যে কজন বাঙালি অভিনেতার অভিনয়ের জীবন নিয়ে গর্ব অনুভব করা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বসন্ত চৌধুরী। বাংলা চলচ্চিত্রের ম্যাটিনি আইডল তিনি। ১৯২৮ সালের ৫ই মে হাওড়ার আন্দুলে দত্ত চৌধুরী জমিদার বংশে জন্ম। ভরা গ্রীষ্মে জন্ম হলেও নাম রাখা হলো বসন্ত। পাঁচের দশকের অভিনয় জীবনে সিনেমা মঞ্চ যাত্রা বেতার এমনকি টিভি ধারাবাহিকেও দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। আভিজাত্য আর ঐতিহ্য সচেতন বাঙালি ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার এক আশ্চর্য মিলনস্থল ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে। ভগবানদত্ত ব্যারিটোন ভয়েজে বাংলা ইংরেজি হিন্দিতে অনায়াসে ডায়লগ বলতেন। ব্রায়ার পাইপ, জামদানি শাল, চুনোট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবিতে এক অসাধারণ আভিজাত্য ইন্টেলেক রসবোধের কম্বিনেশন ছিল বসন্ত চৌধুরীর মধ্যে। আজকের লেখায় বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের এক অন্যতম কারিগরের প্রতি রইলো জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
২২ বছর বয়সে কলেজ পাস করার পর অভিনয় করার ইচ্ছাটা প্রবল বেড়ে যায়। সেই ইচ্ছার ডানায় ভর করে নাগপুর থেকে বোম্বে মেলে থার্ড ক্লাসের একটি কামড়ায় উঠে পরলেন। গন্তব্য কলকাতা। খুব সহজ ছিল না সেই পথ।
এলেন বন্ধুর রবি দের কাছে। কলকাতার বউবাজারে একটি ল্যাবরেটরীতে চাকরি করতেন বন্ধু রবি দে। সেই ল্যাবটারিরই একটি টেবিলে রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেন বসন্তের। গোটা দিনটা এ স্টুডিও ও স্টুডিও, পরিচালক প্রযোজকদের দরজায় ঘুরে ও রাস্তার কোন পাইস হোটেলে খাওয়ার শেষে রাতে ফিরে সেই টেবিলে শুয়ে পড়তেন। মনে অদম্য ইচ্ছা অভিনেতা হওয়ার।
তবে সিনেমার নায়ক হওয়ার মত চেহারা ছিল বলে, কয়েক মাস ঘোরাঘুরির পর প্রযোজক পরিচালকদের চোখে পড়লেন বসন্ত।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাধা ফিল্মসের মাধব ঘোষাল তার নতুন ছবি ‘মন্দির’-এর নায়কের চরিত্রে মনোনীত করলেন। তিন হাজার টাকায় কন্টাক্ট সাইন হল। অগ্রিম হিসেবে পেলেন ৩০০টাকা। কলকাতায় ছিল তার এই প্রথম রোজগার। শুরু হলো শুটিংয়ের পর্ব।
ঠিক সেই সময়, শিল্পনির্দেশক সৌরেন সেনের সুপারিশে নিউ থিয়েটারস থেকে ডাক এল বসন্তের। শুনলেন নিউ থিয়েটার্স এর নতুন ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ নায়কের ভূমিকায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নায়িকা নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। দুই ছবিতেই একসঙ্গে শুটিং করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বসন্ত চৌধুরী। কিন্তু বাধ সাধলো যখন সৌরেন বাবু জানালেন নিউ থিয়েটার্স এ কাজ করলে অন্য কোন ছবিতে আর কাজ করা যাবে না।
বসন্তবাবু ছুটলেন মাধববাবুর কাছে ‘মন্দির’ ছবিতে তিনি যে আর কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু মাধববাবুর দাদা কেশববাবু তিন দিনের শুটিংয়ের যাবতীয় খরচ বসন্ত চৌধুরীর কাছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করলেন।
আকাশ মাথায় ভেঙে পড়ল বসন্তর। অবশেষে দেবকি বসুর মধ্যস্থতায় ছাড় পেলেন বসন্ত। শুটিংয়ের খরচ দিতে হয়নি বটে কিন্তু অগ্রিম বাবদ যে ৩০০ টাকা পেয়েছিলেন সেটি তাকে ফেরত দিতে হয়। যাইহোক, ১৯৫২ সালে মুক্তি পেল দ্বিভাষিক ছবিটি (হিন্দি নাম ‘যাত্রিক’)। সুপারহিট ছবি। এই ছবিটিকে বাংলা সিনেমার প্রথম ট্রাভেল ফিল্ম হিসেবে দেখা যেতে পারে।
