অনেক যন্ত্রণায় লিখেছিলেন অন্নদাশংকর রায়,—
‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নি কো নজরুল
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালি বলতে একজনই আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।’
আসলে, ইতিহাসের অমোঘ অঙ্গুলিহেলনে ‘ভঙ্গ’-বঙ্গদেশ তার শিরায়-শোনিতে বয়ে চলেছে ‘পার্টিশন’-এর যন্ত্রণা। স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ আর গর্ব, উল্লাস আর অঙ্গীকারের গভীরে লুকিয়ে থাকে এক আর্ত হাহাকার, এক নিঃসীম বেদনা। সে বেদনা দেশভাগের। ১৫ আগস্ট তারিখটি একদিকে প্রাপ্তির গরিমায় সমুজ্জ্বল, অন্যদিকে দেশবিভাগের তথা দেশ-হারানোর কষ্টে ব্যথাতুর। সন্দেহ নেই, একদম নতুন যুগের বাঙালি প্রজন্ম কথাটির পুরো তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম বা অনুভব করতে পারবে না। আমি নিজেও স্বাধীন ভারতের সন্তান। ছ-য়ের দশকের মাঝামাঝি আমার জন্ম। কিন্তু, আমাদের অল্পবয়সে, সমাজে দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাত ছিল স্পষ্ট। আমার মা তথা মামাবাড়ির সকলেই বরিশালের উদ্বাস্তু হিসেবে কলকাতায় আসেন। আমার বাবার পরিবার সম্পূর্ণ এপার বাংলার, হুগলিতে তাঁদের আদি নিবাস ছিল। কিন্তু, মামাবাড়ির সূত্রে, অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ আদানপ্রদানে, গল্প-কথায় ওপার বাংলা থেকে ভিটেমাটিচ্যুত হয়ে নতুন পরিবেশে অসহায় স্থানান্তরের কষ্ট অনুভব করার সুযোগ পেয়েছি। পরোক্ষ হলেও, তার বাস্তবতা আমাদের বাস্তবতারই অঙ্গ ছিল। বাঙাল-ঘটি বিরোধ, প্রত্যেকের নিজস্ব গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রতি অপার বিশ্বাস, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সঙ্গে প্রায় জাতীয় আত্মপরিচয়কে অঙ্গাঙ্গি রাখা, ভাষা-খাদ্যাভ্যাস-জীবনচর্যার পার্থক্য বিষয়ে নিরন্তর আলোচনা— ‘দেশভাগ’ শব্দটিকে ভুলতে দেয়নি।
আজ এই নতুন শতকের, নতুন সহস্রাব্দের নবপ্রজন্ম প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তুলনায় বিচ্ছিন্ন। ‘দেশভাগ’ শব্দটির কোনও বিশেষ তাৎপর্য তাকে বিড়ম্বিত করে না। সেটা স্বাভাবিকও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘দেশভাগ-দেশত্যাগ’ ক্রমশ ইতিহাস বইয়ের বিষয়ে পর্যবসিত হয়। প্রশ্নোত্তর আর সারস্বতচর্চার ক্ষেত্র ছাড়া তার সঙ্গে কোনও আবেগমুখর সংলাপ চলার সম্ভাবনা থাকে না। আরেকটি কথাও প্রসঙ্গত বোঝা যায়। এপার বাংলায় সমাজক্ষেত্রে ‘ঘটি-বাঙাল’ দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রশমিত হয়ে সাবলীল সম্মিলনে পরিণত হয়েছে। ‘আত্মপরিচয়’ ক্রমশ উদার, মানবিক কিংবা অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা হচ্ছে। অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতোই, ‘বাংলাদেশ’ ভূখণ্ডটি একটি ‘প্রতিবেশী’ রাষ্ট্র হিসেবেই পরিগণিত হয়। একদিক থেকে দেখলে, এই দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্বাভাবিক পরিণতি। স্বাধীনতার সত্তর বছরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি, সমাজস্মৃতি তথা জাতি-স্মৃতি ক্ষীণ হয়ে আসছে কালের নিয়মে, সাদা-কালো আলোকচিত্রে ধরা কয়েকটি মুহূর্ত সেসব, অতীতদিনের প্রবল আলোড়ন কিংবা সুতীব্র আবেগ আজ বহুলাংশে অদৃশ্য, অনধিগম্য। কালের হস্তক্ষেপেই ধীরে ধীরে আবছা হয়ে গেছেন ঋত্বিক ঘটক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস কিংবা বুদ্ধদেব বসু। এ প্রশ্ন খুবই সংগত, ‘দোহাই আলি, দোহাই আলি’— আর্তনাদে থেমে যাওয়া রেললাইন আজকের নবীন দর্শককে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেবে কেন?
