[কেয়া চলে যাওয়ার পর আমি ঠিক করেছিলুম কেয়া সম্পর্কে একট ছোট বই লিখব। আমার সঙ্গে কেয়ার পরিচয়, ওর নিষ্ঠা, থিয়েটার নিয়ে ওর চিন্তাভাবনা – সব তার অন্তর্গত হবে ইতিমধ্যে এই বইটি বেরোতে চলেছে। আমার বর্তমান লেখাটি সকলের লেখার সঙ্গে যাবার জন্যে দিয়ে দিলাম এটি ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ লেখা টির একটি প্রাথমিক অংশমাত্র।— অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়]
যে দু-চারজন আমার খুব বন্ধু, দীপেন সেনগুপ্ত, তাদের অন্যতম আমি দীপেনবাবুর সঙ্গে মণীন্দ্র কলেজে বি. এ. পড়েছি। তখন পাশ করে দমদমে এয়ারপোর্টের কাছে একটা ইস্কুলে হেডমাষ্টারী করি, থাকি পাতিপুকুরে, সময়টা হবে ইংরেজী ১৯৫৮। বাগবাজারে নন্দ বোসের বাড়ীতে ‘প্রস্তাব’ নামে একটা হাসির একাঙ্কিকা হবে। কলেজে পড়তে লিখেছিলুম আমি। দীপেনবাবু পাতিপুকুরে আমার কাছে এসে বললেন, ‘চলুন, অভিনয় করে দেবেন, একটা দারুণ মেয়ে পেয়েছি, স্কটিশ চার্চ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, নাম কেয়া।’
‘কী করে পেলেন ?’
‘খোকনের সূত্রে ’
খোকন অর্থাৎ রুদ্রপ্রসাদ, আমাদের সমসাময়িক, মণীন্দ্র থেকে আই. এসসি. পাশ করে স্কটিশ চার্চে বি. এ. পড়তে গেছে।
আর একটা ঘটনা মনে পড়ে। দীপেনবাবুর বন্ধু হিসেবে গেছি ইউনিভার্সিটিতে, ছাত্ররা নাটক করছিলেন মহাজাতি সদনে, নাটকের নাম ‘থানা থেকে আসছি’, তারই রিহার্সাল। দীপেনবাবু আমাকে বললেন, ‘দাঁড়ান আপনার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দি’। আমি যেমন বাইরে থেকে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম, কেয়াও তাই। তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ে, এমনি বন্ধুদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলো রিহার্সাল দেখতে। যে দুটি ঘটনা বললাম এর কোনটা আগে কোনটা পরে এখন আমার ঠিক মনে নেই।
তিন পয়সার পালায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী, সেমন্তিনী দাস
‘প্রস্তাব’ নাটকের রিহার্সালে কেয়া বসেছিলো বেশ জড়োসড়ো হয়ে, ভীতুর মত। পরে শুনেছিলাম, দীপেনবাবু কেয়াকে ভয় দেখিয়ে রেখেছিলেন যেন ও রিহার্সালের সময় আমার সামনে কোন বাচালতা না করে, না হাসে। আমি নিজেও মফঃস্বলীয় লোক, মেয়েদের সম্বন্ধে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না। দু-তিনদিন রিহার্সাল হোলো, তারপর নাটক শেষ, কেয়ার সঙ্গে সম্পর্কও সাময়িক ভাবে শেষ।
এর পরে আমরা করেছিলাম ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ ঠিক কোন বছর কত তারিখে হয়েছিলো আমার মনে নেই। নীলমণি মিত্র স্ট্রীটে একটা ঘরে আমাদের রিহার্সাল হতো। বনয়ারীলালের সঙ্গে মেয়েটির দৃশ্য বোঝাতে গিয়ে পড়েছিলুম মুস্কিলে। জায়গাটি কী, ওখানে কী হয়, মা গিয়ে কী দেখতে পেলো, মা কী ভাবলো, শুনে কেয়া হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো সে একেবারে চিৎকার করে একটানা কান্না। পরিচালক হিসেবে আমার এতটা কান্নার দরকার ছিলো না, সদস্য হিসেবে তো নয়ই, ঘোর অপ্রস্তুত হলুম। প্রথম অভিনয়ের পরেই কেয়া চলে গেল, পড়াশুনো করতে হবে, ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি. এ পড়ছে স্কটিশে, ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে ইত্যাদি।
কেয়া চলে গেল। বছর চার-পাঁচ বাদে এম. এ. পাশ করে দমদমে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে মাষ্টারী করে ও সবে তখন স্কটিশ চার্চ কলেজেই অধ্যাপনা করতে ঢুকেছে। এই রকম সময় নাগাদ আমার কাছে এলো, বললো, ‘সিরিয়াসলি থিয়েটার করবো।