‘মহাপ্রস্থান’-এর বিপুল সাফল্যের পর দেবকি বসু বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে সুচিত্রা সেন ও চৈতন্যদেবের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরীকে মনোনয়ন করলেন। দেবকি বসু প্রথমে এই চরিত্রের জন্য সিলেক্ট করেছিলেন উত্তম কুমারকে। সম্ভবত সেই সময় উত্তমকুমার চৈতন্যদেবের ভূমিকায় অভিনয় করতে ন্যাড়া হতে চাননি কারণ তখন তার অন্য একটি ছবির শুটিং চলছিল। তখনই নজর পড়লো সৌমকেন্তি চেহারার বসন্ত চৌধুরীর দিকে। বসন্তবাবু ন্যাড়াও হলেন কিন্তু সমস্যা হল তিনি অভিনয় করবার সময় একটু বেশি দুলতেন। ক্যামেরার পজিশন থেকে প্রায় সময় বেরিয়ে যেতেন। দেবকি বসু সেই ব্যাপারে তাকে সতর্ক করলেন। ফ্লোরে একটি গণ্ডি কেটে বলেছিলেন, এর বাইরে তুমি যেও না। খুব পরিশ্রম করতেন সেই সময় বসন্ত। চরিত্রে অভিনয় করবার সময় তিনি নিরামিষ আহার ও আধ্যাত্মিক বই পড়তেন। কি অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। চৈতন্যদেব গয়ায় পিণ্ডদানের সময় শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের উপর ‘নিমাই’ বসন্তের চোখের জল ফেলে আকুল আকুতি দেখলে সারা গা কাঁটিয়ে ওঠে।
তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! সেই সময় অগ্নিপরীক্ষা সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা বাণিজ্য সফল জুটির কারণে বসন্ত চৌধুরী ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়েন। প্রযোজক পরিচালকরা তাকে আর সফল নায়ক হিসেবে ভাবতেই পারলেন না। যদিও এত গন্ডগোলের মাঝেও উত্তম-বসন্তের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর কোন ছাপ পড়েনি, দুজনে বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থেকেছে। পরে বকুল (হিন্দি), হারজিত, শংকরনারায়ন ব্যাংক, শঙ্খবেলা এবং যদি জানতেম এই পাঁচটি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেন।
তবে দেবকি বসু সুচিত্রা-বসন্ত এই জুটিকে দিয়ে ভালোবাসা ছবিতে অভিনয় করান। যদিও ছবিটি ফ্লপ হয়। ১৯৫৪ তে নীরেন লাহিড়ীর যদুভট্টতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন বসন্ত। ছবিটি বসন্ত চৌধুরীর জীবনের মাইলফলক।
সারা জীবন প্রায় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তথ্যভান্ডার মাত্র ৭৪টি ছবির সন্ধান দিতে পেরেছে, যার মধ্যে সাতটি হিন্দি ছবি। বসন্ত চৌধুরীর বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে রাজা রামমোহন, দ্বীপ জ্বেলে যাই, অভয়া ও শ্রীকান্ত, বৈদুর্য রহস্য, দেবী চৌধুরানী… ইত্যাদি বিখ্যাত। হিন্দি ছবিগুলির মধ্যে ময়ূরী, নয়া সফর, এক ডক্টর কি মত… মনে রাখার মত।
উত্তমকুমার স্টার হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা সরে আসতে হয়েছিল বসন্ত চৌধুরীকে। সেই সময় তিনি যাত্রা করতেন। বছর দুয়েক টানা যাত্রা করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে কলকাতার পাবলিক থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ চিকিৎসকের ভূমিকায় তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেন। এরপর দেনা পাওনা, বিপ্রদাস, অগ্নিকন্যা-সহ বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। স্টাডি কালবৈশাখী ও ক্ষুদা ৫০০ রজনী চলেছিল। নিয়মিত নট্ট কোম্পানির হয়ে যাত্রা করতেন। আকাশবাণীতে তার কন্ঠে বেতার নাটক শুনবার জন্য শুক্রবার রাত পৌনে আটটায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
