বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতুতে সুষমামণ্ডিত বাংলাদেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের ফলে বৃক্ষলতা, পত্রপুষ্প, মাঠঘাট, জলাভূমি, আবহাওয়ায় বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ বর্তমান। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কাজী নজরুল ইসলামের ‘হেরিনু পল্লী জননী’ গানে ঋতুর বৈশিষ্ট্য ও রূপমাধুর্য উপস্থাপন করেছেন এ ভাবে — ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী/ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।/রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল, আম-কাঁঠালের মধুর গন্ধে জৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেলো ল’য়ে অশনি।/কেতকী কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথো মালিকা,/পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেলো চঞ্চলা বালিকা। তড়াগে পুকুরে থইথই করে শ্যামল শোভার নবনী।/শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া,/শিউলি-ছোপানো শাড়ি প’রে ফের আগমনী গীতি গাহিয়া।/অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনী।/শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,/ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে (গো), কীর্তন শোনো রাতে মা,/ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবীরে রাঙাও নিখিল ধরণী।’
এ গানে নজরুল শরতের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার ঋতুচক্রের তৃতীয় ঋতু শরৎ। বাংলা মাসের ভাদ্র ও আশ্বিন এ দু’মাস মিলে বর্ণিল শরৎ। বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, মাঠ-ঘাট পানিতে থই থই করে। গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষাঋতু আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিলেও কখনো কখনো বন্যার অভিশাপ নিয়ে আসে। বর্ষার পর শরৎ আসে স্নিগ্ধ রূপে।
মাথার উপরের বর্ষার মেঘমেদুর আকাশের পরিবর্তে গাঢ় নীলাকাশ, নীলাকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের আনাগোনা, মৃদু বাতাসে কাশবনে শ্বেতশুভ্র কাশের ফুলের দোলা। সাদা মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের উঁকিঝুঁকি বিস্তৃত ফসলের মাঠের সবুজ ধানের ওপর, যেন আলোর নাচন! শরৎকাল বাঙালি মানসে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার সাধ জাগে। রবীন্দ্রনাথ গানে গানে বলেছেন — ‘আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায়’ লুকোচুরি খেলা/নীল আকশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা।/আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,/উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে; আজ কীসের তরে নদীর চরে চখাচখির মেলা।’ শরতের আগমনে রবীন্দ্রনাথের প্রাণ নেচে উঠেছে, তাই তো গেয়েছেন — ‘শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।’
রবীন্দ্রনাথ শরতের আগমনে আত্মহারা, তারই অনুরণন তার কবিতায়- ‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই,/কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা।/কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেবো ফুলে/তালদীঘিতে ভাসিয়ে দেবো, চলবে দুলে দুলে।/রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাবো আজ বাজিয়ে বেণু,/মাখবো গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হা হা, হা।’
