চতুর্থ অধ্যায়
মুঘল উজির রূপে মীর জুমলা
প্রথম ভাগ
আওরঙ্গজেবের দূত হিসেবে উজিরিকর্ম
৭। আওরঙ্গজেব আর মীর জুমলার বিরোধ
এতসব ঘটনাবলীর মধ্যে দুই সঙ্গী, আওরঙ্গজেব আর মীর জুমলার মধ্যে কয়েকটি ঘটনার জেরে দ্বন্দ্বের আবহ তৈরি হল। আওরঙ্গজেব অবাক হয়ে জানলেন, সম্রাট জেনেছেন আওরঙ্গজেব শাহজাদা মহম্মদ সুলতানকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করছেন। কুতুব শাহের স্বাক্ষর এবং প্রতিশ্রুতিওয়ালা গোপন আহদানামার নকল দরবারে মীর জুমলা সম্রাটকে দেখিয়েছেন। ফলে আওরঙ্গজেব ক্ষুব্ধ হলেন। এই তথ্যটা সত্য না মিথ্যা, সে বিষয়ে ইতিহাস নীরব। অন্যদিকে মীর জুমলা একটা বিষয়ে আওরঙ্গজেবের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আওরঙ্গজেব দক্ষিণের সুবাদারির সময় খাস বা আম দরবার আয়োজন করেন না, সেটা তাঁর পছন্দের ছিল না। আওরঙ্গজেবকে এ বিষয়ে মীর জুমলা ক্ষোভ জানালে সুবাদার তাঁকে (মুনসীর মাধ্যমে) জানান যে তার পক্ষে বিধিবদ্ধভাবে দরবার আয়োজন করা সম্ভব হয় না, তিনি দরবারের চাটুকারির পরিবেশ পছন্দ করে না। আওরঙ্গজেব অভিমানভরে মীর জুমলাকে লিখলেন মীর জুমলা রাষ্ট্রের বড় বড় বিষয় সমাধান করতে এতই ব্যস্ত, তাই আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবনের নানান ছোটখাট সমস্যা নিয়ে তাঁর মাথা ঘামাবার সময় নেই। আবারও দরবার আয়োজন না করার যুক্তি হিসেবে আওরঙ্গজেব বলেন, যেদিন তাঁর উপবাস থাকে, সেদিন তিনি দরবারে যোগ দেন না, তাছাড়া তাঁর শিবিরে দেওয়ানি আম বা দেওয়ানি খাস আয়োজন করার কাঠামো তখনও তৈরি হয় নি।
আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ওমাদাতুল মুলক খান জাহানের (শায়েস্তা খান) সঙ্গে মিলে কোনও একটি তুচ্ছ বিষয়ে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেটা খুব সম্ভব সম্রাটের কোনও নিকটাত্মীয় সম্বন্ধে কান ভাঙ্গানোর চেষ্টা, অথবা আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ সুবার পাশের সুবা মালওয়া থেকে শায়েস্তা খানের বদলির জন্যেও হতে পারে; কিন্তু সেই বদলি হওয়ার বিষয়টা আওরঙ্গজেবের নিজের নিরাপত্তার পক্ষে সুখকর হবে না। তবে তিনি একটা জিনিস বুঝলেন, মীর জুমলা জুমলার সহৃদয়ভাবে তাঁর সমস্যাগুলি মিটমাটের চেষ্টা করছেন। আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘যদিও মীর জুমলার (রুখউসসুলতানত, সাম্রাজ্যের স্তম্ভ) পক্ষ থেকে বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে, কিন্তু সেটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখতে হবে। সর্বশক্তিমান তাকে সফল হওয়ার মন্ত্র দান করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের বন্ধুত্ব পালনে সে সদা তৎপর। আমাদের উভয়কেই উভয়ের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। খানের উকিলকে আমাদের পক্ষে আনতে হবে, যাতে সে অন্যদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারে।’