আভিজাত্যপূর্ণ বাঙালিয়ানার মধ্যে কোথাও যেন একটা অভিমান সবসময় লুকিয়ে থাকতো তার মধ্যে। তারমধ্যে হয়তো তার বড় কারণ ছিল বিবাহিত জীবনে ব্যর্থতা। ১৯৫৭ সালে কবি অজিত চক্রবর্তীর ছোট ছেলে যুধাজিৎ চক্রবর্তীর কন্যা অলকা চক্রবর্তীকে ভালবেসে লুকিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেন বসন্ত চৌধুরী। যদিও পরে সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। অসামান্য সুন্দরী, নানা গুণের অধিকারী বসন্ত চৌধুরীর চেয়ে প্রায় ১৪ বছরের ছোট ছিলেন অলকা চক্রবর্তী।
তাকে সত্যজিৎ রায় ‘অপরাজিত’ ছবিতে অপুর বান্ধবী লীলার চরিত্রে অভিনয় করাতে চেয়েছিলেন। শুটিংও শুরু হয়। যদিও রক্ষণশীল বসন্ত চৌধুরী চাননি তার ভাবী স্ত্রী সিনেমা জগতে আসুক। সত্যজিতের ফিল্মের শুটিং চলাকালীন বাগদত্তা অলকাকে শুটিং ফ্লোর থেকে নিয়ে আসেন বসন্ত চৌধুরী। প্রচন্ড অপমানিত হন সত্যজিৎ। আর সেই কারণেই হয়তো কোনদিনই বসন্ত চৌধুরীকে কাস্ট করতে চাননি সত্যজিৎ।
জানা যায় বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি কারণ এই পথে ছিল প্রচন্ড সন্দেহ। আর এই সন্দেহের বিষ একদিন ভেঙে দিল সম্পর্ক। পরে আর্মি অফিসারকে বিয়ে করেছিলেন অলকা চক্রবর্তী। তাদের দুই কৃতি সন্তান সৃঞ্জয় ও সঞ্জিতকে বসন্ত চৌধুরীই মানুষ করেছেন। তাঁর সংসার জীবন ও অভিনয় জগৎ যেন ‘দুটি পথ… দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। ভরদ্বাজ গোত্রের কনৌজিয়া কায়স্থ দত্ত চৌধুরী বংশের সন্তানটি ছিলেন পঞ্চব্যঞ্জন বিলাসী। অসমবয়সী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্পে জমিয়ে রাখতে পারতেন। পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, হেরিটেজ নিয়ে তার আগ্রহ ছিল প্রবল। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন চর্চাকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার প্রয়াস ছিল অদম্য।
বাঁদিক থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, কে এল ভগত, শোভা সেন।
দুর্লভ ও প্রাচীন গণেশ মূর্তি সংগ্রাহক, শাল সংগ্রাহক, বাংলা লিপি উৎকীর্ণ আছে এমন মুদ্রা সংগ্রাহক হিসাবে তার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। তার মৃত্যুর আগে বহু মূল্যের শখানেক গণেশ মূর্তি, দুর্লভ সব প্রত্নসামগ্রী ভারতীয় জাদুঘরে দান করে যান বসন্ত চৌধুরী। যেগুলি বিক্রি করলে তা থেকে তিনি হয়তো কোটি কোটি টাকা পেতেন। এমনই দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। প্রাচীন ইতিহাসে বিশেষ করে ত্রিপুরা কোচবিহার আরাকান-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের পুরনো রাজতন্ত্র ও প্রত্নতত্ত্বের উপর তার জ্ঞান, তাকে কলকাতার এক কিংবদন্তি চরিত্রে উন্নীত করেছিলো।
বিএফজেএ কর্তৃক “রাজা রামমোহন” চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা স্টেজ শতবর্ষী স্টার থিয়েটারের পুরস্কারও পেয়েছিলেন। অভিনেতা কলকাতার শেরিফ ছিলেন। কলকাতায় নন্দন-পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম সেন্টারের চেয়ারম্যান পদেও তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল।
২০০০ সালে ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এক বৃষ্টি ভেজা ভোরে রানী কুঠির বাড়িতে মারা যান। মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা সকলের অজ্ঞাতসারে তারই নির্দেশ অনুযায়ী সৎকার করেন। আভিজাত্যপূর্ণ মানুষটি নিজের অহমিকাকে সযত্নে লালন করে চলে গেলেন।
তথ্যঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্যা ওয়াল, উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য।
Beautiful