বেগম রোকেয়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয় প্রাইমারীতে পড়ার সময়। তাঁর জীবনী পাঠ্য ছিল। রাতের অন্ধকারে বড় ভাইয়ের কাছে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ার কাহিনী আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল, নিজের পাঠের প্রতিও আগ্রহী করেছিল নিশ্চয়ই এবং ‘স্ত্রী-শিক্ষার’ উন্নতির বিষয়টিই গুরুত্ব দিয়েছিলেন আমার শিক্ষকেরা — নারীর অধিকার নয়।
মাধ্যমিক অথবা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়েছি সুলতানার স্বপ্ন কাহিনীর অংশ বিশেষ ‘নারীস্থান’। এটি পড়ানোর সময়ও শিক্ষকরা নারীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কল্পকাহিনীকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন — নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণকে নয়।
বাংলা সম্মান শ্রেণীতে পাঠ্য ছিল বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিণী। পর্দা প্রথার খণ্ড খণ্ড ঘটনা। শিক্ষকরা অবরোধবাসিনী পড়াতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই এর সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা বলেছেন; কিন্তু নারীবাদ পড়াননি। রোকেয়া ও তার সৃষ্টি বুঝতে ও বোঝাতে যা পড়ানো ছিল অবধারিত ও অপরিহার্য।
বড়বেলায় রোকেয়া সম্পর্কিত অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পড়েছি, তবে নারীপক্ষের রোকেয়া বিষয়ক একটি পোস্টার ও হুমায়ূন আজাদের রোকেয়া বিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা আমাকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রোকেয়া পাঠে উদ্ধুদ্ধ করে। হুমায়ূন আজাদের রোকেয়া বিষয়ক প্রবন্ধ তাঁর নারী গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত।
এখন রোকেয়া পড়তে গিয়ে এখন আমার আশ মিটছে না। নারীবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, লোক অভিজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরূদ্ধে দ্রোহ — এ সবের সমাহার তার রচনায়।
বেগম রোকেয়া রংপুরের অন্তঃপুরে বড় হয়েছেন আনুমানিক ১৬ বৎসর বয়স অর্থাৎ বিয়ের আগ পর্যন্ত। পরে স্বামীর সাথে বাংলাদেশের বাইরে। আরও পরে কলকাতায় উর্দু ভাষায় স্কুল চালিয়েছেন। কাজেই বাংলার লোকজীবনের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা খোঁজার চেষ্টাকে অনেকের কাছে হয়তো মনে হতে পারে অপ্রাসঙ্গিক, অপরিপক্কতার পরিচায়ক এবং অরণ্যরোদন তো বটেই।
কিন্তু আপাতঃদৃষ্টিতে তাঁর বসবাস বাংলার লোক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে মনে হলেও তাঁর রচনাসমূহ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির ভেতরের ধ্যান ধারণা সম্বন্ধে সম্যক অভিজ্ঞতা ছিল রোকেয়ার। বেগম রোকেয়া প্রবাদ প্রবচন ব্যবহারে ফুটিয়ে তুলেছেন নারীর যাপিত জীবনকে। লোকজ জীবনাভিজ্ঞতা প্রতিবিম্বিত ও বিচ্ছুরিত তাঁর রচনায়। প্রাকৃত জীবনের রীতি-নীতি,জীবনধারণ কৌশল তাঁর অবিদিত ছিল না।
