বুধবার | ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:০৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এ আমার এ তোমার পাপ : দিলীপ মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকট — ত্রান সহায়তা ও কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে : তপন মল্লিক চৌধুরী বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সময় হোক বা পরিস্থিতি, প্রণাম সব শিক্ষককেই : প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার

দিলীপ মজুমদার / ৮৭ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আর জি কর মেডিকেল কলেজে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল গত ৯ আগস্ট। এক তরুণী ডাক্তার নির্মমভাবে ধর্ষিতা ও খুন হলেন। স্বাভাবিকভাবে এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন মানুষ। সোচ্চার হল সমাজ-মাধ্যম। প্রকাশিত হতে লাগল নানা ভিডিয়ো, ইউটিউব। এর মধ্যে দু-একটি ইউটিউব একটু অন্যরকমের। সেসব ইউটিউবে বসানো হয়েছে প্রেতবৈঠক বা প্ল্যানচেটের আসর। আহ্বান করা হয়েছে মৃতার আত্মাকে। মিডিয়াম বা ঘোষকের মুখে আমরা শুনছি, আত্মা এসেছে এবং ঘটনার বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে। জানিয়ে দিচ্ছে সেদিন রাতে ঠিক কি ঘটেছিল।

এই প্রেতবৈঠক সম্বন্ধে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন :

“সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান রকমের রিলসের ছড়াছড়ি তো ছিলই, সাম্প্রতিক সংযোজন নির্যাতিতার ‘আত্মা’কে হাজির করিয়ে নেওয়া সাক্ষাৎকার। বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেলে এমন ভুয়ো ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে ইউটিউবার প্ল্যানচেট করে নির্যাতিতার আত্মাকে ডেকেছেন বলে ওই ভিডিয়োতে দাবি করেছেন। বই-এর পাতায়, হরর-সিনেমায় প্রেতবৈঠক পড়তে-দেখতে অভ্যস্ত রোমাঞ্চপ্রিয় বাঙালি। কিন্তু এমন একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে এই ধরনের ছেলেখেলা বরদাস্ত হচ্ছে না কারোর। অথচ সেই ভিডিয়ো নিমেষে লাখ লাখ মানুষ দেখছেন।” (হিন্দুস্তান টাইমস, বাংলা)

এর প্রতিবাদ করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চ। এই সমিতির সম্পাদক মণীশ রায়চৌধুরী বলেছেন, ‘যাঁরা আর জি করের নির্যাতিতা তরুণীর আত্মার সঙ্গে কথা বলার দাবি করছেন, তাঁরা সামনে আসুন। আমাদের সমিতির সদস্যদের সামনে প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রকাশ করুন খুনীদের নাম। তাহলেই ৫০ লক্ষ টাকা পুরস্কার মিলবে। আর না পারলে মেনে নিন এগুলো স্রেফ বুজরুকি, লোক ঠকানোর কায়দা মাত্র।” (হিন্দুস্তান টাইমস, বাংলা)

এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একবার আত্মা, প্ল্যানচেট প্রভৃতি বিষয়ের পরিচয় জেনে নেওয়া যাক। জেনে নেওয়া যাক আমাদের বাংলায় প্রেতবৈঠকের কোন পুর্ব ইতিহাস আছে কি না!

আত্মা, আত্মায় বিশ্বাস

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে আত্মায় বিশ্বাসের কথা আছে। এই আত্মা শরীর নয়, কিন্তু জীবের অংশ। প্রাণীর মৃত্যুর পরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে আত্মা। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন জীবিত অবস্থায় যিনি ভালো কাজ করেন, তাঁর আত্মা স্বর্গবাসী হয়, বিপরীতদিকে মন্দ কাজ করলে নরকবাসী হতে হয়। ইসলামধর্মে আত্মার নাম ‘রুহ’। প্রতিটি জীবের শরীরের ভেতরে থাকে রুহ। মৃত্যুর পরে আল্লাহ রুহকে ফিরিয়ে নেন নিজের কাছে। হিন্দুধর্মে আত্মা শাশ্বত এবং চৈতন্যস্বরূপ। আত্মার কারণে মানুষের মন চিন্তার সামর্থ্য অর্জন করে। হিন্দুধর্মমতে জীবের মধ্যে জীবাত্মা যেমন আছে, তেমনি আছে পরমাত্মা। এই জীবাত্মা কৃতকর্ম অনুযায়ী স্বর্গ বা নরক ভোগ করে।

কি আছে গীতায়?