তুচ্ছ এই ঘটনায় দুজনের মধ্যে সাময়িকভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হলেও এই ভুলবোঝাবুঝি আরও গভীরে যাবে কর্ণাটক জায়গির নিয়ে মীর জুমলার ইনসিকিউরিটি জনিত ক্ষোভ তৈরি হওয়ায়। মীর জুমলার হয়ত মনে হচ্ছিল আওরঙ্গজেব তাঁর কর্ণাটক জাগির দেখাশোনা করতে খুব একটা উতসাহ দেখাচ্ছেন না। কিন্তু এই রাজনৈতিক মুহূর্তে আওরঙ্গজেবের পক্ষে দিল্লির দরবারে তার একমাত্র প্রতিনিধি, সখা উজিরের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়। তিনি জানেন, যে কোনও এক ভুল পদক্ষেপে সাজানো বাগান সুজিয়ে যেতে পারে। অতীতে তাঁর এই অভিজ্ঞতা আছে। তিনি তাঁর লক্ষের ফোকাস সরাতে চান না। মীর জুমলার মনের দ্বিধা দূর করতে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কর্ণাটক নিয়ে উজিরের চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণই থাকতে পারে না। তিনি কর্ণাটক বিষয়ে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছেন, মীর জুমলা কর্ণাটক নিয়ে দ্বিধা দূর করুক।
দ্বিতীয় পর্ব
মীর জুমলার কর্ণাটক ভাগ্য
১। মুঘল সাম্রাজ্য মীর জুমলার জায়গির হল কর্ণাটক
কুতুব শাহীর বিরুদ্ধে মীর জুমলার বিদ্রোহ শেষ। মুঘল বাহিনীর হায়দ্রাবাদে ঢোকা আপাতত বন্ধ রয়েছে। কুতুব শাহ আর মুঘলদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু যে অঞ্চলের জন্য এই বিশাল বিবাদ-ঝগড়া-যুদ্ধ, সেই কর্ণাটক ভূখণ্ডের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে তখনও সেই বিষয়টার সমাধান হয় নি। সুলতান স্বাভাবিকভাবেই কর্ণাটকের মত সম্পদশালী এলাকা নিজের তাঁবেতে রাখতে চাইলেন। তাঁর যুক্তি মীর জুমলা সুলতানেরই কর্মচারী হিসেবেই সম্পদভরা কর্ণাটক অঞ্চল দখলে নিয়েছিল। আমরা বরাবরই দেখেছি আওরঙ্গজেব শ্যেনদৃষ্টি কিন্তু কর্ণাটক দখলের ওপরেই নিবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৬৫৬-র মার্চে তিনি উজির সাদুল্লা খানকে বলেন, ‘কর্ণাটকের বিষয়ে যদি বলি, তাহলে বলতে হবে মীর জুমলার গোমস্তাদের অধীনে বেশ কিছু হিরের খনি রয়েছে, আর রয়েছে সমুদ্র বন্দর; এখন সেটি সাম্রাজ্যের সম্পত্তি, সময় এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গোলকুণ্ডা থেকে রামগির (পাইনগঙ্গা আর গোদাবরীর মধ্যেকার স্থান — আজকের মানেকদুর্গ আর চিন্নর) দখল করে তেলেঙ্গানাকে উত্তর কর্ণাটকের শাসনে নিয়ে এসেছিলেন আওরঙ্গজেব। এবারে এই অঞ্চলের এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে আর গোলকুণ্ডাকে ছোঁয়ার দরকার হল না — সরাসরি সেনাবাহিনী নিয়ে গোলকুণ্ডা এড়িয়ে যাতায়াত করার সুযোগ তৈরি হল। কর্ণাটক দখলে রাখার সমস্ত রকম সুলতানি পরিকল্পনায় জল ঢালছিলেন আওরঙ্গজেব।
মীর জুমলা দিল্লি পৌঁছবার আগেই সুলতান কুতুব শাহ কর্ণাটক দখলে রাখাতে দিল্লির দরবারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কর্ণাটক এবং পৈতৃক রামগীর দুর্গ দখলে রাখতে শাহজাহানকে কাতর আবেদন জানান। তাঁর ধারণা ছিল এই প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব তাঁর পক্ষে দাঁড়াবেন, এমন কী তিনি জাহানারাকে রাজি করিয়ে এই প্রস্তাব সম্রাটের সামনে পৌঁছবার ব্যবস্থাও করেছিলেন। আওরঙ্গজেব