বুধবার | ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:৫৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এ আমার এ তোমার পাপ : দিলীপ মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকট — ত্রান সহায়তা ও কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে : তপন মল্লিক চৌধুরী বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সময় হোক বা পরিস্থিতি, প্রণাম সব শিক্ষককেই : প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস

অসিত দাস / ১২০ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কলকাতায় ব্রিটিশের আগে যে আর্মানিরা এসেছিল, তা অনেকেই লিখে গেছেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ব্রিটিশপূর্ব আর্মেনিয়ান উপনিবেশের ধারণা সম্পূর্ণ সত্য না হলেও কলকাতার আর্মেনিয়ান বসতির চিহ্ন অস্বীকার করা যাবে না।

যদিও কলিকাতা-দর্পণের লেখক রাধারমণ মিত্র সেই তত্ত্বকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি ব্রিটিশপূর্ব আর্মেনিয়ান জনবসতির ধারণার তীব্র বিরোধিতা করেছেন।

গতশতকের আটের দশকে সুলেখক জহর সরকার তাঁর কতকগুলি ইংরেজি প্রবন্ধে জোব চার্নকের আগে কলকাতায় আর্মানি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের কথা আমাদের জানিয়েছিলেন। যা পড়ে আমি মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার আর্মানি জনবসতির কথা জেনেছিলাম।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জোব চার্নক যে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন তা প্রমাণিত সত্য। তাঁর আগেই মুঘলদের সঙ্গে এসেছিল এখানে আর্মেনিয়ানরা। গরিব দেশ আর্মেনিয়া। তাই তাদের হয়ে গলা ফাটানোর কেউ নেই। সেখানে মুনাফা নেই। তাই বেশিরভাগ বাঙালি গবেষক নীরব। কলমের কালি খরচ করেন না।

ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতার নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব আমাদের দিয়ে গেছেন। তবে কলকাতার উপর তাঁর সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য হল, কলকাতায় ইংরেজের আগমনের আগে এখানে একটি ছোটখাটো আর্মেনিয়ান উপনিবেশ ছিল। এটির সপক্ষে পরবর্তীকালে অনেক তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের জমিদারিতে আর্মেনীয় বা আর্মানি বণিকেরা এসেছিল মুঘলপ্রশাসনের লেজুড় হয়ে।

তারা প্রথমে কলকাতার উত্তরের ভূখণ্ডে পা রাখে। ব্যবসার পাশাপাশি তারা দোভাষী, মধ্যস্থতাকারী, দূতের কাজ করত। কলকাতার প্রাচীন ইতিহাসে যে তিনটি ঐতিহাসিক দৌত্যের কাজ তারা করেছে, সেগুলি হল, ১৬৮৮তে খোজা ফানুস কালান্দার ও খোজা ইস্রায়েল সরহদের লন্ডনে গিয়ে কোম্পানির বড়কর্তা জোশুয়া চাইল্ডের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য ও কলকাতায় আর্মানিদের ধর্মাচরণ সম্পর্কিত আলোচনা, ১৭১৫য় জন সর্মানের নেতৃত্বে যে দলটি দিল্লিতে গ্র্যান্ড ফর্মান আনতে যায়, তাতে খোজা ইস্রায়েল সরহদের দোভাষী ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্থান পাওয়া আর ১৭৫৭য় নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের আলোচনায় মধ্যস্থ হিসেবে আর্মেনিয়ান ব্যাবসায়ী খোজা পেট্রুস অ্যারাটুনের নির্বাচন।

পরবর্তীকালে কলকাতার তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টে জর্জ অ্যাভিয়েট নামক আর্মানিসাহেব অনুবাদকের কাজ করেছেন বহুবছর ধরে। তিনি বেঁচেছিলেন ৮০ বছর। জন্ম ১৭৯১-এ। কলকাতায় ১৮৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন। জানা দরকার অনুবাদক দু-রকমের। মৌখিক অনুবাদককে বলে Interpreter আর লিখিত বয়ানের অনুবাদককে বলে Translator। জর্জ অ্যাভিয়েট দু-রকম কাজই করেছেন। তাঁর সমাধি আছে বড়বাজারের ব্র্যাবোর্ন রোডের আর্মানি গির্জায় (Holy Nazareth Armenian Church)।