হিন্দুদের উপর গীতার প্রভাব অসীম। মৃত্যুর সময়ে গীতাপাঠ একটি প্রচলিত রীতি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়ে প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা ভেবে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন শিউরে উঠেছিলেন। তিনি অস্ত্র সংবরণ করতে চাইলেন। আর তিনি যুদ্ধ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত করলেন। তখন তাঁর নেতিবাচক চিন্তাকে ইতিবাচক করার প্রয়োজন অনুভব করলেন শ্রীকৃষ্ণ। একালের ভাষায় ব্যাপারটা ‘মগজ ধোলাই’ বা ‘ব্রেন ড্রেন’ বলা যায়। বুদ্ধিমত্তায়, রাজনীতিজ্ঞানে, শাঠ্যে, চাতুর্যে বাস্তবিক শ্রীকৃষ্ণের কোন তুলনা নেই।

শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনের কাছে আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করলেন (০২/১৮)। তিনি বললেন, দেহকে আশ্রয় করে আত্মার অবস্থান। দেহ নশ্বর, কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। আত্মা বিনাশহীন ও প্রমাণের অতীত।

এরপরে সেই বিখ্যাত শ্লোক — ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়’… (০২/২২)। আত্মার অমরত্বের কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণ বললেন : মানুষ যেমন পুরাতন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমনি আত্মা পুরাতন মানব শরীর ত্যাগ করে নতুন মানব শরীর গ্রহণ করে।

ঠিক পরের শ্লোকটি (০২/২৩) হল — ‘নৈনং ছিন্দন্তিং শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকং’…। বলা হল : আত্মাকে অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, শস্ত্রাদি কাটতে পারে না, জল আর্দ্র করতে পারে না, শুষ্ক করতে পারে না বায়ু।

প্রিয়জনের শোক থেকে অর্জুনকে বিরত রাখতে বলা হল — ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ’ (০/২৭)। কৃষ্ণ বললেন : যে জন্মগ্রহণ করেছে তাকে মরতে হবে, আবার যে মরবে সে নতুন জন্ম গ্রহণ করবে। সুতরাং শোক কেন মৃত্যুর জন্য? হে অর্জুন, তুমি শোক পরিহার করো। যা অবশ্যম্ভাবী তাকে মেনে নাও।

কৃষ্ণ বললেন, তুমি দুঃখ করছ কেন জানো? আসলে তুমি শরীরকে সর্বস্ব বলে মনে করছ বলেই দুঃখ পাচ্ছ। ‘অব্যাক্তদীনি ভূতানি ব্যাক্তমধ্যানি ভারত’… (০/২৮) ; জন্মের আগে জীব শরীর-রহিত ছিল, মৃত্যুর পরেও শরীর বর্জিত হবে। তার জন্য শোক করা উচিত নয়।

না থাকুক শরীর। আত্মা তো থাকবে। তার যে জন্ম-মৃত্যু নেই। ‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ/নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ /অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো/ন হন্যমানে শরীরে’ (০/২০) … আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তাই শরীরের বিনাশ হলেও আত্মা অবিনশ্বর।

কি বলছেন স্বামী অভেদানন্দ?

শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্তমঠ প্রকাশ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের (আসল নাম কালীপ্রসাদ চন্দ) ‘মরণের পারে’ বইটি। এ বই অসম্ভব জনপ্রিয়। এতে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা আছে। লেখকের মতে বইটিতে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ আলোচনা আছে, যদিও বৈজ্ঞানিকরা বইটিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে জানা যায় নি।

অভেদানন্দের মত হল, সচেতন আত্মার প্রাণশক্তি ও মন বলে পদার্থ আছে। তিনি সচেতন আত্মার কথা বলেছেন, তাহলে কি অচেতন আত্মাও আছে? অভেদানন্দ বলেছেন, ‘দেহের ভেতরে দুটি মূল উপাদান আছে : একটি মন, অপরটি প্রাণস্পন্দন অথবা শরীরের কোষ ও পেশিসমূহের স্পন্দিত অবস্থা। এ সকলের স্পন্দন কিন্তু মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, মনই তার স্রষ্টা, নিয়ন্তা।’ বিজ্ঞানে মনের এই ব্যাখ্যা নেই।

এর পরে অভেদানন্দ আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন এইভাবে — ‘মানুষের চৈতন্যময় আত্মা যখন মরণের পরে দেহ ছেড়ে যায়, তখন তার ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়। অত্যন্ত সূক্ষ্ম এক ধরনের যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে মরণের অব্যবহিত পরে দেহকে ওজন করার জন্য। ঠিক মৃত্যুর সময়ে দেহ থেকে একপ্রকার বাষ্পতুল্য পদার্থ নির্গত হয়ে যায় এবং তাকে ওই সূক্ষ্ম যন্ত্রে মাপ করে দেখা গেছে তার ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ।’

হয়তো অভেদানন্দ বলতে চেয়েছেন ডানকান ম্যাকডোউগালের কথা। ১৯০১ সালে ম্যাকডোউগাল আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগের ও পরের মুহূর্তে ৬ জন রোগীর শরীরের ওজন পরীক্ষা করেন তিনি। দেখা যায় ৬ জন রোগীর শরীরের ওজন ২১ গ্রাম কমেছে।

কিন্তু অভেদানন্দকথিত ‘সূক্ষ্ম যন্ত্র’ কে কবে আবিষ্কার করেছিলেন, তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। কোন ক্যামেরায় আত্মার ছবি তোলা যায়, তাও অভেদানন্দ জানান নি। মরণের পরে শরীর থেকে যে ‘বাষ্পতুল্য পদার্থ’ নির্গত হয়, তা অন্য মানুষ কেন দেখতে পায় না, তারও উত্তর অভেদানন্দ দেন নি।

প্ল্যানচেট বা প্রেতবৈঠক

পৃথিবীর বহু মানুষ আত্মায় বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাসীদের সংখ্যা এই একবিংশতি শতকেও আছে। আত্মায় বিশ্বাস থেকে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস জন্মলাভ করে। অষ্টাদশ শতক থেকে অতিলৌকিকে বিশ্বাসীরা আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কথা বলে আসছিলেন। ১৮৫২ সালে ওহিওর ক্লিভল্যাণ্ডে এই বিষয়ে এক বিরাট সম্মেলন হয়। সংবাদপত্রে লেখা হয় এটি এক ধর্মীয় ও সামাজিক বিপ্লব (‘religious and social revolution’)। আন্দোলনটিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেবার চেষ্টাও করা হয়। আমন্ত্রণ জানানো হয় আমেরিকার সেনেটকে।

১৮৫৬ সালে। ফ্রান্সের অ্যালেন কারডেক (আসল নাম এইচ.ও.রিভেইল) তৈরি করলেন এক সংগঠন। যার নাম ‘Revue Spirite’। আত্মাকে নিয়ে কাজ-কারবার করবে এই সংগঠন। কারডেকের দাবি তিনি নাকি আত্মাকে ডেকে আনার উপায় আবিষ্কার করেছেন। লিখে ফেললেন সেই বিখ্যত বই ‘The Book of Spirits’। ১৮৮৩ সাল থেকে শুরু হয়ে প্ল্যানচেট নিয়ে গবেষণা ও তার ব্যবহার। কিন্তু ‘প্ল্যানচেট’ নামটি এল কোথা থেকে? এ নাম এসেছে ফরাসি পরলোকতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এফ.এস. প্ল্যাশেতেঁর নাম থেকে।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে প্ল্যানচেট ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমারিকায় ব্যাপকভাবে ছড়ানোর সমাজতাত্ত্বিক কারণ আছে। আমেরিকা জুড়ে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছিল। এই অবস্থায় মৃত আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই প্ল্যানচেটের প্রচলন বেড়ে যায়।

কাঠ বা তামা দিয়ে তৈরি একটি সাদা বোর্ড ব্যবহার করা হয় প্ল্যানচেটে। এর নাম ওইজা বোর্ড। বোর্ডের দুদিকে ছোট ছোট ক্যাস্টরদানা রাখা হয় যাতে বোর্ডটি চক্রাকারে ঘুরতে পারে। বোর্ডের মাঝখানে একটি ছোট ছিদ্রে রাখা হয় পেন্সিল। সেই পেন্সিলের সুচালো অগ্রভাগ বোর্ডের তলার কাগজকে স্পর্শ করতে পারে। ওই পেন্সিল দিয়ে আত্মার বক্তব্য লিখে যায় মিডিয়াম। পাশ্চাত্যে মিডিয়াম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন দ্যানিয়েল ডানজেলস হোম, ইউসাপিয়া প্যালেনডিনো, এলিন গ্যারেট প্রভৃতিরা।

বাংলার প্রেতবৈঠক

ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের ছয়ের দশক পর্যন্ত বাঙালি মেতে ছিল পরলোক আর প্রেতচর্চায়। এ দেশের তন্ত্রসাধনা, জ্যোতিষবিদ্যা, দর্শন ও সাহিত্য, এবং ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’ পরলোক ও প্রেতচর্চায় মদত দিয়েছে।

বাংলার বহু নামকরা মানুষজন সামিল হতেন প্রেতবৈঠকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেসটি ছিল আত্মা নামানোর বিখ্যাত ঠিকানা। পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দ নিয়মিত বসতেন প্রেতবৈঠকে। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আত্মা না কি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে আলিপুর বোমার মামলার আসামি অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে আদালতে লড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন (‘ইউ মাস্ট ডিফেণ্ড অরবিন্দ’)। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়কে ছত্রপতি শিবাজির আত্মা বলেছিলেন যে ভারত চল্লিশ বছরের মধ্যে স্বাধীন হবে। মৃত পুত্র পরিতোষের আত্মা সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পূর্বে ডাব খাইতে চাহিয়াছিলাম।’ অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় আসা এক ফরাসি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের বাড়ির প্রেতবৈঠকে যেতেন প্যারীচাঁদ মিত্র — যিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়ালিজম’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় না কি কথা বলতেন তাঁর মৃতা স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত বসত প্রেতবৈঠক। রীতিমতো মিডিয়াম নিয়ে বসতেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রথমা পত্নী সোহিনীকে দেখতে পেয়েছিলেন প্রেতবৈঠকে। রবীন্দ্রনাথের আত্মা রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্যকে জানিয়েছিলেন যে পরলোকে তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে, যেখানে তিনি আছেন তার চারপাশে আশ্চর্য সুন্দর সব ফুল আর পাখি, এখানে ভয় পাবার কিছু নেই।

পরলোক ও প্রেতবৈঠক সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি বইএরও সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন : ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত ‘ইহলোক পরলোক’, ১৯০৮ সালে সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ‘প্রেততত্ত্ব’, ১৯২৭ সালে কেশবচন্দ্র সেনের ‘পরলোকের সন্ধানে’, ১৯৩৩ সালে এই. লেড বিডারের ‘অন দ্য আদার সাইড অব ডেথের’ হরিদাস বিদ্যাবিনোদ কৃত বঙ্গানুবাদ, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’, ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘লোকান্তর’, রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্যের ‘মৃত্যুর পরপারে’।

থাকুক আত্মা কিন্তু তাতে আমাদের কাজ নেই

আত্মা থাকুক বা না থাকুক তাতে জীবিত মানুষের কোন কাজ নেই। আত্মা যখন শরীর নয়, বায়বীয় পদার্ধ, তাহলে সে কথা বলতে পারে না, ভাব বিনিময় করতে পারে না, ভালোবাসতে পারে না, ঝগড়া করতে পারে না, আলিঙ্গন করতে পারে না, হাতে হাত মিলাতে পারে না, আমাদের কাজকর্মে অংশ নিতে পারে না। যদি ধরে নিই যে সেই নির্যাতিতা মেয়েটির আত্মা আছে, তাহলে সে কি তার মাকে মা বলে ডেকে উঠতে পারবে? সে কি তার মা-বাপের সন্তান হারানোর দুঃখ পূর্ণ করতে পারবে?

আমার মতো অ-কবি আত্মাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিল। সেটি শোনাবার প্রলোভন ত্যাগ করতে পারলাম না। :

আত্মার ক্ষয় নেই আত্মার লয় নেই অজর অমর

আত্মার দেহ নেই আত্মার মন নেই নেই তার ঘর

শরীরের ভেতরে কি আত্মার বসবাস জানো কি

আত্মার শরীরের টুকটাক সংবাদ রাখো কি

আত্মার ভার নেই আত্মার ধার নেই নিশ্চুপ নির্বাক

গান নেই প্রাণ নেই আত্মার তাই কি সে চুপচাপ

ছোট বড় ভেদটেদ আত্মার আছে কি না কে জানে

আত্মার রাশি গণ আত্মার কুলশীল কে মানে

আত্মার আত্মা কি শেষ কথা না কি কিছু বাকি আর

অবিনাশী আত্মা কি বিনাশের ভয়ে কাঁপে অনিবার

আত্মার আলাপন প্রত্যাশা করে থাকি রাতদিন

আমার দেহের কাছে আছে তার নিশ্চয়ই কোন ঋণ

প্ল্যানচেট করুন কিন্তু সাবধান

প্ল্যানচেট করুন, কিন্তু তার আগে একটা সিনেমা দেখে নিন। ২০১৪ সালের আমেরিকার সেই হরর ফিল্মের নাম ‘ওইজা : অরিজিন অব ইভিলস’। এই সিনেমার পরিচালক মাইক ফ্লানাগান। এতে অভিনয় করেছিলেন এলিজাবেথ রিজার, লুলু উইলসন, অ্যানালিজ বাসো, হেনরি টমাস প্রভৃতিরা। লস অ্যাঞ্জেলসের এক বিধবা নারী প্রেতচক্রের মিডিয়াম হিসেবে কাজ করতেন। সঙ্গে থাকত তাঁর দুই মেয়ে। ১৫ বছরের লীনা আর ৯ বছরের ডোরিস। গল্পের শেষে দেখি এক দুষ্ট আত্মা ভর করেছে লীনার উপরে। মায়ের হত্যা আর বোন ডোরিসের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে সন্দেহ করা হচ্ছে তাকে। লীনাকে রাখা হয়েছে এক মানসিক হাসপাতালে। সে নিজের রক্ত দিয়ে ওইজা বোর্ড তৈরি করে বসেছে প্ল্যানচেটে। আহ্বান করেছে বোন ডোরিসের আত্মাকে। কিন্তু ডোরিসের বদলে সেখানে আবির্ভূত হল এক দুষ্ট আত্মা। পরিণাম কি হবে তাতো জানাই।

আরও একটা সতর্কবাণী

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেতবৈঠকে হাজির হয়েছিল এক অচেনা আত্মা। কি বলেছিল সে? বলেছিল, ‘দেখো, আজ তোমরা প্রেতাত্মা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছ, অনেককে তোমরা শাস্তির ভাগী করিতেছ, যখন তোমাদের মৃত্যু হইবে তখন সেই সব আত্মা তোমাদের উত্যক্ত করিবে, তোমাদের লইয়া ছেঁড়া ছিঁড়ি করিবে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন