স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক, তাদের অবস্থা ও অবস্থানকে বুঝাতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের সহাবস্থানকে অস্বীকার করে স্বামীত্ব ও প্রভূত্বকে প্রতিষ্ঠার যে মহড়া তা ব্যাখ্যা করতে লোকসমাজে প্রচলিত রাম ও সীতার কাহিনী যথার্থ বৈ কি!
তোতা বা টিয়া পাখির মতো শিখানো বুলি বলা নিয়ে টিপ্পনি কাটা আমাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিষয়টি বেগম রোকেয়ার শ্রুতিতেও ছিল বলেই “অর্ধাঙ্গী” নিবন্ধে শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন — “প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মত আবৃত্তি কর”। বাঙালী সমাজের আচার-আচরণকে প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষণের ফলই এ টিয়া পাখির উদাহরণ।
‘সুগৃহিণী’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া নিজেই বলেছেন — “একটা মেয়েলী প্রবাদ আছে, ‘সেই ধান সেই চাউল, গিন্নি গুণে আউল ঝাউল’ (এলো মেলো)।” যার তাৎপর্য হচ্ছে সুগৃহিণীর গুণে গৃহ সজ্জিত থাকে। অর্থাৎ বাংলার লোক জীবনের ‘মেয়েলী’ প্রবাদের সাথে বেগম রোকেয়ার ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের আভাস পাওয়া যায়। এ প্রবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন
— “অন্যত্র প্রবাদ আছে, ‘মূর্খের উপাসনা ও বিদ্ধানের শয়নাবস্থা সমান’।” এই যে বেগম রোকেয়া উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেই প্রবাদ বলে উল্লেখ করেছেন এর উৎস কোথায়? লোকজ ঐতিহ্যের কোন ভাণ্ডার থেকে এ সব সংগ্রহ করেছেন?
‘চোরা না শুনে ধরম কাহিণী ’গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বহুল প্রচলিত প্রবাদ যা বেগম রোকেয়া ‘বোরকা’ প্রবন্ধে ব্যবহার করেছেন। মজ্জাগতভাবে খারাপ লোক কখনো ধর্মের তথা ভাল কথা মানে না। অন্যদিক, রোকেয়ার লেখায় যে লোকজ উপাদানের গড়াগড়ি ও ছড়াছড়ি তা শহরের নাগরিক পাঠকদের বোঝার কথা নয়।
শুধু বাংলার নয় — পৃথিবীর সকল নারীরই নিজের অবস্থানের কথা বলতে গেলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমালোচনা করতে হয় যা বাংলাদেশের প্রবাদে চমৎকারভাবে বিধৃত। রোকেয়া তা চয়ন করেছেন তার ‘গৃহ’ প্রবন্ধে — “ঐ যে কথায় বলে, ‘বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”, এ ক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে — ভগ্নীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।” সামাজিক বলয়ে কথায় কী বলে তা জানা রোকেয়ার গভীরভাবে লোক সমাজ নিরীক্ষণেরই ফলাফল।
মতিচুর ২য় খণ্ড
মতিচুর ১ম খন্ণ্ডে বেগম রোকেয়া যতটা প্রবাদ বা লোকোক্তি ব্যবহার করেছেন, মতিচুর ২য় খন্ণ্ডে ততটা করেননি। তবে যেটুকুই করেছেন তাতেই তার সমৃদ্ধ লোকাভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়।
শুধুমাত্র দু’একটি উদাহরণ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, যেমন, ধরাকে সরা জ্ঞান করার প্রবাদটি ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন। সাধারণত এটি উন্নাসিক কোনো চরিত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এখানে একটি স্থান থেকে (প্রথম বেঞ্চ) পুরো কারসিয়ঙ্গ শহরটা এক নজরে দেখা যাওয়া বোঝাতে এ প্রবাদের ব্যবহার করেছেন ‘সৌর জগৎ’ নামক গল্পে।
পরবর্তীতে, ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ নামক লেখায় উড়োজাহাজে তিন হাজার মাইল উপরে ওঠার অভিজ্ঞতায় ‘ধরাখানা সত্যই সরা তুল্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রূপক নয়, আক্ষরিক অর্থেও দেখেছেন এ প্রবাদটিকে।
এক স্ত্রী তার স্বামীর womanishness (স্ত্রী ভাব) শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় স্ত্রীর এক প্রতিক্রিয়াশীল ভাই বোনকে উদ্দেশ্যে বলে ‘পিপীলিকার পক্ষ হইলে শূন্যে উড়ে’। স্ত্রীলোক শিক্ষা পাইলে পুরুষদের কথার প্রতিবাদ করে, — সমালোচনা করে। ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে’ — এরই পূর্বতন সংস্করণই বোধ হয় উপরোক্ত সংলাপটি।
“মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত” — বহুল ব্যবহৃত প্রবাদটিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, — মোল্লাদের যতই ধর্মীয় পরিচয় থাকুক না কেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতার পরিমাপ করেই রেখেছে — যা বড়জোর মসজিদ পর্যন্ত। আর বেগম রোকেয়া তা অবলীলায় ‘সৌর জগৎ’ নামক গল্পে জাফর মামার গতিপথের সীমাবদ্ধতা বোঝাতে এ প্রবাদটির ব্যবহার করেছেন।
“যেহেতু তিনি আপন ধর্মের কোন তত্ত্বই অবগত নহেন। কেবল টিয়া পাখীর মত নমাজ পড়েন, কোন শব্দের অর্থ বুঝেন না।” বেগম রোকেয়া টিয়া পাখির রূপকে সমাজের ধর্মের নামে কিছু অন্ধ লোকের চরিত্র রূপায়ণ করেছেন। টিয়া পাখি শিখানো বুলি বলে বা বলতে পারে — লৌকিক এ ধারণাটি তিনি “অর্ধাঙ্গী” নামক প্রবন্ধেও ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া, পরবর্তীতেও টিয়া পাখির মতো মুখস্ত করার বৈশিষ্ট্যটি বার বার ব্যবহার করেছেন।
“সুলতানার স্বপ্ন” ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ও বাঙালী সমাজ ব্যবস্থা তো বটেই ভারত বর্ষের বাইরের কাল্পনিক কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে লিখিত। সেজন্যেই হয়তো বা একটি মাত্র প্রবাদ “জোর যার মুলুক তার” ব্যবহার করেছেন যা আবার ইংরেজিতেও অধিক পরিচিত Might is Right বাক্যে। এ ছাড়া লৌকিক জীবনের আর কোনো স্বাদ দেননি। সারা ও তার মহারানী আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতির বাইরের চরিত্র। কাজেই কী সচেতনভাবেই না লোক সংস্কৃতির কোনোরূপ ছোঁয়া তিনি এ রচনায় দেননি! সযত্নে লোকায়ত জীবনকে এড়িয়ে গেছেন। “সুলতানার স্বপ্ন” লেখাটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও তা নারীকে সার্বভৌম সত্ত্বা হিসেবে বিকশিত করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এতে বাংলার লোকায়ত জীবনের প্রতিফলনের সুযোগ ছিল না এবং রোকেয়া সে সুযোগ সৃষ্টি করারও চেষ্টা করেননি। এখানেই তাঁর সচেতন লেখক সত্তার প্রমাণ মেলে।
ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে রচিত “ডেলিশিয়া হত্যা” নামক গল্পটিতে বেগম রোকেয়ার লোক প্রবাদের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য নয়। একটি মাত্র প্রবাদ “যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা” যেন আরোপিত উচ্চারণ। স্যুটের সাথে যেন শান্তিপুরি চপ্পল।
শুধুমাত্র ডেলিশিয়ার সাথে মজলুমা চরিত্রের তুলনায় বাংলার লোকজ জীবনে নারীর অবস্থানকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ইউরোপীয় আবহে লিখিত বলেই হয়তো বা বেগম রোকেয়া সচেতনভাবে “ডেলিশিয়া হত্যা” নামক গল্পে ‘বঙ্গদেশের’ চেয়ে বিহার অঞ্চলে ব্যবহৃত অলংকারের উদাহরণ দিয়েছেন। সেজন্যেই হয়তো বাংলাদেশের লোকজীবনের প্রবাদ প্রবচন বেশি ব্যবহার করেননি। তিনি নিজেই ‘যুগনু’ নামক অলংকার শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে পাদটীকায় বলেছেন —
“আমাদের দেশে পাচনরি বা সাতনরি মুক্তামালার মধ্যস্থলে যে জড়াও “ধুকধুকি” থাকে, তাহাকে pedant বলা যাইতে পারে, কিন্তু pedant বলিতে যাহা বুঝায় তাহাকে বেহার অঞ্চলে “যুগনু” বলে। বঙ্গদেশে কেবল “ধুকধুকি” নিজে কোন অলঙ্কার নয়; বেহারে কিন্তু “যুগনু” নিজেই একটি অলঙ্কার। এইজ্যা আমরা “যুগনু” শন্দ ব্যবহার করিলাম।” এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে তিনি লোক জীবনের অভিজ্ঞতার প্রায়োগিক দিক নিয়ে সচেতন ছিলেন।
লোকসাহিত্য মানেই লোকের মুখে মুখে জনসমাজে যা বিস্তৃত হয়ে থাকে। যে সব রচনার রচয়িতার নামসহ লিখিত রূপ পাওয়া যায় না। লোকজ স্মৃতি এবং শ্রুতিকে নির্ভর করে এ সব রচিত। লৌকিক কাহিনীতে বর্ণিত চরিত্রকে ব্যবহার করে লোকায়ত সমাজে প্রচলিত উপমা বা উদাহরণের যে ব্যবহার তা বেগম রোকেয়ার রচনায়ও পাওয়া যায়।
যেমন, সাহিত্যিক ডেলিশিয়ার সাথে সৈনিক বিভাগের উইলফ্রেড কারলীয়ন-এর বিয়েকে তুলনা করেছেন — “এ বিবাহকে কার্তিক এবং সরস্বতীর মিলন বলা যাইতে পারে।” রূপবান এবং রণাঙ্গনে চৌকষ কোনো পুরুষকে আর বিদ্যা-বুদ্ধিতে গুণান্বিতা কোনো নারীকে আজও আমাদের সমাজে যথাক্রমে কার্তিক এবং সরস্বতীর সাথে তুলনা করা হয়। রোকেয়াও এর ব্যতিক্রম নন। এ সব উপমা তিনি লোক জীবনের ভাণ্ডার থেকে দিয়েছেন যা লোকসংস্কৃতি নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মানের, মনের, মনোবলের ও মননের কথাই লোক কথায় গাথায় ও গানে। আর এ সবের ঝালমলে টুকরো রোকেয়া তাঁর লেখায় সুচারুরূপে গেঁথে দিয়েছেন। (ক্রমশ)