বেগম রোকেয়া অন্তঃদৃষ্টি দিয়ে আতস্থ করেছিলেন পরিপার্শ্বকে। আরবী, ফারসী আর উর্দু ছিল তাঁর বাবার পরিবারের লালিত ভাষা এবং ইংরেজি ছিল পালিত ভাষা। আর বাংলাদেশের গ্রামে বাস করলেও বাংলা ভাষাই ছিল তাঁর পরিবারে অবহেলিত। যে বাবার কাছে বাংলা ভাষার লালন-পালন ছিল না, মর্যাদা ছিল না সে পরিবারের মেয়ে রকু বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন নারী অধিকার বিষয়ক শ্রেষ্ঠতম কিছু প্রবন্ধ। বাংলার লোক সংস্কৃতিকে প্রতিফলন করেছেন তাঁর রচনায়।
স্বল্প পরিচিত মহিলা পর্যন্ত পায়রাবন্দের বাড়িতে আসলে পাঁচ বছরের রোকেয়াকে পর্দা করতে হতো; সেখানে কোন উৎস থেকে পেয়েছেন লোকজ জীবনের প্রবাদ, প্রবচন ও লোকোক্তি। জন-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রোকেয়ার চেতনায় লোকসংস্কৃতি কোত্থেকে অংকুরোদ্গম হয়ে চারায় পরিণত হয়েছিল তা গবেষকদের আগ্রহী করে তুলবে বলেই আশা করি। একজন অনুসন্ধিৎসু রোকেয়া পাঠক হিসেবে সেই গবেষকদের জন্যে অপেক্ষায় রইলাম।
ডঃ গোলাম মুরশিদ ‘প্রথম বাঙালি নারীবাদী বেগম রোকেয়া” প্রবন্ধে বলেছেন —
‘অবরোধের দারুণ যন্ত্রণা ব্যক্তিগত জীবনেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সে তো করিমুন্নেসা এবং সেকালের লক্ষ লক্ষ মহিলারাও করেছিলেন। কিন্তু অবরোধ মোচন করতে হবে, তার চেয়েও বড়ো কথা নারী সমাজকে মুক্ত করতে হবে বহু শতাব্দীর দৃঢ়মূল বন্ধন থেকে — এ চেতনা তিনি কোথায় পান, তা বলা শক্ত। যে অকিঞ্চিৎকর তথ্য আমার হাতে আছে, তা থেকে নিশ্চিত হদিস দেওয়া অসম্ভব। অনুমান হয়তো সম্ভব। রোকেয়া সম্পর্কে কয়েকখানা বই এবং তার কিছু চিঠিপত্র প্রকাশিত হলেও, তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রধান অংশই এখনো অজ্ঞাত। বর্তমান রচনা মূলত রোকেয়ার রচনাবলীর উপর নির্ভরশীল।’
আমিও সর্বতোভাবে ডঃ গোলাম মুরশিদ এর সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে এক কণ্ঠ। রোকেয়ার ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে তার মা সম্পর্কেই তো আমাদের পর্যাপ্ত জানা নেই। শুধু পদ্মরাগ উপন্যাসের উৎসর্গ-পত্রে তাঁর দাদা আবোল আসাদ ইব্রাহিম সাবেরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন — ‘জননী সময়ে সময়ে শাসন করিয়াছেন, — তুমি কখনও শাসন কর নাই।’ ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ নামক লেখায় বলেছেন — ‘ছেলে-বেলায় আমি মা’র মুখে শুনতুম। — “কোরআন শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে।”
রোকেয়া রচনা সমগ্র ঘেঁটে এ দুইবার তাঁর মায়ের কথা পাই। তাই নারী সমাজকে মুক্ত করার চেতনা তিনি কোথায় পেয়েছিলান এর যেমন খোঁজ পাওয়া কষ্টকর তেমনি লোকায়ত জীবনের বনালী ফুল কীভাবে চয়ন করলেন তাও আমাদের ধাঁধায় ফেলে বৈকি।
রোকেয়ার লেখা পর্যালোচনা করলে লোকজ জীবনের জলচিত্র ও চালচিত্র পাওয়া যায়। তাঁর প্রবাদ, প্রবচন, জনরব ও রূপকথা ব্যবহারের উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তিনি ছিলেন মাটির কাছাকাছি, লোকজ জীবনের পাশাপাশি, অর্থাৎ তাঁর ছিল বাঙালী জীবনবোধের সাথে ঘেষাঘেষি।
মতিচুর ১ম খণ্ড