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর ইত্যাদি স্থানের ভ্রমণ পর্বে পূর্ববঙ্গের নানা ঋতুবৈচিত্র্য অবলোকন করে বিমুগ্ধ হয়েছেন। তিনি দেখেছেন পদ্মা নদীর শরতের শান্ত রূপ। পল্লী প্রকৃতির রূপ মাধুর্যে ভরা পদ্মা তীরের শিলাইদহ তাকে সবচেয়ে বেশি কাছে টেনেছে। শিলাইদহ কুঠিবাড়ির চারপাশের সবুজ ধানের ক্ষেতের মোহনীয় বিমুগ্ধ হয়েছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর ইত্যাদি স্থানের ভ্রমণপর্বের বর্ণনা তার অধিকাংশ চিঠিতে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিপিবদ্ধ করেছেন, যা ছিন্নপত্রাবলি নামে খ্যাত। ছিন্নপত্রাবলি পত্রসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কাব্যিক গদ্যে বাংলার শরতের দৃশ্যাবলি তুলে ধরেছেন।
শরতকালের দিনের বেলা নদী-নালা, খাল-বিলের ধারের কাশফুলের শোভা ছাড়াও রাতের বেলার জোছনাস্নাত খাল-বিলে শাপলা শালুকের সৌন্দর্য বিমুগ্ধকর। ঐশ্বর্যদায়িনী শরৎ ঋতুকে শারদলক্ষ্মী অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ শরৎকালে বৃক্ষরাজি থাকে সবচেয়ে সবুজে ভরা যেন একটা গাঢ় সবুজে ছোঁয়া লেগে আছে গাছে গাছে, ভরা খাল-বিল নদী-নালা, বিলজুড়ে সাদা-লাল শাপলার মেলা আর পদ্ম ফুলে ফুলে। বিলের পাড়ে নদীরে পাড়ে অনেক গাছ ডুবে থাকে পানিতে; গাছের পাতাগুলো ছুঁয়ে আছে নদী বিলের পানিতে। শান্ত নদীতে ভেসে চলেছে একটি বা অনেকগুলো নৌকা এমন দৃশ্যে কে না প্রকৃতিপাগল হয়! এ সব দেখেই আমরা বুঝতে পারি কত বিচিত্র আমাদের ছয় ঋতুর দেশ।
শুধু শাপলা আর পদ্ম ফুলে ফুলের মেলা নয়, খালে বিলে নানান লতা, বাগানে বা পথের ধারে কামিনী, মালতি, জবা, টগর, হাসনাহেনা আর আমাদের মনে শরতের আগমনী বার্তা বেশি করে দিয়েছিল কাশফুল আর শিউলি ফুল। কবিরা লিখেছেন কত কবিতা ও গান শরৎবন্দনায়।
শরতের ভোরে গ্রামের মেঠোপথে হালকা কুয়াশা। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ। শরৎকালের শুরু থেকেই প্রকৃতি যেন নতুন সাজে নিজেকে রাঙায়। অপরূপ আলোকচ্ছটা ও সৌন্দর্যে কারণে শরৎকাল সত্যিই ঋতুরাণী।
বর্তমানে দেশে শরদোৎসব সর্বজনীন রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ঋতুর বন্দনা হয়। সেই রীতি ধরে শরৎ বন্দনায় মেতে উঠি আমরা। শরৎকালে আশ্বিন মাসে বরাভয়দাত্রী দুর্গা দেবী আরাধনায় সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। তাদের মতে শরৎকালে কৈলাসবাসী পতি মহাদেবের গৃহ থেকে দুর্গা বা উমা বাপের বাড়িতে অর্থাৎ পিতা-মাতার গৃহে বেড়াতে আসেন মাত্র চারদিনের জন্য। এ কারণে শরৎকালে নববধূকে পিতার বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ে নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাঙালি হিন্দুর মনে শরৎ মানেই দুর্গতিনাশিনী মায়ের পিত্রালয়ে আগমন। হিন্দু রমণী, কিশোরীরা নতুন শাড়ি ও জামা পরে এবং সিঁথিতে সিঁদুরের টান, কপালে টকটকে লাল টিপ পড়ে সধবাদের নারীদের দল বেঁধে এ শরতে দুর্গা প্রতিমা দর্শনের যাওয়ার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় শরৎ ঋতুকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
শরৎ একটা স্নিগ্ধ ঋতু, রবীন্দ্রনাথের শরৎবন্দনা অনেক আছে। যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শরতে বঙ্গজননী অপরূপ রূপে বের হন, সেই রবীন্দ্রনাথ শরতের মোহন রূপে ভুলতে চাইছেন না! বলছেন, তার চরণমূলে মরণ নাচছে। আর শরতের এলোচুলই বা আসবে কোত্থেকে, সেখানে ঝড়ের কথাই বা আসছে কেন!
এরপরও আমাদের বলার অনেক কিছু থাকে। তা হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পায়ের আওয়াজ পেয়ে এক শরতে রবীন্দ্রনাথ তার পায়ের নিচে মরণনৃত্য দেখেছিলেন। আজ অবক্ষয়তাড়িত সমাজের মরণনাচন দেখেও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শরতের উদ্দেশে বলতে চাই — তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে!
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