পুজো আসছে সবাই জানি। পুজোর সঙ্গে আসে প্রত্যাশা। বছরের এই সময়টাতেই আমাদের এখানে গ্রামীণ শিল্পীরা কিছু রোজগারের আশায় নিজের মতো করে প্রস্তুত হতে থাকেন। সবাই দেবীর কাছে নিজেরা যে জিনিসটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন তা নিয়েই বেঁচে থাকার প্রার্থনা করেন। কারণ বাংলার পুজোর বাজার বিশাল। এখানে মণ্ডপসজ্জা থেকে দেবীর অসুরবধের অস্ত্র যারা তৈরি করেন, যারা বানান শোলার চাঁদমালা, আর যারা করেন আলোর কাজ সবারই আয় করার সুযোগ আছে।
কাজের মধ্যে দিয়েই পুজো বাংলার সব সম্প্রদায়ের মানুষকে মিলিয়ে দেয়। তবে গত বছর থেকে এই মিলমিশের সুরটা বেশ কেটে গেছে। কারণ তো সবাই জানেন— কোভিড নামের অতিমারি। ছোটদের আনন্দ থেকে বড়দের জীবিকা সবকিছুতেই যেন আঙুল তুলে শাসাচ্ছে সে। সংক্রমণের ভয় এবং তা আটকাতে প্রশাসনের অনুশাসন উৎসব ও ব্যাবসায় বাধা সৃষ্টি করেছে। এটা না করলে অতিমারি আরো বাড়তো। কিন্তু জীবিকাও একটা বড় ব্যাপার। তাই এই অবস্থাকে মেনে নিয়ে জীবন আবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইছে।
গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পুজোকে কেন্দ্র করে পণ্যের পসরা সাজাচ্ছে পটুয়া, মালাকার, তন্তুবায়, মাদুরশিল্পী, ছৌ ও কাঠের মুখোশশিল্পী আর সাবাইশিল্পীরা। কাঠের পেঁচা আর পোড়ামাটির ঘোড়া-হাতি চেপে বাংলার লোকশিল্প সারা পৃথিবীর মানুষের ড্রইংরুমে পৌঁছেছে। সেই শিল্পীরাও তাদের পসরা নিয়ে প্রস্তুত। তৈরি হচ্ছেন বাংলার ডোকরা আর কাঁথাশিল্পীরাও। অতিমারির কারণে এদের সবারই আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কোনও উৎসব নেই, মেলা নেই, প্রদর্শনী নেই , কোনও বড় জমায়েত নেই— কোথায় বিক্রি হবে এসব জিনিস! শুধু অর্থনীতি নয় মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছেন তারা। কারণ শিল্পী শুধু টাকায় বাঁচেননা, তারা বাঁচেন নিজেদের কাজে। মানুষ ও পরিবেশ কারো ক্ষতি না করে নিজেদের পরম্পরাগত শিল্প দিয়ে জীবিকানির্বাহ করেন তারা। উৎসব সেকাজে একটা বড় অবলম্বন।
এদের কাজ ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। নিজেদের গুণে এই শিল্পীরা সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছেন। এদের তৈরি মাদুর, পট, ছৌ মুখোশ, কাঠের মুখোশ, ডোকরা জি.আই. (জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন) পেয়েছে। এরাই বঙ্গসংস্কৃতির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার। দুর্গাপুজো বাদ দিয়ে বাংলা বাঁচেনা। শুধু উৎসব নয়, দেবীর আবাহন মানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান। এবার পুজোতে সেই আশায় বুক বেঁধেছেন লোকশিল্পীরা। এদের তৈরি জিনিস কিনুন। এতে শুধু শিল্পীরা বাঁচবেন তা নয়, আপনার রুচি ও পছন্দের প্রতিও সুবিচার করা হবে। উৎসবে যেমন মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হয় ঠিক তেমনি ফুটিয়ে তুলতে হয় নিজস্বতাটুকুও। একটা ভূখণ্ডের লোকশিল্প সেখানকার মানুষের নিজস্বতা ও রুচিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এবার আপনার আমার সবার প্রমান করার পালা কোভিড অনেক কিছু কেড়েছে কিন্তু ধ্বংস করতে পারেনি বাংলার লোকশিল্প ও রুচিবোধ।