উনিশ-শ-সাতষট্টি সালে আমরা প্রথমবার দিল্লীতে অভিনয় করতে গেলুম। ‘নাট্যকারের সন্ধানে’র দুটি এবং ‘শের আফগান’ নাটকের তিনটি অভিনয় হয়েছিলো। কেয়া গিয়েছিলো এবং অভিনয় করেছিলো। উনিশ-শ-আটষট্টির শেষের দিকে আমরা গিয়েছিলুম বম্বে, ‘নাট্যকারের সন্ধানে’ নাটক হয়েছিল কেয়া অভিনয় করেছিলো।
উনিশ-শ-উনসত্তর সালে ১৪ ডিসেম্বর ‘তিন পয়সার পালা’র প্রথম অভিনয় হয় নিউ এম্পায়ারে। দলের সবার মত কেয়াও নিষ্ঠার সঙ্গে নাচগান অভিনয় শিখেছিলো। তখন মনটা খুব ঠাণ্ডা ছিলো না কেয়ার। তখন সাংগঠনিক কোন দায়িত্ব ছিল না ওর ওপর। উনিশ-শ-সত্তর সালে আমরা দ্বিতীয় বার বম্বে গেলাম, ফিরলাম ভিলাই হয়ে। উনিশ-শ-সত্তরের অকটোবর মাসে আমরা ‘রঙ্গনা’ নিলাম।
‘রঙ্গনা’ নেবার কিছুদিন পরেই কেয়া অভিনয় ছাড়াও অন্য কাজে উৎসাহ বোধ করলো, যেমন পাবলিসিটি। যেটা করত সেটাতে একেবারে নিমগ্ন হয়ে যাওয়া ওর চরিত্রে ছিলো। নানা রকম প্ল্যান প্রোগ্রাম ভাবত, কাজে লাগাতো, নিজের গয়না বন্ধক দিতো, অবলীলায় ধার চাইতে পারতো। তা ছাড়া কেয়ার ঝোঁক এলো থিয়েটারের পোষাকপত্রের দিকে। জামাকাপড়ের রং, কাটিং, তার ব্যবহার নিয়ে মেতে উঠলো কিছুদিন। কিছুদিন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে লাইট পার্চে যাতায়াত সুরু করলো। অতিথিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা এবং কথা বলার দায়িত্বেরও খানিকটা ভার এসে পড়লো ওর ওপর।
তিন পয়সার পালায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী
আসলে আমার যেটা মনে হয়, এসব কাজের পরেও আরো অনেকটা এনার্জি থেকে যেতো ওর অনেক ভেবেচিন্তে শেষে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপিকার চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিলো কেবল রেডিও, থিয়েটার, সিনেমা, টেলিভিশন নিয়ে থাকবে। কিন্তু ওর পারিপার্শ্বিকে বহুজনেরই এসব ভালো লাগতো না। অধ্যাপিকার চাকরি ছেড়ে থিয়েটারের অভিনেত্রী, কিসে আর কিসে! সংসারে মন স্থির না রেখে বাইরের কাজ নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ঘোরাফেরা? কিন্তু কেয়া এসব নিয়ে খুব একটা বিব্রত থাকতো না। মাকে খুব ভালবাসতো, মা যা বলবে তাই হবে, এই ধরনের ব্যাপার ছিল একটা।
তর্ক হতো ওর সবার সঙ্গে। তুমুল তর্ক, রাগারাগি, কষ্ট পাওয়া। সর্বদাই ওর মধ্যে একটা অনুভব ছিলো, যা-কিছু-করার বড় দেরী হয়ে গেছে। অন্যেরা যা দশ বছরে করে, আমাকে তা এক বছরে করতে হবে।
তর্ক না করে কোনো জিনিষ মেনে নেওয়ার রেওয়াজই ছিলো না ওর। তৃপ্তি মিত্র ভালো অভিনয় করেন, – – কেন? অমুককে যে অমুক উপাধি দেওয়া হয়েছে –সত্যি কি উনি ভাল অভিনয় করেন? কেন? এই বইটা কি ভালো? টলস্টয়ের রেজারেকশনের থেকেও ভালো? কেন?? উনি কি বড় লেখক ? চিন্তাগুলো স্পষ্ট? রাসেলের থেকেও?
কেয়ার সম্পর্কে সব কথা বলার সময় এখনও হয়নি। আজকের এই লেখাটাই যদি তিন বছর আগে লিখতুম এমন করে লিখতে পারতুম না। আরও অনেক বছর হয়ে গেলে কেয়ার গল্প গুলোকে আরো দূর থেকে যখন পাবো তখন প্রবন্ধ লিখে কেয়াকে চেনানো অনেক বেশী সহজ হবে। আমাদের চার পাশে এখনও অনেকে আছেন যারা কেয়াকে একটু দুর্জ্ঞেয়, একটু রহস্যময়, একটু জটিল দেখতে ভালোবাসেন। আমার কেয়াকে কখনোই সেরকম মনে হয়নি। কেয়া বেঁচে থাকলে বেশ হতো, অনেক বড় হতো, বিকশিত হতো, অনেককে আশ্রয় দিতে পারতো।
ঋণ স্বীকার : চিত্তরঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত কেয়ার বই (১৯৮১)
অভিনয় এবং লেখালেখি ছাড়াও কেয়া চক্রবর্তী ১৯৬৪ সালে দমদম ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ইংরাজী শিক্ষিকা ছিলেন এবং ১৯৬৫-১৯৭৪ সাল অবধি স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরাজী বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।