তিনি এ সব কোথা থেকে বা কার কাছে শিখেছেন — কীভাবে আয়ত্ত করেছেন, সংগ্রহ করেছেন এর উৎস পথ আমাদের জানা নেই। অর্থাৎ শুধু জানি তিনি লোকপথে হেঁটেছেন তবে তাঁর ব্যবহৃত যানবাহনের বা মাধ্যমের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মহাভারত সংস্কৃত মহাকাব্য হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজীবনে এর প্রভাব অপরিসীম। ‘জ্ঞানফল’ নামক রূপকথা বেগম রোকেয়া মহাভারত মহাকাব্যের অনুসরণে শেষ করেছেন —
“কনকের রূপ কথা অমৃত সমান,
মৃত ব্যক্তি যদি শুনে পায় প্রাণদান।”
মহাভারত লিখিত —
‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান
— কাশীরাম দাস কহে শুনে পূণ্যবান।‘
এ অভিজ্ঞতা আমাদের বিস্ময়াভূত করে বৈ কি! হিন্দুদের রচিত পৌরাণিক মহাকাব্যের রচনাশৈলীতে যে তিনি মুগ্ধ ছিলেন এরও প্রমাণ বহন করে উপরের লাইন দু’টি।
‘নারী-সৃষ্টি’ নামক রচনাকে নিজেই পৌরাণিক উপাখ্যান বলে উল্লেখ করেছেন। আর পৌরাণিক উপাখ্যানের সাথে লৌকিক জীবনের সম্পৃক্ততা তো স্বীকৃত সত্য। বেগম রোকেয়া অবশ্য পৌরাণিক উপাখ্যানের সাথে আধুনিক নারীবাদী চেতনের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
‘নারী-সৃষ্টি’ লেখার পাদটীকা থেকে — “নারীও যেমন প্রাণমনহীন, বুদ্ধি বিবেকহীন একটা কাঠের পুতুল বিশেষ — পুরুষ তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেও সে নিজেকে অপমানিতা বোধ করে নাই, আবার ফিরাইয়া লইতে আসিলেও গৌরব অনুভব করে নাই। ত্বস্তিদেব অবশ্যই জানিতেন, এইরূপ নির্বাক ‘কাঠের পুতুল’ গৃহিণীই পুরুষের বাঞ্ছনীয়া।”
নারী তো সংসার জীবনে আবেগহীন, আকাঙ্ক্ষাহীন কাঠের পুতুলের মতো অস্তিত্ত্ব নিয়েই আজও বাস করে। লোক সমাজে নিরীহ, গোবেচারা আর প্রতিবাদহীন মানুষকে কাঠের পুতুলের সাথে তুলনা করা এখনো স্বাভাবিক ঘটনা।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত ‘নার্স নেলী’ গল্পটি এক বাঙালী মুসলিম নারীর খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের কাহিনী। ‘মাথায় রাখলে যদি উকুনে খায় আর মাটিতে রাখলে যদি পিঁপড়ায় খায়’ বাঙালী জীবনে স্নেহ মমতার আড়ম্বর আর আতিশয্যের প্রকাশে প্রচলিত এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘নার্স নেলী’ গল্পটিতে। এতে আরও রয়েছে বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করার মতো চিরাচরিত অভ্যাসের বিষয়টি বোঝাতে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’-এর মতো প্রবাদ।
লোকাচার গ্রাম বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য যা জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এ লোকাচারও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেগম রোকেয়ার রচনায়। ‘শিশু পালন’ প্রবন্ধে — “যেমন দিদিমার আমলে হিন্দু পোয়াতিকে ৯ দিন থেকে ২১ দিন আর মুসলমান পোয়াতিকে ৪০ দিন আঁতুর ঘরে বন্ধ থাকতে হতো,” — প্রসূতি মায়ের জন্যে বিধি ব্যবস্থায় লোকাচারের বহিঃপ্রকাশ তাঁর অভিজ্ঞতার সীমানায় আবদ্ধ।