সুলতানকে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি জানালেন ঠিক হয়েছে মুয়াজ্জম খানের পদে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টি দরবারে আলোচনা হবে না। আওরঙ্গজেবের প্রস্তাবে কান না দিয়ে কুতুব শাহের দিল্লির দূত মুল্লা আব্বাস সামাদ, দারার মাধ্যমে সম্রাটকে এই বিষয়ে আবেদন জানান। আশ্চর্যের নয় যে দরবারে আওরঙ্গজেবের বিরোধী দারা অনেক কিছুর মতই এই বিষয়েও সম্রাটের হৃদয় জয় করে সম্রাটের অনুমতি নিলেন। মোটামুটি ঠিক হল পুরোনো রাজ্যের অধিকারের সঙ্গে কর্ণাটকেরও অধিকার থাকবে সুলতানের হাতে। সুলতান আওরঙ্গজেব বা আওরঙ্গজেবেরর উকিলকে এড়িয়ে সরাসরি সম্রাটের কাছে দরবারে প্রস্তাবটি পেশ করায় চরম অপমানিত বোধ করে আওরঙ্গজেব সুলতানকে উদ্ধত বললেন এবং তাকে মনে করিয়ে দিলেন, ঠিক হয়েছিল মীর জুমলা দিল্লি না পৌছনো পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সমস্ত আলোচনা স্থগিত থাকবে।
মীর জুমলাও বুঝলেন পর্দার পিছনে দাঁও প্যাঁচ। ঠিক করলেন তাঁর ন্যায্য অধিকার প্রতিবাদ ছাড়া সহজে সুলতানকে কেড়ে নিতে দেবেন না। আওরঙ্গজেব পরিকল্পনা ছিল সুলতানের বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে কেল্লা আর কর্ণাটক বিষয়ক আবেদন মীর জুমলার মার্ফত দরবারে পেশ করাবেন। চিঠির পর চিঠি দিয়ে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ দিচ্ছেন কিভাবে বাবা বাছা করে সম্রাটকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা যায়। মীর জুমলা দিল্লিতে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে আওরঙ্গজেব নির্দেশ দিলেন দরবারের দারা-মুখী সুলতানের রাজনীতিকে পরাস্ত করে তিনি যেন সম্রাটের থেকে অবিলম্বে কর্ণাটক দখলের ফরমান জোগাড় করে নেন। হায়দারাবাদ অভিযানের আগে আওরঙ্গজেব কর্ণাটকের মত এলাকা কেন দখলে রাখতে হবে সেই বিষয়টি পই পই করে সম্রাটকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর যুক্তি সম্রাটকে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত করবে নি। কিন্তু এবারে তিনি আর একা নন। তাঁর সাথী হিসেবে দরবারে আছেন প্রধানমন্ত্রী মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্র সূত্রে আমরা বুঝতে পারছি, দক্ষ কূটনীতিকদের মত মীর জুমলা নিজের বাচনভঙ্গীর আভিজাত্যে, উপহারের ঔজ্জ্বল্যে সম্রাটকে কিছুটা হলেও বশ করেতে পেরেছেন। মীর জুমলার হাতে কর্ণাটকের অদ্ভুত সব মণিমাণিক্য দেখে লোভাতুর হয়ে সম্রাট শাহজাহান সুলতানকে কর্ণাটক জায়গির হাত বদল করার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। ঠিক হল কর্ণাটকের দখল মীর জুমলার হাতেই থাকবে (জুলাই, ১৬৫৬); তিনি কর্ণাটক রাজ্য সাত বছর রাজস্বহীন ব্যক্তিগত জায়গিররূপে ভোগ করবেন। ততদিনে কুতুব শাহের কর্ণাটক দখল নেওয়ার স্বপ্ন শেষ। সুলতান কর্ণাটকের জন্যে মুঘল সাম্রাজ্যকে বছরে ১৫ লক্ষ টাকা পেশকাশ দিতে চাইলেন। কিন্তু এতেও চিড়ে ভিজল না। মীর জুমলা জানেন সে দেবতার যে পুজো। তাঁর নল চালানোর দক্ষতায় তাঁর উচ্চাশাময় আবেদন শাহী দরবারে সরাসরি নাকচ হয়ে গেল। এখন বেসাহারা সুলতান বাধ্য হয়ে শাহজাদা আওরঙ্গজেবের কাছে কর্ণাটক দখল রাখার কাতর আবেদন করলেন। আওরঙ্গজেব সেই আবেদন সম্রাটের কাছে পৌঁছতে আস্বীকার করে ব্যঙ্গভরে বললেন দরকার হলে প্রস্তাব সরাসরি দরবারে পাঠান। ভূপতিত কুতুব শাহ কী করে কর্ণাটকের দখল হারালেন এবং সেটি কি করে মীর জুমলার হাতে এল, সেই ঘটনা বিশদে বর্ণনা করে আওরঙ্গজেব লিখলেন, ‘হায়দারাবাদে শাহী সেনা প্রবেশের সময় আমি তোমায় বলেছিলাম, তোমার যে কোন চাহিদা পূরণে সম্রাটকে খুশি করতে তোমার পছন্দের মহামূল্যবান রত্নগুলো তাঁকে উপহার দাও। কিন্তু তুমি আমার কথায় কান দাও নি। অন্যদিকে মীর জুমলা সম্রাটকে তাঁর মত মত হিরে, জহরত, মহামূল্যবান গয়না, অন্যান্য মূল্যবান জিনিস উপহার দিয়ে তাঁর কাজ করিয়ে নিল… আমি তোমায় ঠিক রাস্তা দেখিয়েছিলাম। আমার পরামর্শ মত চললে তোমার অবস্থা এরকম সঙ্গীন হত না। যারা অভিজ্ঞ ব্যক্তির কথা না শুনে কাজ করে, তাদের কোনও পরামর্শ দেওয়াই অপরাধ।’ মীর জুমলা বাহুবলে যে অঞ্চলটি দখল করেছিলেন, সেটি এবারে দিল্লির দরবার ঘুরে তাঁর আইনসিদ্ধ দখলদারি হিসেবে গণ্য হল।
২। দক্ষিণের ক্ষমতাবানেদের প্রতিক্রিয়া
কর্ণাটক থেকে মীর জুমলা দিল্লির দরবারে অভিবাসন হলেন এবং দক্ষিণে তাঁর সেনার পরিমান কমল। মীর জুমলার তারকার মত উত্থানে চরম ঈর্ষায় ভোগা দক্ষিণের জোড়া অদক্ষ সুলতান আর হতাশ ক্ষমতাবানদের মধ্যে নতুন করে, মালিকের স্থায়ী অনুপস্থিতিতে ধনসম্বলে ভরপুর কর্ণাটক রাজ্য থেকে যতটা পারা যায় ভূমি, সম্পদ, ক্ষমতা দখলের উদগ্র বাসনা পেকে উঠল। দুই সম্রাট তাদের সেনাবাহিনীকে কর্ণাটক দখলদারির কাজে যতদ্রুত সম্ভব এগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আবদুল জব্বার খানের নেতৃত্বে তাঁর পুরোনো এলাকা দখলে আনার নির্দেশ দিয়ে কুতুব শাহ একটি বাহিনী উত্তর কর্ণাটকের অভিযানে পাঠালেন। আদিল শাহ জিঞ্জির কেল্লাদারকে নির্দেশ দিলেন ১৬৫৬-র জুনের মধ্যে মীর জুমলার দখলে থাকা কর্ণাটকের দক্ষিণতম সীমান্ত এলাকা দখল করতে। চন্দ্রগিরির রাজা তাঁর হারানো জমি উদ্ধারে সৈন্যসাজ করতে শুরু করলেন। যারা মীর জুমলার কাছে নানাভাবে পরাজিত হয়েছিল, স্বার্থবদ্ধ ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলেন।
ক্ষমতার নতুন বিন্যাসে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সুলতান কুতুব শাহ। বুঝলেন, দরবারি আলোচনা, প্রাসাদে লবি করা আর অভিজাতদের দুয়ারে কূটনীতির দিন শেষ, এবার সময় হয়েছে মাঠে নেমে লড়াই করার — তাঁর সঙ্গে দিল্লি দরবারে দারার আওরঙ্গজেব বিরোধিতা অবলম্বন করা সফল কূটনীতির জাল ছড়ানোর সুযোগ তো রইলই। দারার প্ররোচনায়, কুতুব শাহ আওরঙ্গজেবের একের পর এক হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কর্ণাটক আর কাম্বামের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিলেন। মনে মনে ইচ্ছে বাধা আর ধোঁকা দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধন। কর্ণাটক সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী না সরিয়ে তিনি সেনাপতি আবদুল জাব্বারকে নির্দেশ দিলেন মীর জুমলার তৈরি করা ডাকচৌকিগুলোয় আঘাত হানতে এবং তাঁর ব্যবসায়িক দালালদের সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধাতে, যাতে কর্ণাটকের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে তীব্র গোলযোগ তৈরি হয়। কর্ণাটকে সাম্রাজ্যের আধিকারিক পৌঁছনোর আগেই কুতুব শাহ বেশ কিছু মহালে রাজস্ব তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।
