে যে থিতু হয় কে জানে।
চলুন একদিন আসল মানুষগুলোকে দেখে আসি। বেশ আছে সবাই।