‘মুক্তি ফল’ রূপকথাটি রূপকাশ্রয়ী রচনা। লোক কাহিনীর ‘চৌদ্দ পুত-এত দুখ’ পাখির ডাকের উল্লেখ রয়েছে — যা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কল্পনাপ্রসূত। এ পাখি ছাড়াও বিভিন্ন পাখির ডাকের সাথে বিভিন্ন কাহিনী রয়েছে। যেমন, ইষ্টি কুটুম, চাতক, চোখ গেল ও বউ কথা কও। রোকেয়া চৌদ্দ পুত-এত দুখ, চোখ গেল ও বউ কথা কও পাখির ডাকের উল্লেখ করেছেন। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া সমাজ এবং জাতির মুক্তি যেমন সম্ভব নয় তেমনি এখানে মায়ের শাপমুক্তির জন্যে ছেলে ও মেয়ের যৌথ অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুক্তি ফল সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।
“যাহাতে সাপ মরে, লাঠিও না ভাঙে, তদ্রূপ ব্যবস্থে হওয়া চাই।” বেগম রোকেয়া ‘মুক্তি ফল’ রূপকথায় মায়াপুর রাজ্যে মানবগোষ্ঠির প্রবেশ ঠেকাতে এ কৌশলী অর্থবোধক প্রবাদ ব্যবহার করেছেন। এ চালাকি, কূটকৌশল অন্য অর্থে উদ্দেশ্য সফল করার কলাকৌশল বিষয়ক প্রবাদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রমাণ মেলে; যা বাংলার সামাজিকজীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা।
প্রবীণ খাগড়া দিয়ে মানকচু পাতায় চিঠি লিখেছে মায়াপুরের রাজাকে। খাগড়া দিয়ে হাতে খড়ি দেয়ার ইতিহাস আর অভিজ্ঞতা তো গ্রামীণ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। শুধু কচু পাতার সাথে কলা পাতায়ও অ আ লেখার চর্চা হতো। খাগড়া দিয়ে কচু পাতায় লেখার অভিজ্ঞতা বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তথা লৌকিক জীবনের যা রূপকথার সাথে সমন্বিত হয়েছে।
“আপনি বাঁচিলে বাপের নাম।” আপাত স্বার্থপর উক্তি মনে হলেও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ সমাজের এর চেয়ে বাস্তবধর্মী জীবন দর্শন আর কী ই বা হতে পারে! এরই প্রতিধ্বনি শুনি ‘মুক্তি ফল’ রূপকথায় প্রবীণের সংলাপে।
‘মুক্তি ফল’ রূপকথায় পাদটীকায়ও রোকেয়া নিজেই প্রবাদ আছে বলে উল্লেখ করে লোক কাহিনী বলেছেন। রূপকথা শুনিয়েছেন। জিন নিয়ে গল্প বলেছেন। তবে কী রোকেয়ার লোক কাহিনী বা রূপকথা এবং প্রবাদের পৃথকীকরণ ধারণায় অস্পষ্টতা ছিল? জানার উপায় খোঁজা প্রয়োজন। ‘কথিত’ আছে না বলে দুইবার ‘প্রবাদ আছে’ বলে ‘মুক্তি ফল’ রূপকথায় পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন। প্রবাদ ও প্রবচনে অনেকে অনেক সময় পার্থক্য করতে পারে না, কিন্তু প্রবাদ ও লোক কাহিনী বা রূপকথার পার্থক্য তো সুস্পষ্ট।
পাদটীকায় ব্যাসদেবের প্রসঙ্গসহ দেবী দূর্গার কথাও বলেছেন যা ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার বৃহত্তর জন জীবনের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততারই পরিচায়ক।
নিজের দোষ অন্যের কাঁধে চাপানো আমাদের স্বভাব সিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। ‘মুক্তি ফল’ রূপকথায়ও বড় ভাই প্রবীণ দোষ করে ছোট ভাই নবীনের উপর চাপাচ্ছে দেখে নবীন প্রবাদ বলে: “উল্টা চোর কোটাল শাসে!” কম শব্দে একটি কুটিল চরিত্রের বিশ্লেষণ।
লোকজীবন থেকে শব্দ চয়ন পদধূলি — পায়ের ধূলি। ত্বস্তি দেবের আগমনকে উদ্দেশ্য করে ‘সৃষ্টি-তত্ত্ব’ নামক রচনায় তিনি বাঙালী সমাজে বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ গরীবের বাড়িতে ধনীর পদধূলিকে স্মরণ করে লিখেছেন — “অসময়ে নরলোকে পদধূলি’।
