ড. আহমদ শরীফ ‘বিচিত চিন্তা’ প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘জাতীয় জীবনে লোক-সাহিত্যের মূল্য’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন — ‘আমাদের ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন,গান, গাথা ও রূপকথা নিশ্চিতই প্রাকৃতজনের সৃষ্টি।’ বেগম রোকেয় প্রাকৃতজনের সে সব সৃষ্টিকে অবলীলায় ও অনায়াসে প্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করেছেন — দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। তাঁর রচনায় প্রবাদ, প্রবচন, লোকগাথা ও রূপকথার ব্যবহার লোকজীবন তথা গ্রামীণ বাঙালীর ঐতিহ্যবোধের সাথে একাত্মতার বহিঃপ্রকাশ বৈ তো নয়!
মুসলমান সমাজ বেগম রোকেয়া থেকে ১০/১২ বৎসর পরে স্ত্রী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝেছেন। তাই তিনি সখেদে “সিসেম ফাঁক” রচনায় বলেছেন — ‘গরীবের কথা বাসি হইলে ফলে; আমার কথাও (১০/১২ বৎসরের) বাসি হইয়া ফলিয়াছে।’ এতে একদিকে বাংলার সামন্ত সমাজে গরীবের মতামতের মূল্যহীনতার তথ্য আর অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানগত চিত্র যা প্রবাদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। বহুল প্রচলিত কাঙাল শব্দের পরিবর্তে গরীব শব্দটি ব্যবহার করেছেন মাত্র।
হাজার বছরের চাষীর যাপিত জীবন ও জগতের চিত্র রোকেয়ার “চাষার দুক্ষূ” প্রবন্ধে:
“ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরি, রে ভাই,
পাছায় জোটে না ত্যানা।
বৌ -এর পৈছা বিকায় তবু
ছেইলা পায় না দানা।”
তিনি ‘ধান ভানিতে শিবের গান কেন’ প্রবাদটি বলে নিজেই এর কৈফিয়ৎ দিলেও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন করার ফুসরৎ নেই। চাষার দীন হীন অবস্থার সুর পাই ‘পাছায় জোটে না ত্যানা’ বলে যখন আক্ষেপ করেন। ‘ত্যানা’ শব্দটিও লোক জীবনাচারের অংশ। আর ‘ছেইলা পায় না দানা’ তো চাষার পরিবারের অপরিবর্তিত দৃশ্য। আজও ফসল উৎপাদনকারী চাষীর ঘরে দানা অর্থাৎ খাবারের অভাব। অভাবগ্রস্থ এ যাপিত জীবন চিরায়ত গ্রামীণ সমাজের কাঠামো।
“একটি চাউল পরীক্ষা করিলেই হাঁড়ি ভরা ভাতের অবস্থা জানা যায়।” “চাষার দুক্ষূ” প্রবন্ধে ব্যবহৃত এ প্রবাদের মতো আমারাও বেগম রোকেয়ার প্রবাদ, প্রবচন, গান ও গাথা ব্যবহারের দু’একট নমুনা পড়েই তাঁর জীবনে এ সবের প্রভাব, প্রতিফলন ও প্রভূত্ব করার উত্তাপ পাই।
‘রংপুর জেলার কোন কোন গ্রামের কৃষক এত দরিদ্র যে, টাকায় ২৫ সের চাউল পাওয়া সত্ত্বেও ভাত না পাইয়া লাউ, কুমড়া প্রভৃতি তরকারী ও পাট-শাক, লাউ শাক ইত্যাদি সিদ্ধ করিয়া খাইত।’ এ লাইন কয়টিতে শত বছর যাবৎ ‘উত্তর বঙ্গে মঙ্গার’ উপস্থিতির ইতিহাস পাই। জমিদার কন্যা রকু অন্তঃপুরবাসিনী হয়েও উত্তর বঙ্গে মঙ্গার ক্ষুধার জ্বালা কীভাবে উদরে অনুভব করলেন তা নিয়ে গবেষোণার প্রয়োজন বৈ কি! রংপুরের মাটির সাথে তাঁর অস্তিত্ত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশদারিত্বের প্রথম উল্লেখও পাই “চাষার দুক্ষূ” প্রবন্ধে।
‘বঙ্গীয় নারী- শিক্ষা সমিতি’ প্রবন্ধটি বঙ্গীয় নারী- শিক্ষা সম্মেলনে সভানেত্রী হিসেবে লিখিত অভিভাষণ। এ ভাষণে নিজেই বলেছেন —
‘আমি আজীবন কঠোর সামাজিক ‘পর্দার’ অত্যাচারে লোহার সিন্দুকে বন্ধ আছি — ভালরূপে সমাজে মিশিতে পারি নাই —’ কিন্তু সিন্দুকে বন্ধ থেকে — বন্দী থেকে কী করে মুক্ত জীবনাভিজ্ঞতার এতো আস্বাদন আমাদের দিলেন! এ লিখিত ভাষণ তিনি সাজিয়েছিলেন বিভিন্ন প্রবাদ, প্রবচন ও পুঁথি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। যেমন — ‘বলিতে আপন সুঃখ পরনিন্দা হয়”,
“মাতা যদি বিষ দেন আপন সন্তানে
বিক্রয়েন পিতা যদি অর্থ প্রতিদানে” —
অথবা
“বহুদিন হইল একটি বটতলার পুঁথিতে পড়িয়াছিলাম:
“আপনি যেমন মার খাইতে পারিবে,
বুঝিয়া তেয়ছাই মার আমাকে মারিবে।”
আর লোক সাহিত্যের উপাদানে বটতলার পুঁথি যে ভরপুর তা তো সর্বজন স্বীকৃত।
বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা খানমকে নিয়ে লিখিত ‘লুকানো রতন’ স্মরনিকায় ‘শাপেই বর’ বাগধারা ব্যবহার করে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন বেগম রোকেয়ার লেখা বাংলার ঐতিহ্য থেকে উপাদান নিয়েই রচিত। রামায়ণের রাজা দশরথের উপরে বর্ষিত অভিশাপ আশীর্বাদ হিসেবেই দেখা দিয়েছিল — যা হয়তো কালান্তরে শাপে বর বাগধারা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে।
করিমুন্নেসা লোক সাহিত্যেরই শাখা বটতলার পুঁথি পড়তে গিয়েই বাবার কাছে ধরা পড়ে বাংলা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখানে অবশ্য রোকেয়ার সাথে লোক জীবিনাভিজ্ঞতার যোগসূত্রের ক্ষীণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ নামক লেখায় সাখাওয়াত মেমোরিরিয়াল গার্লস স্কুল নিয়ে বেগম রোকেয়ার আশা-হতাশা, রাগ-ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল লোকজ জীবনের চেতনার সাথে একাকার হয়ে —
‘ঘুঘু চরবে আমার বাড়ী,
উনুনে উঠবে না হাঁড়ী,
বৈদ্যেতে পাবে নে নাড়ী –
অন্তিম দশায় খাবি খাব!”
জৈব বংশধরদের জন্যেই ব্যক্তিগত মালিকানার উন্মেষ এবং তাদের ভবিষ্যতের আর্থিক নিশ্চয়তা নিশ্চিন্ত করতেই দুর্নীতির সৃষ্টি।কাজেই “আমার কোন বংশধর নাই’ বলে রোকেয়া তাঁর নিঃস্বার্থ কাজের — উদ্যোগের কথা বলেছেন। এতে বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় চর্চিত রীতি নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাঁর গভীর পরিচয়ের ইঙ্গিত মেলে।
রোকেয়া বলেছেন যে তাঁর কোন জৈব বংশধর নেই, কারণ তৎকালীন শুধু নয় এখনো বংশধর বলতে বংশের বাতি দেয়ার জন্যে জৈব উত্তরাধিকারকেই — বাইলজিক্যাল সম্পর্ককেই বুঝানো হয় — যা আমাদের দেশের আম জনতার ধারণা। একদিক থেকে বেগম রোকেয়ার ধারণা ও চেতনায় সে সুরই চর্চিত হয়েছে। তবে বর্তমান নারী আন্দোলনের অনেক নারী কর্মী ও নেত্রী রোকেয়ার চাওয়া ও চেতনার, ভাব ও আদর্শের,ধ্যানের ও ধারণার, কীর্তি ও কর্মের ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক বংশধর ও উত্তরাধিকার।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইয়ংবেঙ্গলদের প্রভাবে ও হুজুকে অনেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-আচরণে এমনকি ভাষা ব্যবহারেও এসেছিল পরিবর্তন যা রোকেয়া তৎকালীন প্রচলিত প্রবচন ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছেন — ‘বলেন বিলাতি বুলি; চাকরকে বলেন বেহারা আর মুটেকে বলেন কুলী।”
লোকগাঁথা ‘সোনাভান’ পুঁথি পড়ার তথ্য সহ মুসলমানদের সম্পর্কে যে সব নেতিবাচক ছড়া ছিল তা ও রোকেয়ার জানা ছিল এবং সে সব অবলীলায় উদ্ধৃত করেছেন।
‘মুসলমান বে- ইমান।
মারো জুতা, পাকড়ো কান!’