এই সব ছোটখাট গণ্ডগোল সমাধান করার থেকে কুতুব শাহের সামনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল পুলিকট। স্যান থোম, আর পুনামাল্লির হিন্দু নায়েক, জমিদার, ভিজাদার, বা রয়ালের অধীনে থাকা কর্ণাটকে সিপাহীরা যারা একদা মুসলমান শাসনে ছিল, মাঝেমাঝেই পুলিকট আক্রমন করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। গাণ্ডিকোটার কিলাদার হাজি সুলেইমান লিখছেন, সক্কলে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে গাণ্ডিকোটা ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে মীর জুমলার হরকরাদের চিঠিপত্র বিলি না করতে হুঁশিয়ারি দিল। শ্রীরঙ্গ ১৬৫৬ পর্যন্ত যে উচ্চমানের রাষ্ট্র পরিচালনা করে এসেছেন, সেই স্মৃতি খুঁচিয়ে তুলে অঞ্চলের নায়কেরা তাঁর উদ্যমে হারানো জমি এবং সম্মান উদ্ধারের চেষ্টা করলেন। এই বিদ্রোহ সেই পথে এক পা। একে শুধু স্থানীয় সামন্তদের হুজ্জুতি-হ্যাঙ্গাম বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। যদিও মীর জুমলা তাঁর শাসন ক্ষমতার প্রমান দিয়ে তার জয় করা অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি স্থানীয় হিন্দু রাজা, জমিদার সামন্তদের স্বাধীনতার ইচ্ছের মাথা মুড়িয়ে দিতে পারেন নি বরং তাদের মন্দির ধ্বংস করে মূর্তি দখল নিয়ে মন্দির আর ব্যক্তিগত মানুষের জমানো সোনাদানা দখল করে তাদের বিশ্বাসে ঘা দিয়েছিলেন। যদিও কর্ণাটকের সাম্প্রতিক হ্যাঙ্গামের দায় দক্ষিণের দুই সুলতান কিছুটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, কিন্তু গোলযোগ তৈরির বড় ভূমিকা পালন করেছেন শ্রীরঙ্গ রয়াল নিজে এবং স্থানীয় জমিদারেকূল। আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে সুলতানী সেনাবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি তাদের বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করেছে। আওরঙ্গজেব, শাহকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখলেন, ‘তোমার আধিকারিকদের দিয়ে (যাদের নাম এই চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিলাম) দেশের জমিদারদের হায়দ্রাবাদে ডাকিয়ে এনে উত্তেজিত করিয়ে তুমি এই অঞ্চলে অব্যবস্থার বীজ বপন করেছ… তুমি ভাগ্যহীন রয়ালের বিশ্বাসও অর্জন করেছ এবং তাঁর হাজিবের সঙ্গে একজন আধিকারিক পাঠিয়েছ, এবং কয়েকটি মহালের (তাঁর বিশদ বিরবরণ দেওয়া হল) খানেদের গোমস্তাদের থেকে অধিকার কেড়ে নিয়েছ। একটি সুশাসিত দেশকে তুমি টালমাটাল করে দিয়েছ।’ চেম্বার্স ন্যারেটিভএ এই মন্তব্যটি পাওয়া যাচ্ছে, ‘গোলকুণ্ডার রাজা কর্ণাটককে রয়ালের হাতে তুলে দিলেন’।