’সৃষ্টি-তত্ত্ব’ রচনায় ‘চোরা না শুনে ধরম কাহিনী’ প্রবাদটি তিনি আগে ‘বোরকা’ নামক নিবন্ধেও ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয়বার ব্যবহারের কারণ প্রবাদটির প্রাসঙ্গিকতা, অধিক শ্রুত হওয়া এবং সাধারণ যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক চর্চা বলে ধারণা করা যায় — যার সাথে যে কোনো সূত্রে রোকেয়া পরিচিত ছিলেন।
অন্যান্য প্রবন্ধাবলী
‘রসনা-পূজা’ নামক রম্য রচনায় তিনি সমৃদ্ধ খাবারের কথা বলেছেন এবং হাস্যোদ্রেকের সাথে কিছু পরামর্শ পাই, আরও পাই রন্ধনশালার বাইরের নোংরা পরিবেশের সাথে ভেতরের রসনার জল উদ্রেককারী আয়োজনের খবর — যা দেখে ‘ব্রাহ্মণের পৈতা ছিঁড়িতে ইচ্ছা হইবে!’ মানে খাওয়ার লোভ হবে। উল্লেখ্য যে আমাদের তৎকালীন সমাজে ব্রাহ্মণরা অন্যের বাড়িতে খেতো না এবং ব্রাহ্মণদের এ লোকাচার রোকেয়ার অজানা ছিল না। তাছাড়া, গ্রাম বাংলার অবস্থাপন্ন-স্বচ্ছল বাড়ির রান্নাঘরের চিত্র আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। ভেতরে জিহ্বায় জল উদ্রেককারী খাবারের সামগ্রী আর বাইরে আবর্জনার অপরিচ্ছন্ন স্তূপ।
বেগম রোকেয়া তাঁর রচনায় ‘প্রবাদ আছে’ শব্দ দু’টি বহুবার উল্লেখ্য করে বিভিন্ন প্রবাদ ব্যবহার করেছেন। ‘রসনা-পূজা’ নামক রম্য রচনায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
লোক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন “যা না করে বৈদ্যে, তা করে পৈথ্যে।” অর্থাৎ রসনা বা জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়; রোগের আক্রমণ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেছেন — “একটা বচন আছে; মৃত্যুর পূর্বে মরিয়া থাক।”
রসনা-পূজা নামক রম্য রচনার সারমর্ম আজও আমাদের পরিবারে বিরাজমান এবং এতে আমাদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য রোকেয়া যে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তার প্রতিফলন পাই।
“কবে মুসলমান “মানুষ” হইবে। রসনা পূজা ছাড়িয়া ঈশ্বর পূজা করিতে শিখিবে।” এরই সারমর্ম ধ্বনিত নীচের প্রবচনটিতে —
“মুসলমান করে হাঁড়ি
হিন্দু বানায় বাড়ি
আর ব্রিটিশ কিনে গাড়ি।”
এখানে হাঁড়ি বলতে খাবারের সরঞ্জাম বুঝানো হয়েছে। মুসলমান খেয়ে সব ধন সম্পদ মজিয়ে ফেলে বলে বাংলার লোক সমাজের ধারণা রয়েছে। বেগম রোকেয়ার রচনায়ও যার প্রতিফলন।
ঈদ ও দূর্গা পূজা বাংলার লোক সমাজে সর্বজনীন উৎসব হিসেবেই পরিচিত। সর্বজনীন মানে সকলের জন্যে মঙ্গলকর এ সব উৎসব। আর আবহমান আমেজে উদ্দীপ্ত বেগম রোকেয়া সর্বজনীনতার মূলমন্ত্রটি তাঁর অন্তরে ধারণ করতেন। তাই তো ‘ঈদ-সম্মিলন’ নিবন্ধে লিখেছেন — “এমন শুভদিনে আমরা আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃবৃন্দকে ভুলিয়া থাকি কেন? ঈদের দিন হিন্দু ভ্রাতৃগণ আমাদের সহিত সম্মিলিত হইবেন, এরূপ আশা কি দুরাশা? সমুদয় বঙ্গবাসী একই বঙ্গের সন্তান নহেন কি?” লোকজ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে রোকেয়ার উদাত্ত একাত্মতা। অসাম্প্রদায়িকতা লোক সংস্কৃতির প্রধানতম আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা,ভাব ও ভাবনা, সুর ও সারবস্তু যা বেগম রোকেয়ার রচনায় উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিয়মান। (ক্রমশ)