অথবা:
‘নেড়ে মুসলমান। –
তার না আছে ধন, না আছে মান!’
‘হজের ময়দানে’ রচনায় তিনি হজ ময়দানে তীর্থযাত্রীর মনের কথা প্রকাশ করতে লোকসাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছেন:
‘কি যেন স্বপনে হারাই আপনে
মনেই থাকে না এ যে ধরাতল।’
বটতলার পুঁথি থেকে উদ্ধৃত করেছেন:
‘বেহেশতে না যাব মোরা, মেওয়া না খাইব,
দেখিয়া তোমার রূপ এইখানে র’ব।’
‘হজের ময়দানে’ হাজীদের অন্তরের সুর প্রকাশে অজানা কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন,
‘নাহি চাহি ধন–জন-মান, —
নাহি প্রভূ! অন্য কাম!
আহা! এ ময়দান ছাড়িয়া আর কোথাও যাইব না!’
নারী পুরুষভেদে প্রায় প্রত্যেক মুসলিমের এ আকাঙ্ক্ষা। আর তিনি পুরুষের সাথে নারীকেও হজ প্রান্তরে দেখার প্রার্থনা করছেন।
‘নারীর অধিকার’ নামক অসম্পূর্ণ লেখাটি রোকেয়ার মৃত্যুর পরদিন তাঁর টেবিলে পেপার ওয়েটের নীচে পাওয়া যায়। এতে উত্তর বঙ্গের গ্রামে তালাকের যে চিত্রপট এঁকেছেন তা আজও সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র।
আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধঃস্তন অবস্থানের চিত্র বুড়ার বিয়ে করার শখ যা লোক ছড়ার মাধ্যমে প্রকাশিত-
“হুকুর হুকুর কাশে বুড়া
হুকুর হুকুর কাশে।
নিকার নামে হাসে বুড়া
ফুকুর ফুকুর হাসে।।‘
এ ছড়াটি ‘নারী অধিকার’ লেখায় ব্যবহার করে দেখিয়েছেন দাম্ভিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এমন অনেক আচার- আচরব, রীতি-নীতি হাস্যরসের উদ্রেক করে। তবে তা অবশ্য অনেক নারীর জীবনে নামিয়ে দেয় ঘন অমানিশা।
পদ্মরাগ
বেগম রোকেয়ার লেখা একমাত্র উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ নারীবাদের বিভিন্ন ভাবনার প্রতিফলনের সাথে বাংলার লোক সংস্কৃতির অনেক স্বাক্ষর রয়েছে। সিদ্দিকা তথা পদ্মরাগ — যার আসল নাম জয়নব বেগম রোকেয়ার নারীবাদী চেতনার এক বলিষ্ঠ্য প্রকাশ। এ উপন্যাসের পরিণতি পাঠককে ভাবায়, কাঁদায় ও চিন্তায় ভাসায় বৈকি? পদ্মরাগ ভাঙ্গে তবু মচকায় না। সে নিয়তিকে জয় করে রোকেয়ারই ইচ্ছা শক্তির জোরে। এ উপন্যাসে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে গেছে লোক জীবনের রীতি-নীতি, আদব- কায়দা, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-চেতনা।
‘গঙ্গাস্নান’ করে পবিত্র হওয়া আবহমানকাল ধরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের খবর অসাম্প্রদায়িক বেগম রোকেয়ার জানা ছিল বলেই সপ্তম পরিচ্ছেদে লিখেছেন — ‘তারিণী-ভবন’ গঙ্গা — ইহাতে এক ডুব দিলেই সকলে পবিত্র হইয়া যায়। গঙ্গাস্নানের সাথে সেবাশ্রমকে তুলনা করে লৌকিক জীবনবোধের জয়গান গেয়েছেন। (ক্রমশ)