শুরুর দিকে হিন্দু রাজত্বগুলো ভূমি দখলের কাজে সহজ সাফল্য লাভ করে। রয়াল তিরুপতি দখল করলেন, তারপর কাঞ্জিভরম, চিংলেপুট এবং পুলিকট দখল করার পরিকল্পনা করলেন। ১৬৫৬-র অক্টোবরে মাদ্রাজের আশেপাশের পুনামাল্লির প্রাসাদ ছাড়া, শ্রীরঙ্গর শ্বশুর ভেঙ্গম রাজার সহায়তায় বহ এলাকা দখলে এল। ভেঙ্গম রাজা পেড্ডাপোলিয়াম দখল করলেন। মীর সঈদ আলি, মীর জুমলার পুনামাল্লির সুবাদার পুলিকটে পালিয়ে গেলেন, সেখানেই মীর জুমলার অধিকাংশ সম্পদ রাখা ছিল। এই সংবাদে নবাবের সেনাবাহিনী উত্তেজিত হয়ে পাল্টা আক্রমনে তেতে উঠল। তাল্লিয়ারদের একসঙ্গে করে ভেঙ্গম রাজা পুলিকটের দিকে অভিযান করলেন এবং শ্রীরঙ্গর সেনাপতি কোনারি চেট্টিকে নির্দেশ দিলেন পুনামাল্লি ঘিরে থাকা এলাকার মানুষদের জমায়েত করে গোটা দেশ দখল করতে। কোনারি, নবাবের স্যান থোম, মায়লাপুর এবং পুনামাল্লির সুবাদার, বালা রাউকে গ্রেফতার করলেন স্যান থোমের কাছে তাল্লিয়ারদের বিশ্বাসঘাতকতায়। তারা মীর জুমলার ২০টি এবং অন্যান্য মুসলমান ব্যবসায়ীর ১৬টি হাতি দখল করে মাদ্রাজে নিয়ে এল।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নবাবের সেনাপতি টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়েক, লিঙ্গম নায়েকের নেতৃত্বে ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক বাহিনী পাঠিয়ে কোনারি চেট্টিকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল। পুনামাল্লির পথে কোনারির সঙ্গে দু-দিনে কয়েকবার ছোটখাট লড়াই হল। হিন্দুরা পুনামাল্লি প্রাসাদ দখল না করার কারণ হল কোনারি সেটি দখল করার কাজে অসম্ভব দেরি করে যাকে বিশ্বাসঘাতকতাও বলা যায়। তাছাড়া সে মীর জুমলার সেনাকেও দেরি করে আক্রমণ করে। সেই সুযোগে তাদের বিপক্ষ একজোট হয়ে তাদের হারিয়ে দেয়। তাঁর সপক্ষে বলা যায় মুসলমানেদের বিরুদ্ধে হারার পরে পুলিকট ঘিরে বসে থাকা ভেঙ্গম রাজা তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধে কিন্তু তারা লিঙ্গম নায়েককে হারাতে পারে নি। মুসলমান বাহিনীর তাড়ায় রয়ালের হিন্দু সেনাপতিরা মাদ্রাজের কাছে পেড্ডানাকিপেট্টায় পালিয়ে কেল্লায় আশ্রয় চায়।
বিজাপুরের সহায়তায় কুতুব শাহ মীর জুমলার জায়গির অঞ্চলের বাহিনীর ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। আওরঙ্গজেব আবারও হুশিয়ারি দিয়ে লেখেন, ‘তুমি সেধে সেধে বীজাপুরের ধ্বংস চাইছ। কর্ণাটক দখলের হুজুগ তোমার মাথা থেকে এখনও যায় নি। তুমি পাগলের মত সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। যখন গোলকুণ্ডা রাজ্য দুদিকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে ঘেরা, তুমি তখন তোমার শয়তানি পরিকল্পনা হাসিল করতে কর্ণাটক দখল করতে বাহিনী পাঠাচ্ছ। এর আগে তুমি জমিদারদের খেপিয়ে তুলে গোলযোগ তৈরি করেছ, তুমি ডাকচৌকিগুলোতে হামলা করেছ। আগামী দিনে এই হঠকারী কাজ করা থেকে বিরত থাক। বিজাপুরকে তোমার ভুল পথে টেনো না। দূরদৃষ্টি বজায় রাখ। মনের আয়নায় ঘিরে থাকা কুয়াশা সরিয়ে নাও, অনেক কিছুই স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে…’। (চলবে)