১২ বছর পর আবার শোলার মালা হাতে অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব। ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজনের ভিড়। হাজার হাজার মানুষের বন্ধুত্বের মেলবন্ধনে মুখর তিনটি গ্ৰাম। ১৯ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল আরামবাগের উত্তর বাদলকোনা, দক্ষিণ বাদলকোনা ও নির্ভয়পুর গ্ৰামে শুরু হয়েছে সই ও স্যাঙাত পাঠানোর প্রাচীন পর্ব। এক কথায় সয়েলা উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে মনসা পূজা, বাউল গান ও যাত্রাপালা শুরু হয়েছে। মূল লক্ষ্য একটাই অচেনা অজানার সঙ্গে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্ব পাতানোর সুযোগ। যা চিরকাল বন্ধুত্বের বন্ধনে অটুট থাকবে। এই প্রথা আজও চলে আসছে। তবে ১২ বছর অন্তর এই উৎসবকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় থাকেন।
প্রসঙ্গত, সয়লা উৎসব বা সই স্যাঙাত উৎসব হল একটি সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। এই উৎসবে মেয়েরা “সই” (সখী) এবং ছেলেরা “স্যাঙাত” হিসাবে বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি করে। এই উৎসব আরামবাগ ছাড়াও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম এবং ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন গ্রামে ‘অনুষ্ঠিত হয়। বন্ধু পাঠানোর মূল মন্ত্র হল — ‘কথা দিলাম সুখে-দুঃখে পাশে থাকব’।
প্রায় ২৫০ বছর পরেও অম্লান আরামবাগের বন্ধু পাতানোর এই উৎসব। নিজের পছন্দমতো বন্ধু খুঁজে তাঁর সঙ্গে সই পাতান গ্রামের আট থেকে আশি। পছন্দের সাথী’র গলায় মালা পরিয়ে ডালা বদল করে লোকায়ত মন্ত্রের মাধ্যমে সারা জীবন একে অপরের পাশে থাকার শপথ নেন তাঁরা।
উল্লেখ্য, আরামবাগের তিনটি গ্ৰামে স্থানীয়েরা একে বলেন ‘সয়লা উৎসব’। যে উৎসবে একে অপরের গলায় মালা পরিয়ে সই পাতিয়ে শপথ নেন দু’জন মানুষ। হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি দেন সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে, সব সময়ে একে অপরের পাশে থাকার। এখানে ১২ বছর অন্তর সয়লা উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রস্তুতি শুরু হয় এক মাস আগে। এক মাস ধরে গ্রামের সমস্ত মন্দিরে গিয়ে পান-সুপুরি দিয়ে দেবদেবীকে আমন্ত্রণ জানান গ্রামবাসীরা। সয়লা উৎসবের দিন শোভাযাত্রা করে গ্রামের সমস্ত দেবদেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় সয়লার মাঠে। সেখানে পুজোআচ্চার পর শুরু হয় বন্ধুত্ব পাতানোর উৎসব। নিজের পছন্দমতো বন্ধু খুঁজে তাঁর সঙ্গে সই পাতানো হয়। ‘পছন্দের সাথী’র গলায় মালা পরিয়ে ডালা বদল করে বিশেষ লোকায়ত মন্ত্রের সাহায্যে সারা জীবন একে অপরের পাশে থাকার শপথ নেন তাঁরা। শনিবার সয়লার মাঠে আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হল সেই উৎসব। দিনভর সই পাতানোর সেই উৎসব চলল। এখানকার বাসিন্দা জয়দেব সোম, রিক্তা পাল বলেন, “এই উৎসব আমাদের এলাকার প্রতিটি গামের কাছে গর্বের। আমরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করি।” আরও বলেন, “এই উৎসব এলেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পুরুষেরা পুরুষ বন্ধু এবং মহিলারা মহিলা বন্ধু খুঁজে সই পাতান। সেই সই সারা জীবন একে অপরের পাশে থাকার শপথ নেন। অনেকে পুরনো বন্ধুকেই সই পাতিয়ে ঝালিয়ে নেন বন্ধুত্ব।”
“উপরে খই, নিচে দই তুমি আমার জন্মের সই”। এভাবেই মুখরিত হল উৎসব প্রাঙ্গন। প্রতিবারের মতো এবারেও ‘সহেলা’ (সয়লা) মেলা বসেছে।
প্রসঙ্গত, মনসা পূজার মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট করার উৎসব এই ‘সহেলী’ বা ‘সহেলা’ বা চলতি কথায় ‘সয়লা’। এই “সই পাতানি” একসময় বাংলার অন্যতম সুন্দর উৎসব ছিল। শুধু মেয়েতে-মেয়েতে নয়, পুরুষে পুরুষেও সখ্য (স্যাঙাত) পাতানো হত। তাতে পরস্পরের সুখে দুঃখে আজীবন ভাগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হত। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া’য় থাকা ‘ফ্রেন্ড’-এর চেয়ে এ বন্ধুত্বের আয়ু অনেকগুণ বেশি। তাই সয়েলা উৎসব আজও আরামবাগে অটুট।