বেগম রোকেয়ার লেখায় তিনি সচেতনভাবে উর্দু কাগজে পড়া অভিজ্ঞতাকে অনেক বার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন, বিহারের (তাঁর ভাষায় “বেহারের”) ধনী মুসলমানের ঘরের বউ-ঝি নামধেয় জড়পদার্থ দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। (স্ত্রীজাতির অবনতি)। কিন্তু তাঁর চেতনার গহীনে বাংলার সংস্কৃতি এমনই শেকড় গেড়েছিল যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বার বার তাঁর রচনায় প্রকাশ ঘটেছে বাংলার লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের।
‘জামাতা আর দেবতা’ বলে প্রবাদ আছে এবং তা বেগম রোকেয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল বলে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘এদেশে জামাতা খুব আদরণীয় — এমনকি ডাইনীও জামাই ভালবাসে। ‘অন্যদিকে ঘর জামাই থাকা সামাজিকভাবে অসম্মানের এবং এতে জামাই এর চেয়ে মেয়েটিকে তার বাবার বাড়ির সুদৃঢ় অবস্থানকে ঠুনকো করার জন্যেই এ সামাজিকীকরণ। তাও রোকেয়ার রচনায় রয়েছে। যেমন, “তবু ‘ঘরজামাইয়ের’ সেরূপ আদর হয় না।“ কাজেই বাংলার সামাজিক মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস সম্বন্ধে বেগম রোকেয়ার গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল।
যেমন ইংরেজি প্রবাদ Might is Right না শুনেই গ্রামীণ জনপদের জনমানুষ ‘জোর যার মুলুক তার’ প্রবাদটি সৃষ্টি করেছিলেন এবং তা ব্যবহার করে আসছেন। প্রতাপ-প্রতিপত্তির কাছে হেরে যাওয়া অভিজ্ঞতাই এ প্রবাদটির জননী। নারী জীবনের দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেগম রোকেয়া ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামক নিবন্ধে জনমানুষের কাছ থেকে পাওয়া ‘জোর যার মুলুক তার’ প্রবাদটি ব্যবহার করেছেন। যদিও জন মানুষের সাথে সম্পৃক্তির বিষয়টি তাঁর জীবনীতে স্পষ্ট নয় বলে আগেই উল্লেখ করেছি।
আমাদের বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষদের পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলন, ভাব প্রকাশ সবই পুরুষতান্ত্রিক দম্ভে পুরুষালী। এর ব্যত্যয় ঘটলেই অপবাদ — মাইগ্যা বা মেয়েলি বলে। যে চুড়ি পরা মেয়েদের জন্য অলংকার সে চুড়ি পরা পুরুষের জন্য অপমান। পুরুষের কণ্ঠে অহরহ “আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুরি পরিব।” ( স্ত্রীজাতির অবনতি) এ ধারণা বেগম রোকেয়ার অভিজ্ঞতা এড়ায়নি।
সচরাচর ব্যবহৃত লোকোক্তি অবলীলায় প্রাসঙ্গিকভাবে চয়িত হয়েছে তাঁর লেখায়। যেমন, ‘উল্টা বুঝলি রাম’। (স্ত্রীজাতির অবনতি)। কম কথায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে।
পৌরাণিক কাহিনী হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে লালন করলেও ঐতিহাসিক কারণে তা গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। পৌরাণিক চরিত্রের প্রভাবেও প্রভাবিত তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, চাল-চলন, রীতি-নীতি। জন জীবনের আশা-হতাশার সাথেও ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনীর পরিণতি। বেগম রোকেয়াও “অর্ধাঙ্গী” নামক প্রবন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন পৌরানিক কাহিনীর প্রসঙ্গ টেনে। যেমন, দুইবার রামায়ণের রাম ও সীতার উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। (ক্রমশ)