দোভাষীর কথা যখন উঠলই, তখন কলকাতার গড়ে ওঠার প্রাথমিক অবস্থায় একজন দোভাষীর গল্প (?) বলা যাক। সেটা ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ। গার্ডেনরিচে Falcon নামে একটি জাহাজ নোঙর করেছে। জাহাজের ইংরেজ ক্যাপ্টেন স্ট্যাফোর্ড সাহেব পড়েছেন ভারি বেকায়দায়। তিনি এ অঞ্চলের ভাষা একেবারেই বোঝেন না। এই প্রথম কোনও জাহাজ গার্ডেনরিচ পর্যন্ত এসেছে ভাগীরথীর মোহানা দিয়ে। এর আগে সব জাহাজ উড়িষ্যার বালেশ্বর পর্যন্ত এসেছে। তো, সাহেব মাদ্রাজে শুনেছিলেন দোভাষীকে বলে ‘দুবাস’। তাই তিনি সুতানুটির ব্যবসায়ী শেঠ-বসাকদের কাছে খবর পাঠালেন, তাঁর একজন ‘দুবাস’ লাগবে। সপ্তগ্রামের পাট চুকিয়ে হাওড়ার বেতোড়ে কয়েক যুগ কাটিয়ে শেঠ ও বসাকরা তখন সুতানুটিতে হাটের পত্তন করেছেন। তাদের ব্যবসাবুদ্ধি তুখোড় হলে কী হয়, ভাষার মারপ্যাঁচ অতটা বুঝতেন না। দুবাস বলতে তাঁরা বুঝলেন ধোবি বা ধোপা তথা রজক। তাই রতন সরকার নামে এক ধোপাকে সাজিয়েগুছিয়ে হাতে তাঁদের তরফে কিছু উপঢৌকন দিয়ে পাঠালেন গার্ডেনরিচে নোঙর করা ফ্যাকন (Falcon)জাহাজে। শোনা যায় এই দুবাস পেয়ে ইংরেজরা এতটাই আহ্লাদিত হয়েছিল যে তোপধ্বনি করে তাঁকে স্বাগত জানায়। এই রতন সরকারের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল নাকি অসাধারণ। দুয়েকটি ইংরেজি শব্দ ছিল তাঁর ভাঁড়ারে। তা-ই অবলম্বন করে ঠেকে শিখে তিনি ইংরেজি ভাষায় তুখোড় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে তিনি ইংরেজ রাজত্বে কলকাতার অন্যতম ধনী লোক হয়ে ওঠেন। তাঁর নামে জোড়াসাঁকোয় রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিট আর কলুটোলায় রতু সরকার লেন নামে দুটি রাস্তা হয়।

দীর্ঘকাল ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে এই রতন সরকার আসলে জাতে আর্মানি। তাঁর আসল নাম আরাতুন সিরকর (Arathoon Shircore )। লোকমুখে অপভ্রংশে হয়ে গেছে রতন সরকার বা রতু সরকার। আসলে ধোপা নয়, শেঠ-বসাকরা সজ্ঞানেই একজন দোভাষীকে পাঠিয়েছিল। কারণ সুতানুটির ওই অঞ্চলে থাকতো আর্মানি লোকজন। তারা দোভাষীর কাজ করত।

বস্তুত জোব চার্নকের সুতানুটির আহিরীটোলার কাছে রথতলা ঘাটে ১৬৯০ য়ে পদার্পণ করার অন্যতম কারণ সেখানে দোভাষীদের সহজলভ্যতা। আর্মানি দোভাষীরা বাস করত সেখানে। তারা নিজেদের ভাষা ছাড়াও ফারসি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা ভাষায় দক্ষ ছিল।

আহিরীটোলায় ছিল তাদের বাস। প্রচলিত ধারণা আভীর বা আহীর থেকে আহিরীটোলা। আভীর মানে গোয়ালা। কিন্তু আমার মনে হয়, হায়েরীটোলা থেকে এসেছে আহিরীটোলা। আর্মানিরা নিজেদের বলে হায়েরী (Hayeri)। নিজেদের দেশকে বলে হায়াস্তান। একজন আর্মানি ব্যক্তিকে হে (Hay) বলে। হায়েরীটোলা লোকমুখে অপভ্রংশে আহিরীটোলা হয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। আহিরীটোলার কাছেই শোভাবাজার। এই জায়গাটির নাম সুবাবাজার ছিল আগে। সুবা মানে খ্রিস্টান রাজকর্মচারী। যেমন সাহেবসুবা। তাই সুবাবাজারের বাসিন্দা ইংরেজ ছাড়া আর্মানিদেরও বোঝাত। আর্মানিরাও খ্রিস্টান। আর্মেনিয়াই পৃথিবীর প্রথম খ্রিস্টান রাজ্য। ৩০১ খ্রিস্টাব্দে তারা প্রশাসনিকস্তরে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করে।

আর্মানিরা শুধু ব্যবসায়ী ও দোভাষীই ছিল না, তারা ছিল দক্ষ স্থপতি। কলকাতার নামকরা বহু প্রাসাদ ও অট্টালিকা তারা তৈরি করেছিল। নিজাম প্যালেস, স্টিফেন কোর্ট, পার্ক ম্যানসন, কুইন’স ম্যানসন, গ্র্যান্ড হোটেল তাদের তৈরি। অ্যাস্টর, লিটন, কেনিলওয়ার্থ প্রভৃতি হোটেল তাদের দ্বারাই নির্মিত। বড়বাজার ও ট্যাংরার আর্মেনিয়ান চার্চের স্থাপত্যশৈলি দেখার মতো।

আর্মেনিয়ান ঘাট তৈরি করেছিলেন ম্যানভেল হাজারমালিয়া। তিনি জাতিতে আর্মানি। হুজুরিমল নামেও সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন।

জে সি গালসটাউন নামে এক আর্মানি বণিক কলকাতার রেস কোর্সের রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ছিল কয়েক শো রেসের ঘোড়া, কয়েক শো সেযুগের রোলস্ রয়েসতুল্য গাড়ি, বেশ কিছু প্রাসাদোপম বাড়ি।

এবার আসা যাক কলকাতার আদিবাসিন্দা কোন বিদেশী খ্রিস্টান দেশ, সে আলোচনায়। ১৬৯০ এ জোব চার্নকের অনেক আগে সেই ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বুকে আর্মেনীয় বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বড় বাজারের আর্মানি গির্জায় রেজাবিবে নামক এক আর্মানি মহিলার কবর আবিষ্কার করেন মেসরোভ জ্যাকব সেথ নামে এক আর্মানি ঐতিহাসিক। এই রেজাবিবে ছিলেন দানবীর সুকিয়াসের পত্নী। তাঁর কবরের সমাধিফলকে লেখা ছিল,১৬৩০ সালে তিনি প্রয়াত হন।

এই সমাধিফলক নিয়ে তুমুল বিতর্ক তুলেছেন ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ। কেউ বলেছেন ওটি চুঁচুড়ার আর্মেনিয়ান চার্চ থেকে নিয়ে আসা ফলক। এই চুঁচুড়ার আর্মেনিয়ান চার্চ বড়বাজারের আর্মেনিয়ান চার্চের থেকেও পুরনো। বড়বাজারের চার্চ হয়েছিল ১৭২৪ এ। সেখানে চুঁচুড়ার চার্চ হয়েছিল ১৬৯৫-এ। তারও আগে সেখানে ছিল বেরিয়াল গ্রাউন্ড। আবার কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেছেন সমাধিফলকটি গঙ্গার বুক দিয়ে যাওয়ার সময় মারা যাওয়া কোনও আর্মানি মহিলার। এইখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

কলকাতার বুকে তিনটি আর্মেনিয়ান চার্চ, আর্মেনিয়ান স্কুল ও কলেজ, ওল্ড এজ হোম আছে। রাস্তার নাম আছে বিখ্যাত আর্মানিদের নামে। মানিকতলা-বাদুড়বাগানের সুকিয়া স্ট্রিট, বড়বাজারের আর্মেনিয়ান স্ট্রিট, বউবাজারের হুজুরিমল ট্যাঙ্ক লেন (বর্তমানে নাম অন্য), কলুটোলার জ্যাকারিয়া স্ট্রিট (যদিও কেউ কেউ বলেন এটি নাখোদা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার নামে), বড়বাজারের সুকিয়াস লেন। উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা, মধ্য কলকাতার আর্মানিটোলা, দক্ষিণ কলকাতার আর্মানিপাড়া, এইগুলি কলকাতার আর্মানি-অধ্যুষিত অঞ্চল (ছিল বা বর্তমানে আছে)।

কলকাতার বুকে আর্মানিদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন একশোর আশপাশে। ব্রিটিশরাজত্বে তারা আস্তে আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। অনেকে গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হন। খোজা ওয়াজির, মুঙ্গেরের গুর্গিন খান, হুজুরিমল খুন হন। অনেক আর্মেনিয়ান ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছেন।

অনেক আর্মেনিয়ান তথা আর্মানি কলকাতার বাঙালি সমাজে মিশে গেছেন। ঐতিহাসিকের মতে শেঠ, বসাক, বর্ধন, সরকার, পাল ইত্যাদি পদবি আর্মেনীয়দের থেকে এসেছে বাঙালি সমাজে। যদিও এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। আর্মানিরা বাঙালি হিন্দুদের বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিয়ে করে এখানকার সমাজে মিশে গিয়েছিল অনেকে। তারা বাঙালি রান্নার সমঝদার ছিল। পটলের দোলমা তারাই বাঙালিদের শিখিয়েছিল। উত্তর কলকাতার অনেক অলিগলির নামে হরি, হর, হারা নামটি পাওয়া যায়। এগুলি হায়েরি-জাত কিনা বলা শক্ত। আর্মানি নামের বঙ্গীকরণ হওয়া সম্ভব। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছেই সুকিয়া স্ট্রিট। একজন আর্মানিকে বলে ‘হে’। ‘হে-দহ’ থেকে হেদুয়া এসেছিল কিনা ভেবে দেখা যেতেই পারে। কারণ কলকাতার ট্যাঙ্ক বা দীঘি কাটানোর পেছনেও আর্মানি নির্মাণকারীদের ছোঁয়া।

মনে রাখতে হবে আর্মেনীয়ই সরকারিভাবে প্রথম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এই আর্মেনীয়দের বাঙালি ‘আর্মানি’ হিসেবেই চিনে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে আর্মানি গির্জার ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেতেন বলে লিখে গেছেন ‘জীবনস্মৃতি’-তে। আমবাঙালি আর্মেনীয়দের ‘আর্মানি’ বলে ডাকত পুরনো কলকাতায়। কিছু জায়গা ও আশপাশের অঞ্চলের নামে আর্মেনীয় প্রভাব দেখা যায়। হায়েরি-টোলা থেকেই এসেছে আহেরিটোলা বা আহিরিটোলা। যদিও অনেকে আহিরিটোলাকে গোয়ালা(আভীর)-দের জায়গা ভাবেন। আর্মেনীয় ভাষায় ‘সুতানে’ মানে বাজার সমূহ। সুতানে থেকেই হয়তো সুতানুটি বা সুতালুটি। হাওড়া নামের পেছনে সাধারণত হাওড় বা এঁদো জলাজমির কথা বলা হয়। সম্ভবত এটা ছিল আর্মেনীয় তথা হায়েরদের জনপদ। ‘হায়েরা’ থেকেই হাওড়া। এখানে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনীয়দের একটি বিরাট বাগান দেখেছিলেন আলেকজান্দার হ্যামিলটন। তিনি তাঁর ডায়েরিতে তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হাওড়ায় আমতা বলে একটি প্রাচীন জনপদ আছে। আমতা এসেছে আর্মেনীয় ‘আনতা’ থেকে। মানে বন বা বাগান।

কলকাতা-সতানুটি-গোবিন্দপুরের ইতিহাসে বসাক-শেঠদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলাকীর্ণ এই ভূখণ্ডের জঙ্গল কাটানোর মতো শক্ত কাজ বসাক-শেঠরাই করেছিলেন বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। সুতানুটির হাটের পত্তনও হয়েছিল বসাক-শেঠদের হাতে। বসাকদের আদি বাসস্থান ছিল হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে। তাদের সর্বক্ষণের সহচর ছিল শেঠরা।

এইখানে একটি কূটতর্ক তোলা যায়। ইংরেজের আগমনের আগেই কলকাতায় আর্মেনীয় মহল্লার যে কথা বলে গেছেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বা আর্মেনীয় ঐতিহাসিক মেসরোভ জ্যাকব সেথ, তা আমরা সত্যি বলেই ধরে নিতে পারি। অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির মতো ইউরোপ সংলগ্ন আর্মেনিয়া থেকে আর্মেনীয়রা জলপথে আসেনি, এসেছিল স্থলপথে। বঙ্গে যে এরা এসেছিল মুঘল আমলে আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ও রাজস্বমন্ত্রী টোডরমলের সঙ্গে তা এতক্ষণে আমরা জেনে গেছি। এই মানসিংহ আবার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আদিপুরুষ তথা কলকাতার প্রাকপুরুষ লক্ষীকান্ত মজুমদারের ‘উদ্ধারকর্তা’। গুরু কামদেব ব্রহ্মচারীর হারানো পুত্রকে তিনি কালীঘাটের পাশ থেকে উদ্ধার করেন। আর্মেনীয়রা দিল্লির মুঘলদরবারে খুব খাতিরযত্ন পেত। আকবরের রাজসভায় আর্মেনীয় পণ্ডিত যেমন ছিল, আর্মেনীয় উপপত্নীও ছিল। আর্মেনিয়া আদতে অরণ্যময় দেশ, বনজঙ্গলের কাঠই সেখানকার প্রধান জ্বালানি। শীতের সময় ওরা নিজেদের কাঠে তৈরি বাড়ি কার্পেটে মুড়ে দিত আগে। বনজঙ্গল কেটে সাফসুতরো করার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা বা দক্ষতা আছে তাদের। নগরপত্তনের ইতিহাসে বনজঙ্গল কেটে সাফ করার একটি বিরাট ভূমিকা থাকে। বস্তুত সুতানুটি হাট পত্তনের সময় বনজঙ্গল কেটে জায়গাটি পরিষ্কার করার যাবতীয় কৃতিত্ব দেওয়া হয় শেঠ-বসাকদের। (এরা যে আসলে আর্মেনীয় সেথ ও ভাসাক বংশ নয় তা কে বলতে পারে? বাঙালি উচ্চারণে হয়তো ভাসাক হয়ে গেছে বসাক আর সেথ হয়ে গেছে শেঠ)।

আর্মেনীয়দের এই জঙ্গলকাটানো ভাবমূর্তির সপক্ষে প্রমাণও আছে। ‘চৌরঙ্গির জঙ্গল’ সতেরো শতকের শেষভাগেও ছিল কলকাতার এক শিহরন-জাগানো এলাকা। চোরডাকাতের ভয়ে কালীঘাটের তীর্থযাত্রীরা প্রাণ হাতে করে এখান দিয়ে যেত। ক্রমে ক্রমে এই জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে জনবসতি হল। কালের প্রয়োজনে তৈরি হল হোটেল ও সরাইখানা। এগুলির নির্মাণে প্রধান ভূমিকা ছিল আর্মেনীয় পরিবারগুলির। গ্র্যান্ড হোটেলের ভিত্তিস্থাপন করে আর্মেনীয়রা। স্টিফেন কোর্ট, পার্ক স্ট্রিট, নিজাম প্যালেস, পার্ক ম্যানসন, কুইনস ম্যানসন, আর্মেনিয়ান ঘাট, অ্যাস্টর, লিটন, ওল্ড কেনিলওয়ার্থ প্রভৃতি আর্মেনীয়রা তৈরি করে। কলকাতার জঙ্গলমুক্তি ও নগরায়নের পেছনে আর্মেনীয় ভাসাক-সেথ না বাঙালি বসাক-শেঠ পরিবার তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হতে পারে। আর্মেনীয়দের গাছকাটা বা অরণ্যবিনাশপর্ব ওদের নিজের দেশেই বহুলপ্রচারিত। তাদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম্বল ও কার্পেট তৈরির মুনশিয়ানা। বস্তুত ‘কার্পেট’ শব্দটিই এসেছে আর্মেনিয়ান ভাষা থেকে ওল্ড ফ্রেঞ্চ হয়ে। সুতানুটির সুতোর নুটি ও কাটনা-কাটানোর পেছনে স্বাভাবিক তাঁতি বা natural weaver আর্মেনীয়দের ভূমিকা থাকা খুবই সম্ভবপর। তাই বয়নশিল্প বাংলার নিজস্ব শিল্প না আর্মেনীয়দের হাত ধরে এখানে এসেছিল তা গবেষণার ব্যাপার। বাঙালি শেঠ-বসাকরা মূলত ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে তাঁতবিদ্যা বা বয়নশিল্প থাকার সম্ভাবনা কম। মসলিন, ব্লুস্কার্ফ-এর মত সূক্ষ্ণ কর্ম তাদের নিজেদের পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে কাটনাকাটানো মহিলাদের দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নিতেন বলে অনেকের বিশ্বাস। অপরপক্ষে আর্মেনীয়রা যেহেতু স্বাভাবিক তাঁতী, তাদের পক্ষে এই সূক্ষ্ণ কারুকার্যময় নকশা করা সম্ভব। ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী বাংলার আর্মানি তাঁত ও কাপড় ব্যবসায়ীদের কথা তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আর্মেনীয় ভাসাক-সেথরাই কালক্রমে বসাক-শেঠ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। তবে পুরোটাই সম্ভাবনার কথা। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা আসলে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আমলেই।

জহর সরকারই চল্লিশ বছর আগে কলকাতার আর্মেনিয়ান কানেকশনের কথা আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও কলকাতার বিভিন্ন স্থাননামে আর্মেনিয়ান প্রভাবের কথা তিনি লিখে যাননি।

তাঁর লেখাগুলি পড়ে আমি কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে করতে এগুলি হাইপোথিসিস হিসেবে লিখেছিলাম ২০১৪-১৫ সাল নাগাদ।

২০০৯ এর ১৫ সেপ্টেম্বর ভারতে আর্মেনিয়ার রাষ্ট্রদূত আরা হ্যাকোবিয়ান কলকাতার বড়বাজারের হোলি ন্যাজারেথ আর্মেনিয়ান চার্চের এক অনুষ্ঠানে এসে কলকাতার ব্রিটিশপূর্ব আর্মেনিয়ান জনবসতির কথা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। তিনি আর্মেনিয়ান কলেজের একটি নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করেন।

২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১২ নভেম্বর ভারতে আসেন আর্মেনিয়ার বিদেশমন্ত্রী এডওয়ার্ড ন্যালব্যান্ডিয়ান। তিনিও আর্মেনিয়ান স্কুল ও কলেজের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে বড়বাজারের হোলি ন্যাজারেথ আর্মেনিয়ান চার্চে গিয়েছিলেন। ১৬৩০-এর রেজাবিবের সমাধিফলক দেখে তিনিও চমৎকৃত হয়েছিলেন। ইংরেজের আগে যে আর্মেনিয়ানরাই কলকাতায় পদার্পণ করেছিল, তিনিও সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন