বৈজনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির বা বৈদ্যনাথ ধাম হলো শিবের বারোটি পবিত্রতম জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে পঞ্চম জ্যোতির্লিঙ্গ। বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান নিয়ে অনেক মতান্তর আছে।
শিবপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতার শ্লোক অনুযায়ী (অধ্যায় ১। ২১-২৪।) বৈদ্যনাথং চিতাভূমৌ অর্থ্যৎ বৈদ্যনাথ মন্দির ‘চিদভূমি’ (বৈদ্যনাথের প্রাচীন নাম) তে অবস্থিত। আবার আরেকটি স্থানে উল্লেখ আছে “পারল্যং বৈদ্যনাথম্” অর্থাৎ বৈদ্যনাথ পারলিতে অবস্থিত। মূলত বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ-এর প্রকৃত অবস্থানের দাবীদার তিনটি স্থান —
১) ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির
২) মহারাষ্ট্রের বিড জেলার পারলি বৈজনাথ
৩) বৈজনাথ মন্দির হিমাচল প্রদেশ
দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দির—
শিবপুরাণের কাহিনী অনুযায়ী ত্রেতাযুগের লঙ্কেশ্বর রাবণ ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। তাঁর রাজ্য লঙ্কাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকল শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের সামনে ঊর্ধ্বপদ হেঁটমুন্ড হয়ে এক পক্ষকাল আরাধনা করে নয়টি মাথা অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করেন শঙ্করের শ্রীচরণপদ্মে। রাবণের তপস্যায় তৃপ্ত দেবাদিদেব নয়টি মাথা আবার তিনি নিজে হাতে জুড়ে দিলেন ভক্তের দেহে। এবং আশীর্বাদ স্বরূপ নিজের একটি জ্যোতির্লিঙ্গ রাবণের হাতে দিয়ে বললেন, ‘যেখানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাও সেখানের মাটিতে রাখবে কারণ ভুমি স্পর্শ করা মাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ হয়ে যায় অনাদিলিঙ্গ।’
রাবণ খুশি হয়ে সেই লিঙ্গ মাথায় নিয়ে ঝাড়খণ্ডের হরিতকি বনের মধ্যে দিয়ে লঙ্কায় চললেন। এদিকে মহাদেবের বদান্যতায় বিচলিত দেবতারা স্বর্গচ্যুত হওয়ার ভয়ে ছুটলেন বিপদভঞ্জন নারায়ণের কাছে। সমস্ত ঘটনা শুনে নারায়ণের নির্দেশে জলাধিপতি বরুণদেবকে প্রবেশ করালেন রাবণের পেটে এবং দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে (মতান্তরে নারায়ণ) চললেন রাবণের পিছু পিছু।
স্বাভাবিক নিয়মেই বরুণদেবের বেগ সহ্য করতে পারলেন না রাবণ। পিছনে ফিরে দেখলেন ব্রাহ্মণকে। তার হাতেই জ্যোতির্লিঙ্গ তুলে দিয়ে খানিক অপেক্ষা করতে বললেন এবং একই সঙ্গে বললেন লিঙ্গটিকে যেন মাটিতে না রাখেন। রাবণ বসলেন তো বসলেনই, বরুণের ধারা আর শেষই হয় না — সৃষ্টি হলো কর্মনাশা নদী। এরই মধ্যে নারায়ণ অন্তর্ধান হলেন জ্যোতির্লিঙ্গ মাটিতে রেখে বরুণের ধারাও বন্ধ হল। রাবণ ফিরে এসে দেখলেন ব্রাহ্মণ নেই জ্যোতির্লিঙ্গ মাটিতে প্রোথিত। লিঙ্গকে তোলার চেষ্টা ব্যর্থ হলে ক্রুদ্ধ রাবণ হাতের থাবা মারলেন শিবলিঙ্গের মাথায়, রয়ে গেল পাঁচটি আঙুলের ছাপ অনন্তকালের জন্য অচল রইল মহালিঙ্গ। লিঙ্গ পরিচিত হলেন রাবণেশ্বর নামে। কিন্তু শিবের নামের সঙ্গে রাবনের নাম জড়িয়ে রাখতে নারাজ হলেন দেবতারা।
বৈদ্যশ্রেষ্ঠ মহাদেবের স্পর্শে ৯টি কাটা মুন্ড জোড়া লেগেছিল রাবণের, তাই দেবতারা বৈদরাজ শিবের নাম দিলেন বৈদ্যনাথ।
বৈদ্যনাথ ধামের সরকারি নাম দেওঘর। কলকাতা থেকে দূরত্ব মাত্র ৩২৯ কিলোমিটার। বিশাল গোলাকার কারুকার্যমন্ডিত মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে নির্মিত হয় মন্দিরটি। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে মন্দির নির্মাণ করেন গিধৌর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পূরণমল ।
এক দরজার মন্দির। গর্ভমন্দিরের চাতালে সামান্য গর্তের মধ্যেই জ্যোতির্লিঙ্গ অবস্থান। আজও হাত দিলে স্পষ্ট করে বোঝা যায় রাবণের আঘাত করা পাঁচ আঙুলের দাগ। এই মন্দিরে ত্রিশূলের পরিবর্তে চূড়ায় পঞ্চশূল স্থাপিত। এটি সুরক্ষা কবচের প্রতীক মনে করা হয়।
সতীর ৫১ শাক্ত পীঠের একটি বৈদ্যনাথ ধাম। সতীর হৃদয় এখানে পড়েছিল। গৌরী মন্দিরটি শাক্তপীঠ। বৈদ্যনাথ মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে দুটি জলাশয় রয়েছে। একটি খনন করান পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপাল, অপরটি আকবর বাদশার সেনাপতি মানসিংহ। এটি মানসর নামে পরিচিত।
মহারাষ্ট্রের বিড জেলার পারলি বৈজনাথ:
মহারাষ্ট্রিয়দের মতে পারলির বৈদ্যনাথ আসল জ্যোতির্লিঙ্গ। মহারাষ্ট্রের বীড জেলায় অবস্থিত। প্রাচীন নাম বৈজয়ন্তী ক্ষেত্র, ১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত সুসজ্জিত শহর। শহর যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে মেরুপর্বতের গায়ে বৈজনাথের বিশাল মন্দির। এটি একটি প্রসিদ্ধ স্বাস্থ্যনিবাসও। সুবিশাল মন্দিরের সিঁড়িতে ওঠার মুখেই বিশাল প্রস্তরখন্ডের ধনমনাদেবী সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এরপর শনি মন্দির, এর উপরিভাগই শংকরাচার্যের মন্দির। এরপর সিংহ দরজা, যা দিবারাত্র খোলা থাকে। দরজা পার হলেই মন্দির প্রাঙ্গণের বিশাল চত্বর। এই মন্দিরের সংস্কার করেন অহল্যাবাই। মন্দিরের অভ্যন্তরে বিশাল নন্দীমূর্তির সামনে সেই বিশালাকার জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানকার পুজোর পরিবেশ এবং ভোরের মঙ্গলারতির পর সহস্রধারার স্নানটি দেখার মত।
এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপনের একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। গোদাবরী নদীর অববাহিকায় সৃষ্টির আদিযুগে ছিল নাগরাজ বাসুকির নগরী। সমুদ্র মন্থন কালে এই নাগরাজ বাসুকিকেই দেবতারা মন্থনের দড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। মন্থন শেষ হলে মন্দার পর্বতের ঘর্ষণে বাসুকির শরীরে হাড়গোড় আর কিছু অবশিষ্ট রইলনা। দেবতারা আর অসুর মিলে যখন অমৃতকুম্ভ নিয়ে মারামারি করছিলো তখন বাসুকিকে দেখার জন্য এগিয়ে আসেন স্বয়ং মহাদেব। সম্পূর্ণ সুস্থ করে শিব যখন বিদায় চাইলেন তখন নাগরাজ তাঁকে প্রার্থনা করেন তার সুরম্য প্রাসাদে চিরাবস্থানের জন্য। শিব তখন কৈলাস থেকে তাঁর জ্যোতির্লিঙ্গ আনিয়ে নাগরাজকে দিলেন প্রতিষ্ঠার জন্য।
শুধু সমস্যা বাধলো জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। নাগরাজের দুই কন্যা পার্বনী ও পারালি গোদাবরীর দুই তীরে পৃথক দুই প্রাসাদে থাকতেন। এবং দুজনই আবদার করলেন জ্যোতির্লিঙ্গ তাদের প্রাসাদে স্থাপনের। নিরুপায় শিব তখন আরও একটি জ্যোতির্লিঙ্গ উপহার দিলেন নাগরাজকে। দুই জ্যোতিলিঙ্গ স্থাপিত হল দুই প্রাসাদে। শিব হলেন বৈদ্যশ্রেষ্ঠ তাই এই দুই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম হল বৈদ্যনাথ। দুই বোনের হাত থেকেই পূজাগ্রহণ করেন মহাদেব। এমনকি পুজাপূর্বে পার্বনীর স্নানের জন্য অমরলোকের পবিত্র জলকে নাগনাথ মন্দিরের পাশে পূর্ণানদী রূপে প্রবাহিত করালেন। নদীটি মিশেছে গোদাবরীতে, তাই এই জ্যোতির্লিঙ্গের অপর নাম ‘অমরোদক নাগনাথ।’
এদিকে নাগরাজ্যের জনপদ ক্রমশ বাড়তে থাকায় নাগরাজ বাসুকি ঠিক করলেন অমাবস্যার দিন সপরিবারে তিনি পাতালে প্রবেশ করবেন। কিন্তু জ্যোতির্লিঙ্গের পুজো করবে কে? সেই ভেবেই পারালি আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শিব চতুর্দশীর দিন মহাদেব স্বয়ং এক নিশাদের বেশ নিয়ে জ্যোতির্লিঙ্গের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে রইলেন। তাকে সরাতে পারালি ছুটে আসতেই মহাদেব ছল করে বললেন — ‘তুমি আমাকে হাত ধরে সরিয়ে দাও।’
পারালি যেই নিষাদের হাত ধরলো, নিষাদরূপী মহাদেব তাকে পরমাদরে বুকে টেনে নিলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিষাদরূপী মহাদেব ষাঁড় ও নাগরাজ দুহিতা পারালি জ্যোতির্লিঙ্গে মিলিয়ে গেলেন। সেই থেকেই প্রতি শিবরাত্রিতে পারলিতে এক মহামেলা বসে। মন্দিরের পিছনেই বৈজনাথের একটি বিশাল কুন্ড আছে নাম ‘হর হর তালাও।’
বৈজনাথ মন্দির হিমাচল প্রদেশ :
হিমালয়ের ধৌলাধর পর্বতমালার পটভূমিতে হিমাচল প্রদেশের বৈজনাথ মন্দিরটি মধ্যযুগীয় হিন্দু স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। বহু দুরদূরান্ত থেকে রোগীরা আসে এই মন্দিরে সুস্থতার আশায়। পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই মন্দির অসংখ্যবার শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত সহ্য করেছে। ভগবান শিব এখানে চিকিৎসকদের আরাধ্য দেবতা। বৈদ্যনাথ থেকে তাই বৈজনাথ।
প্রায় ৮০০ বছরের পুরাতন মন্দিরের দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে, যার নাম বৈজনাথ প্রশস্তি। শিলালিপি থেকে জানা যায়, পরম শিব ভক্ত দুই ধনী ব্যবসায়ী আহু ও মন্যুকা ১২০৪ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। এখানে বেশ কিছু প্রস্তর লিপি আছে যার দুর্বোধ্য ভাষা উদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি।
ভারতের নাগরা ঘরানায় তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফুল পাতার কারুকাজ করা বৈজনাথ মন্দির প্রায় ৮০ ফুট উঁচু। এই মন্দিরে রাম সীতার বিবাহ দৃশ্য খোদাই করা আছে। এছাড়াও গণেশ, হনুমান-সহ বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। ভগবান শিবের বাহন নন্দীর একটি বড় বিগ্রহ আছে। বর্তমানে এই মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণ করে আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া।।
Anek kichu jante parlam tomar subade amra.26 th July 2023 deoghara darsan kore Alam kintu tomar kach prakrita tatha. palam.anek anek dhanyabad tomake
খুব খুশি হলাম আপনার মতামত পেয়ে।
অসাধারণ লেখনী
ধন্যবাদ জানাই