অথচ, স্বাধীনতার পরবর্তী তিন-চারটি দশক জুড়ে শিল্প-সাহিত্য কিংবা থিয়েটার-সিনেমায় ‘দেশভাগ’ ঘটনাটি ছিল উত্তুঙ্গ আবেগ-উত্তেজনায় মথিত। আজও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ‘দেশছাড়া’ মানুষের আত্মকথা-আত্মবিবরণীর নানা সংকলন। সেসবই ক্রমে পর্যবসিত হচ্ছে, গবেষণা বা চর্চার ‘নিস্পৃহ’ উপাদান হিসেবে। আবারও বলি, এই ঘটনা স্বাভাবিক বাস্তবেরই প্রতিচ্ছবি। সীমান্তের কাঁটাতারের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, বিলীয়মান যুগ, বিলীয়মান কালখণ্ড এভাবেই অতীতের ‘নৈর্ব্যক্তিক’ অধ্যায়ে পরিণতি পায়।
‘দেশভাগ’ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলা আর পাঞ্জাব। যাঁর পরিকল্পনায় এই দেশভাগের রেখা টানা হয়েছিল সেই সিরিল র্যাডক্লিফের চিঠিতে স্পষ্ট কতখানি দ্রুততায়, কতখানি নির্মমতায় শত-সহস্র মানুষের নিয়তি নির্ধারণ করা হয়েছিল। উর্বশী বুটালিয়া তাঁর ‘দ্য আদার সাইড অব সাইলেন্স’ গ্রন্থে এমন বহু মানুষের করুণ পরিণতিকে পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন। বাংলার ইতিহাসেও ‘দেশভাগ’ এমন অনেক কান্না-বিলাপের সঙ্গে জড়িত। ব্রিটিশ শাসনের শেষলগ্নে সংঘটিত এমন এক নির্দয় পদক্ষেপ আমাদের জাতিসত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিলো।
‘দেশভাগ’ তথা ‘দেশত্যাগ’-এর এই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’। ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ রচিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি বই ‘পয়লা-কেতাব’ বা ‘গোড়াপত্তন পুস্তিকা’ (Primar) হিসেবে বিদ্যালয় স্তরে সুদীর্ঘকাল পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত। আটের দশকে এই বইটিকে ঘিরে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার নানান বিতর্ক-সমালোচনা ব্যক্ত করে এবং বইটির গুরুত্ব হ্রাস করা হয়। তার আগে এবং পরে অবশ্য বইটি পূর্ণ মর্যাদায় পাঠ্যসূচিতে বিদ্যমান। ‘দেশভাগ’ তথা ‘দেশত্যাগ’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘সহজ পাঠ’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বই।
২
কথাটা শুনতে একটু আশ্চর্য লাগে। প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো, শিশু-মনোবিদদের মতে, যে কোনও শিক্ষার্থীর মনে যে বইয়ের প্রভাব সবথেকে গভীর এবং সুদূরপ্রসারী, তা হলো ‘পয়লা কেতাব’ বা ‘Primar’, ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগে, খুব স্বাভাবিক সাবলীলতায় আমরা ‘অপার বাংলা’-কে খুঁজে পাই। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত দুটি বইয়ে দেশভাগের কোনও চিহ্ন না-থাকাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় বাংলা ভেঙে দু-টুকরো হবার কোনও চিহ্নও ছিল না। বিচ্ছিন্ন ‘পূর্ব বাংলা’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কিংবা ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের কোনও কল্পনা সেসময়ে অসম্ভব ছিল। তবে ‘সহজ পাঠ’ প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ একান্ত আপতিকভাবে এত দীর্ঘকাল পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যার মধ্যে দেশভাগের কোনও বাহ্যিক চিহ্ন নেই। শিশুমনে এই অত্যাশ্চর্য বই দুটি সীমান্তহীন অবিভক্ত বাংলার অনুভবকে পৌঁছে দেয়। ওপার-বাংলা থেকে আসা বহু মানুষ আজও নাতি-নাতনির বইয়ে যেন ফেলে আসা স্বদেশকে ছুঁতে পারেন।
সহজ পাঠ প্রথম ভাগের কথাই ধরা যাক। তৃতীয় পাঠেই আছে ‘আশাদাদা আজ ঢাকা থেকে এল। তার বাসা গড়পারে।…’ আবার, সপ্তম পাঠে, ‘মৈনিমাসি বৈশাখ মাসে ছিল নৈনিতালে। তাকে যেতে হবে চৈবাসা। তার বাবা থাকে গৈলা।
গৈলা কোথা? জানো না? গৈলা বরিশালে। সেইখানে থাকে বেণী বৈরাগী। এখন সে থাকে নৈহাটি।’
অন্যদিকে, সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগে চতুর্থ পাঠে ‘চন্দননগর থেকে আনন্দবাবু আসবেন।’ বা কলকাতা শহরের প্রসঙ্গের পাশাপাশি দ্বাদশ পাঠে ‘সেখানে পদ্মানদীর চরে রান্না চড়াতে হবে।… পদ্মার ধারে ছোটো ছোটো ঝাউগাছের জঙ্গল।’
অত্যন্ত মসৃণ প্রবাহে নৈহাটি, চন্দননগর, কলকাতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে গৈলা, বরিশাল কিংবা পদ্মার চর-জঙ্গল। সে কারণেই বলছি, আমরা এক ‘অপার বাংলা’, ‘যুক্ত বাংলা’-কে উপভোগ করি।
তবে ‘দেশভাগ’ নামক রাজনৈতিক সত্য বা ভৌগোলিক সত্য তো অবশ্যই বাস্তব। শিশুমনে যখন প্রশ্ন জাগে তখন সে জানতে পারে দেশভাগের কথা, বাংলা আর বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অনিবার্য কাঁটাতারের কথা। বর্তমান-সত্য, আর পাশাপাশি অতীত-সত্য বা, বলা ভালো, বর্তমান-ভূগোল আর অতীত-ভূগোল মিলেমিশে থাকে দুটি সহজপাঠে। তাকে খুঁজে নিতে হয় অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে। সহজ পাঠ প্রথম বা দ্বিতীয় ভাগে বিধৃত দু-পার বাংলার সংযুক্ত অস্তিত্ব আর বিযুক্ত বর্তমান কি এই প্রজন্মের শিশুমনে দেশভাগের যন্ত্রণাকে এক বিন্দুও সঞ্চারিত করতে পারে? হয়তো পারে, অন্তত পারা উচিত।
৩
আমি জানি, বহু পণ্ডিত আমার বক্তব্যে চঞ্চল হয়ে জানতে চাইবেন, ‘এতে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব কোথায়?’ তেমন কোনও দাবি আমি করিওনি। আমার শুধু মনে হয়, ‘পয়লা কেতাব’-এ রবীন্দ্রনাথ যে বিস্তীর্ণ জনপদ, বিচিত্র প্রকৃতি আর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিবিম্ব ধরে রেখেছেন, ইতিহাসের অমোঘ বেদনা, যার নাম ‘দেশভাগ’, তার চিহ্ন সেখানে না-থাকাটা, উল্লেখযোগ্য। ‘পয়লা কেতাব’-এর গুরুত্ব যদি বাঙালির জাতিসত্তায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাহলে এই বইয়ে সেই ‘অপার বাংলা’-র গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা আর বাঙালির সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চা (Culture Studies) এবং সাংস্কিৃতিক ইতিহাসে (Cultural History) ‘সহজ পাঠ’ প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ, নেপথ্যে এক বড়ো ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সেই ঘটনা আজও বহমান, সেটাই একটা আনন্দের কথা।
সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত