বৃহস্পতিবার | ১০ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৪৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
মা দুর্গার মহাস্নান পর্ব : রিঙ্কি সামন্ত কোষ্টিয়া গ্রামের শীট বাড়ির দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী অয়দিপাউস : রিমি মুৎসুদ্দি পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা : হরিশংকর জলদাস সাজসজ্জার পুজো : নন্দিনী অধিকারী আঠেরো শতকে কলকাতার ভেড়া যেত অস্ট্রেলিয়ায় : অসিত দাস জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (অষ্টম পর্ব) : বিজয়া দেব হরিয়ানায় হ্যাট্রিক করলেও উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ে গান্ধী জয়ন্তী : দীপাঞ্জন দে পটের পাড়ায় মাজরামুড়ায় : রঞ্জন সেন একটি ড্যান্স হাঙ্গামা : শৈলেন সরকার গুণের রাজা পানিফল, দুর্গা পুজোর নৈবেদ্যে অপরিহার্য : রিঙ্কি সামন্ত স্কুল পালিয়ে কী রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়? : সাইফুর রহমান পুজোয় বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় পরিষেবার মান উন্নত করতে বিদ্যুৎ দপ্তরের তৎপরতা তুঙ্গে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় গানের ভিতর দিয়ে দেখা পুজোর ভুবনখানি : সন্দীপন বিশ্বাস নবদুর্গা নবরাত্রি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সাদা কালোয় কুমোরটুলি : বিজয় চৌধুরী জেল খাটাদের পুজো, মাইক আসছে মাইক, ছুটছে গ্রাম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীর নির্বাচনে বিপুল সাড়ার নেপথ্যে কি ৩৭০ বিলোপের জবাব : তপন মল্লিক চৌধুরী তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ মন্ত্র, মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ সুকুমার রায় মানেই শৈশব ও কৈশোর : রিঙ্কি সামন্ত অমৃতা প্রীতম-এর অনুবাদ গল্প ‘বুনোফুল’ মিল অমিলের মানিক ও মার্কেজ : রাজু আলাউদ্দিন কলকাতা ছিল একসময় ভেড়াদের শহর : অসিত দাস নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ : বিজয়া দেব তোলা বন্দ্যো মা : নন্দিনী অধিকারী বাংলার নবজাগরণ ও মুসলমান সমাজ : দেবাশিস শেঠ সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাষষ্ঠীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা : হরিশংকর জলদাস

হরিশংকর জলদাস / ২৫ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪

তিতাস একটি নদীর নাম—উচ্চারণ করলেই অদ্বৈত মল্লবর্মণের নাম অনায়াসে মনে আসে। অদ্বৈত কালজয়ী কিন্তু ক্ষীণজীবী (১.১.১৯১৪—১৬.৪.১৯৫১)। ৩৭ বছর ৩ মাস ১৫ দিনের জীবনে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছাড়াও অদ্বৈত লিখেছেন ‘জীবনতৃষ্ণা’ (lrving Stone-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘Lust for life’-এর অনুবাদ), রিপোর্টাজ ধরনের লেখা ‘ভারতের চিঠি পার্ল বাককে’ এবং ‘রাঙামাটি’ ও ‘শাদা হাওয়া’ নামক দুটো উপন্যাস। ৮-১০টি কবিতা, ২৪টির মতো প্রবন্ধ—নিবন্ধও রচনা করেছেন অদ্বৈত। মানবজীবনের প্রণয়-পরিহাস, বেদনা-বক্রোক্তি ধারণ করে থাকে যে ছোটগল্প, সে রকম ৪টি ছোটগল্পেরও স্রষ্টা অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তবে বিভিন্ন সূত্রে এটা জানা যায় যে, অদ্বৈত আরও কিছু ছোটগল্প লিখেছিলেন। কালের গর্ভে সেগুলো হয়তো হারিয়ে গেছে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্পগুলো হলো—’সন্তানিকা’, ‘কান্না’, ‘বন্দীবিহঙ্গ’ ও ‘স্পর্শদোষ’।

এই চারটি গল্পে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মানবজীবনের কিছু অনুভূতিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করবার প্রয়াস পেয়েছেন। চারটি গল্পের স্থানিক পটভূমি ভিন্ন। ‘সন্তানিকা’র পটভূমি কোনো এক মফস্বল। ‘কান্না’ গল্পটি তৈরি হয়েছে তিতাস-তীরের গোকর্ণঘাট-নবীনগর অঞ্চলকে ঘিরে। ‘বন্দীবিহঙ্গ’র নির্মিতি কলকাতা ও দূরবর্তী কোনো এক গ্রামের পটভূমিকায়। আর কলকাতার ফুটপাত ‘স্পর্শদোষে’র আরম্ভ ও পরিণতিস্থান। কলকাতা, কুমিল্লা, গোকর্ণঘাট—এই তিনটি অঞ্চলই তাঁর গল্পের স্থানিক পটভূমি হয়েছে।

ঘটনা ও চরিত্রের সমন্বিত সংস্থাপনে ছোটগল্প বিপন্নতা থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু কোনো কোনো ছোটগল্পে কাহিনিকে গৌণ করে চরিত্র মুখ্য হয়ে ওঠে। তখন ছোটগল্প চরিত্রনির্ভর হয়ে পড়ে। অদ্বৈতের ছোটগল্পে কাহিনির চেয়ে চরিত্রের প্রাধান্য বেশি। বিচিত্র সর্পিল ঘটনাসংস্থান ও বৈপরীত্যের সমন্বয় ঘটিয়ে অদ্বৈত তাঁর ছোটগল্পে চরিত্রের সার নিষ্কাশিত করেছেন। উল্লিখিত চারটি গল্পে চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অদ্বৈত মানবীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মেদহীন ভাষাভঙ্গি ও নির্লিপ্ত ঔদাসীন্য—এ দুটোকে মূলধন করে তিনি নিম্নবিত্ত জীবনের মৌলিক অনুভূতিগুলোতে চকিত-গভীর অন্তর্দৃষ্টির আলো ফেলেছেন। তাঁর ভাষা ইঙ্গিতপূর্ণ।

দুই.

‘সন্তানিকা’ কোনো এক মফস্বলের গল্প। এ গল্পে অবিশ্বাস ও ভালোবাসাহীনতার মতো শহুরেপনা নেই। আবার গ্রাম্য সরলতা এবং গ্রাম্যতারও অনুপস্থিতি এ গল্পে। শহর ও গ্রামের সেতু হিসেবে গিন্নিমা এ গল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করছেন। ‘সন্তানিকা’ গল্পের মুখ্য চরিত্র ধনঞ্জয় ঘোষাল; মুখ্য উপাদান বুভুক্ষা—খাদ্যবুভুক্ষা আর স্নেহবুভুক্ষা। ধনঞ্জয়ের দু-ধরনের ক্ষুধাকে (একটা দেহজাত আর একটা অন্তরজাত) অবলম্বন করে এ গল্পের পরিকাঠামো নির্মিত হয়েছে।

ধনঞ্জয় ঘোষাল বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ এবং অসহায়। আত্মীয়-পরিজন সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু তার পিছু ছাড়েনি Hunger, এই Hunger দ্বারা তাড়িত একজন বৃদ্ধের জীবনকাহিনিকে ধারণ করে আছে ‘সন্তানিকা’। যাযাবর, আশ্রয়সন্ধানী ধনঞ্জয় উচ্চ প্রাইমারি স্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টার রূপে পরিচয় দিয়ে বীরেশ্বরবাবুর বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে অযোগ্যতার বহু প্রমাণ রাখে। নরেশ এবং তার ভাইবোনদের পড়াতে বসে সে কেবল নিজের ব্যর্থজীবনের গল্প বলে, সে-কালের গুরুমশায়ের অত্যাচারের গল্প বলে। ফলে পড়ুয়াদের আসল পড়াশোনা হয় না। পরীক্ষায় তাদের অকৃতকার্যতায় বীরেশ্বর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ধনঞ্জয়কে শেষকথা শোনায়—’তোমাকে ত এতদিন রেখেছি মাস্টার, এখন আমি ছেলের জন্য অন্য মাস্টার নিযুক্ত করতে চাই। তুমি এখন অন্যত্র চেষ্টা করে দেখ।’ গিন্নিমার অবহেলাও প্রবল হয়ে ওঠে। ধনঞ্জয়ের ‘গিন্নিমা’ সম্বোধনের জবাবে ‘গিন্নিমা চোখ তুলিয়াই মুখ অন্যদিকে ফিরাইয়া চলিয়া যান।’ ফলে ধনঞ্জয় ‘বহু দিনের সেই জীর্ণ পুঁটুলিটা আবার কক্ষে তুলিয়া লয়।’ অবাধ্য প্রবল ক্ষুধাকে সঙ্গী করে সজল চোখে সে ‘বাহির হয়ে পড়ে পথের মাঝে, নিরুদ্দেশের পানে।’ বীরেশ্বরের বাড়ি থেকে অনতিদূরে খোলা মাঠের প্রান্তের পুরোনো বটগাছটির নিচে সে আশ্রয় নেয়। ক্ষুধায় এবং ভাবনায় সে জরজর হতে থাকে। এই বিপুল পৃথিবীর কোথাও তার মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। নিরুপায় হয়ে, শেষ পর্যন্ত ব্যথাক্লিষ্ট সর্বহারা মানুষটি পুনরায় গিন্নিমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘৃণা ও ক্রোধকে আবৃত করে গিন্নিমার মুখে চিরন্তন মাতৃমূর্তির অজস্র স্নেহ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ধনঞ্জয় গিন্নিমার স্নেহছায়ায় আবার আশ্রয় পেয়ে যায়।

‘সন্তানিকা’ গল্পের প্রধান চরিত্র তিনটি—ধনঞ্জয়, বীরেশ্বর এবং গিন্নীমা; আশ্রয়প্রার্থী, আশ্রয়দাতা এবং মাতৃস্নেহে আবিষ্ট এক শ্বাশত নারী। ঘটনার টানাপড়েন ধনঞ্জয় এবং বীরেশ্বরের মধ্যে। তবে গল্পটি শুধু ধনঞ্জয়—বীরেশ্বরকে নিয়েই লেখা নয়। ‘সন্তানিকা’ গল্পের একেবারে মূলভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে নারীর সন্তান-বাত্সল্যের ব্যাপারটি।

আর্থসামাজিক বৈষম্য ‘সন্তানিকা’ গল্পের পশ্চাদ্ভূমি তৈরি করেছে। ধনঞ্জয় ব্রাহ্মণ, বীরেশ্বরবাবুও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, উভয়েই কুলীন বংশজাত। তবুও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। এই গল্পে জটিলতা সৃষ্টিতে অকৌলীন্য-কৌলীন্য অপেক্ষা আর্থসামাজিক বৈষম্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ধনঞ্জয় কুলীন কিন্তু দরিদ্র, তাই সে আশ্রিত; বীরেশ্বরও কুলীন কিন্তু অর্থবান; অর্থশালী বলেই সে ত্রাতার ভূমিকা পেয়েছে।

ধনঞ্জয় ক্ষুধা দ্বারা তাড়িত, কিন্তু এই ক্ষুধা জৈবিক যতটা, তার চেয়ে বেশি মানবিক। অদ্বৈত এই বিষয়টিকেই তাঁর গল্পে প্রধানভাবে তুলে ধরেছেন। ক্ষুধা দ্বারা তাড়িত এক বৃদ্ধের মধ্যে স্নেহ-লোলুপতার স্বরূপকে স্পষ্ট করে তোলার মধ্যেই অদ্বৈতের গল্প নির্মাণের মুনশিয়ানা।

তিন.

‘কান্না’ গল্পের পটভূমি গ্রাম। গোকর্ণঘাটে এ গল্পের বিস্তার ও পরিণতি। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র—গুরুদয়াল। দূরসম্পর্কীয় এক পিসি ছাড়া সংসারে তার আর কেউ নেই। বউ ছিল, মারা গেছে। বিবাগী মন তার, বৈরাগী আচরণ। কথায় কথায় গান ধরে—’রাধে রাধে গো রাধে, তোর লাগি মোর পরাণ কাঁদে।’ এখানে-ওখানে গুরুদয়াল ঘুরে বেড়ায়। একদিন গুরুদয়াল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। দিন যায়, মাস যায়; পিসিমার প্রবল শোক অন্তরিত হয়; ‘পলাতকের সম্বন্ধে পাড়ার আলোচনাও ঠাণ্ডা’ হয়। এমন সময় গুরুদয়াল একদিন বাড়ি ফিরে, বেশ-ভূষায় তার বিরাট পরিবর্তন—’মেয়ে মানুষের চুলের মতো বড় বড় চুলগুলি তার কাঁধে ও পিঠে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। দাড়ি গোঁফ বেশ করিয়া কামানো।’ গুরুদয়ালই একদিন ঠিক করল—সে আবার বিয়ে করবে। লম্বা চুল কেটে, ধোপ-দুরস্ত কাপড়চোপড় পড়ে, এক-আধটু গন্ধদ্রব্য মেখে সে নিজেকে বরের উপযুক্ত করে তুলল। বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, গুরুদয়াল ততই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হলো না। ‘একদিন কন্যা-কর্তার নিকট হইতে পত্র আসিল, তিনি তাহার কন্যাকে অন্যত্র বিবাহ দিবেন স্থির করিয়াছেন।’ ভারী মন নিয়ে জামা-কাপড় বেঁধেছেঁদে গুরুদয়াল গৃহত্যাগ করল। হিতৈষীরা মর্মাহত হলো। কিন্তু মানুষের মন বড়ই বিচিত্র, সর্পিল গতিতে তার অগ্রগমন। দু-মাস যেতে না যেতে গুরুদয়াল সঙ্গে বউ নিয়ে গ্রামে ফিরে এল। বিশ্রী বউ। গুরুদয়াল বউকে মোটেই ভালোবাসে না, বউয়ের প্রসঙ্গ উঠলে ক্ষুব্ধ আচরণ করে। কারণে-অকারণে বউকে ঠেঙায়। অসহায়, বাপ-মা-মরা স্নেহের কাঙাল মেয়েটি গুরুদয়ালের সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে। অন্তর তার নীরক্ত হয়ে গেলেও মুখে সে রা করে না। গল্পটি এ পর্যন্ত সরলরৈখিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। গল্পটির শরীরে মুনশিয়ানার মোচড় লাগে তখনই, যখন গুরুদয়ালের সাথে লঞ্চে ‘যাহার সহিত পূর্বে তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল সেই তরুণী’ আহ্লাদীর হঠাত্ সাক্ষাত্ হয়। আহ্লাদীর কোমল গা-ঘেঁষা ব্যবহারই গুরুদয়ালের শরীরে আগুনের হলকা লাগায়। সে আগুন কামনা ও কামের। গুরুদয়ালের জৈবিক চেতনার অগ্নি সর্বভুক হয়ে উঠল। আহ্লাদীর সাথে বিয়ে হচ্ছিল অন্য এক পুরুষের, আহ্লাদীর চোখে সে ‘বুড়ো’। বিয়ের আসর থেকে তাকে নিয়ে পালিয়ে আসার জন্যে আহ্লাদী গুরুদয়ালকে প্রলুব্ধ করল। আহ্লাদীর বিয়ের দিন গুরুদয়াল প্রস্তুত। কিন্তু বিকেলে বিশ্রী বৌটির ম্লান মুখ দেখে তার যেন কী হয়ে গেল। ‘একখানা কলমুখর অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত মুখ’ আর ‘নির্বাক শ্রীহীন বেদনাময় মলিন মুখ’—দুটোই গুরুদয়ালের চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার হূদয়ে বিশ্রী বৌটির জন্যে সহানুভূতির তরঙ্গ জেগে উঠল। সে বিয়ের আসরে যাওয়া থেকে বিরত হলো। এখানেই গল্পটির মধ্যে এক অপূর্ব মানবিকতার সঞ্চার হয়ে যায়। বিশ্রী বৌটি মারা যায় একদিন। গুরুদয়ালের বাহ্যিক সত্তা মৃতদেহের পাশে বসে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। ঠিক তখনই তার অন্তর্সত্তার উচ্চারণ অন্যরকম, বিস্ময় উদ্রেককারী। গল্পের শেষাংশে লেখক-পাঠকদের কাছে গুরুদয়ালের মানসচিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন—’যদি এমন একটি দর্পণ থাকিত যাহা দ্বারা তাহার মনের ভিতরটা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো দেখা যায়, তবে প্রত্যেকেই বুঝিতে পারিত, গুরুদয়াল আঁখির জলে ভিজিয়া ভিজিয়া যেন বলিতে থাকে—মরিলে তো কিন্তু আর কটা দিন আগে কেন মরিলে না?’

আধুনিক নগরজীবনের দাম্পত্য ট্রাজেডিই অদ্বৈতের ‘কান্না’ গল্পে অবয়ব পেয়েছে। জায়া-পতিতে ঘর করে কিন্তু প্রত্যেকের অন্তরে বাদামের মতো অতৃপ্তির ফাটল। গুরুদয়াল বিশ্রী বৌকে নিয়ে ঘর করেছে কিন্তু তার মন ব্যাপ্ত থেকেছে রূপ ও যৌবনের আরাধনায়। ধনঞ্জয়ের বুভুক্ষা মানবিক, গুরুদয়ালের বুভুক্ষা জৈবিক। ‘গুরুদয়ালের আত্মনিগ্রহ ও অবচেতনের কান্না’ এ গল্পের মূল থিম।

চার.

‘বন্দীবিহঙ্গ’ মুসলিমসমাজের দুটি নরনারীর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চালচিত্র। আবু মিয়া কলকাতার একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সহকারী সম্পাদক। প্রকৃতপক্ষে, তাকেই পত্রিকাটির জুতা সেলাই থেকে গীতাপাঠ করতে হয়। স্ত্রী জমিলা তিনটি সন্তান নিয়ে পাখপাখালির কলরব-মুখরিত দূরের কোনো এক গ্রামে থাকে। আবু মিয়া বছরে একবারমাত্র ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যেতে পারে। জমিলা আবু মিয়াকে চিঠি লেখে। সে চিঠিতে থাকে গ্রামের খবর, খোকা-খুকির সংবাদ, সর্বোপরি জমিলার মনের খবর। মূলত, ‘বন্দীবিহঙ্গ’ গল্পটি ঘটনাপ্রধান নয়, ভাব ও ভাবনাপ্রধান। গল্পটির প্রথমাংশে অদ্বৈতের ভাষা কাব্যময়তাকে ছুঁয়ে আছে। গল্পটির শুরু এভাবে — ‘বারো মাসের ছটা ঋতু, আবু মিয়ার মনে ছত্রিশ রকমের চিন্তা বয়ে আনে। ফাল্গুন যখন বনে রঙ ছড়ায়, সে রঙে তার মনে জাগে নেশা। এরপর জৈষ্ঠ্যের বাউল বাতাস আমের তলায় শুকনো পাতাগুলো ওড়ায়, তারো বুকটা শূন্যতায় খা খা করে ওঠে।’ কবিতার মতো করে লেখা গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখক স্বপ্নচারী আবু মিয়ার সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন। আবু মিয়া প্রাণ-উতপ্ত, কিন্তু দরিদ্র। অর্থোপার্জনের জন্যে তাকে কলকাতায় থাকতে হয়। অর্থহীনতার খাঁচায় সে বন্দীবিহঙ্গ। তার মন উড়ে যায় গ্রামে, স্ত্রী-সন্তান-পরিজনের কাছে বাত্সল্যসিক্ত তার হূদয়। স্ত্রী-সন্তানদের কলকাতায় নিয়ে আসার মতো অর্থনৈতিক ক্ষমতা তার নেই। রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তার সতেজ বাসনাগুলো ধীরে ধীরে মরতে থাকে। কিন্তু জমিলার চিঠি তার অভিলাষগুলোকে মরতে দেয় না। জমিলার ক্ষোভ-দুঃখ-ভালোবাসামাখা চিঠি আবু মিয়ার জীবনে প্রাণময়তার সঞ্চার করে। এ গল্পের অধিকাংশ জুড়ে আছে জমিলার চিঠি। গল্পকার জমিলার চিঠিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে ‘বন্দীবিহঙ্গ’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন। আবু মিয়া কলকাতায় বসে জমিলার চিঠি পড়ছে। গল্পকার চিঠির মাঝখানে মাঝখানে আবু মিয়ার মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথাও সুকৌশলে আবু মিয়ার কথনে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রসঙ্গ আছে এ গল্পে। স্টালিনগ্রাডে নািস সৈন্যের অভিযানের কথা উল্লিখিত হয়েছে এখানে। মাতাল সময়ের পটভূমিকায় গল্পকার বাংলার দুজন নর-নারীর বেদনালাঞ্ছিত জীবনের চালচিত্র নির্মাণ করেছেন ‘বন্দীবিহঙ্গে’। গল্পে মাটির গন্ধ আছে, মাটিবর্তী মানুষের জীবনালেখ্য আছে; বৃক্ষপল্লব, ঋতুর উল্লেখ আছে। এ গল্পে গ্রামজীবনের যে পারিবারিক চিত্র আছে, তা স্নেহমমতার সরসতায় দীপ্ত কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত।

গল্পটি শেষ হচ্ছে এভাবে—’সেদিন তোমার ছেলেদুটো করলো কি, না একটা পাখি ধরে আনলো। এনে খাঁচায় পুরলো। খাঁচার বন্ধনে পড়ে পাখিটা লাগল ছটফট করতে। খাবে না নাবে না, কিছু করবে না, খালি খালি ডানা ঝাপটাবে। শেষে তোমার মেয়েটা করল কি, না খাঁচার দরজা খুলে পাখিটাকে ছেড়ে দিল।’ পাখির রূপকে জীবনের কথকতা যেন এটি। মূলত ‘বন্দীবিহঙ্গে’ অদ্বৈত মল্লবর্মণ দারিদ্র্যের খাঁচায় বন্দী আবু মিয়া ও জমিলা নামের দুটো অসহায় নর-নারীর জীবনকথা শুনিয়েছেন। বনের পাখিটা শেষ পর্যন্ত বনে উড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আবু মিয়া ও জমিলা বন্দীবিহঙ্গ। আর্থসামাজিক জটিলতা তাদের ডানার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। ‘বন্দীবিহঙ্গ’ও এক বুভুক্ষার গল্প—দুজন বুভুক্ষু মানুষের গল্প। এ বুভুক্ষা পারস্পরিক সান্নিধ্য লাভের বুভুক্ষা।

পাঁচ.

আমাদের বিবেচনায় ‘স্পর্শদোষ’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের শ্রেষ্ঠতম গল্প। একজন মানবসন্তান এবং একটি মানবেতর প্রাণীকে উপজীব্য করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘স্পর্শদোষ’ গল্পে দুর্বিষহ জীবনের ইতিবৃত্ত নির্মাণ করেছেন।

‘মনের বুভুক্ষা চাহে প্রেম, প্রেম চাহে স্পর্শ’—এটা মানবিক বৃত্তায়নের সংবাদ। কিন্তু স্পর্শে সর্বদা প্রেম জাগে না, দ্বেষও জাগে। মনের ক্ষুধাই মানুষকে মানুষে পরিণত করে। কিন্তু খাবারের অপ্রতুলতা মানুষকে অমানুষ করে। কুকুর মানবেতর প্রাণী। সে কখনো মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, অন্তত খাদ্যের জন্যে। কিন্তু আকালের দিনে একটি অখ্যাত কুকুর খেঁকী হয়ে উঠল ভজার প্রতিপক্ষ। খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। গল্পের পঞ্চম অনুচ্ছেদে সংঘর্ষের মাধ্যমে ভজার সাথে খেঁকীর স্পর্শ লাগলেও একাদশ অনুচ্ছেদে এসে আমরা দেখতে পাই—এরা প্রতিপক্ষ এবং মারমুখী। ‘মোটের একদিকে খাবারের একটি ঠোঙ্গা গুঁজিয়া রাখিয়া ভজা অদূরের দুইতিনখানা খাবারের দোকানের সামনে দিয়া ঘুরিয়া আসিতে গিয়াছিল। মোটের সন্নিকটে দ্বিতীয় প্রাণীর (খেঁকী) আগমন তাহার সন্ধানী দৃষ্টি দূর হইতেই দেখিতে পাইয়াছিল। হেঁই হেঁই করিয়া দৌড়াইয়া আসিয়া সে অপহারকের মুখ হইতে খাবারের ঠোঙ্গাটি উদ্ধার করিয়া লইল।’ এখান থেকেই পরস্পরের যুদ্ধ শুরু। পর্যায়ক্রমে ভজার কায়েমি স্বার্থ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। সে ধীরে ধীরে কুকুরের মতোই আচরণ করতে থাকে। তখন তার বিকৃত রূপ, ভীতিপ্রদ আচরণ। ভজা ‘খেঁকীর দেখা পাওয়া মাত্রই মাটিতে বসিয়া তাহাকে অভ্যস্ত উপায়ে ভয় দেখাইত, আবার সন্ধ্যার ছায়ালোকে ভজা যখন খেঁকীর প্রতি পূর্বোক্ত উপায়ে ভয় দেখাইয়া বিকৃতকণ্ঠে ঘেউ করিয়া উঠিত—খেঁকী তখন স্পষ্ট দেখিতে পাইত, এতো নেহাত্ খেলা নয়—ঠাট্টা নয়—ভজার চোখ দুইটা অস্বাভাবিক তীব্রতায় ঝলসাইয়া উঠিতেছে—দাঁতগুলি কড়কড় করিয়া মানবিকতার সীমা অতিক্রম করিতেছে।’ খাদ্যাভাব, রূঢ় বাস্তবতা এবং মনের একধরনের বিকলন ভজাকে কুকুরের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। খেঁকীও মানুষের মধ্যে জান্তব আচরণ দেখে আশ্চর্য হয়—’খেঁকী উহার মধ্যে নিজের স্বরূপ দেখিয়া পিছাইয়া গেল।’ এ গল্প মানুষের অধঃপাতের কথামালা।

ধীরে ধীরে ভজার মধ্যে পৈশাচিকতা বাড়তে থাকে। ‘খেঁকীর দিনরাত্রির শান্তি যেন ভজা চুষিয়া খাইয়াছে। ভজার এ কয়দিনের অত্যাচারে খেঁকী আরও শুখাইয়া গিয়াছে। পথ চলে সে সন্তর্পণে—পাছে ভজার মুখোমুখি হয়। পথ চলিতে ভজার ছায়ামাত্র দেখিলে খেঁকী ছুটিয়া পালায়। আবার, খেঁকীর ছায়ামাত্র দেখিলে ভজা তাড়া করিয়া যায়—দৌড়াইয়া গিয়া ভয় দেখাইয়া আসে। ক্রমে খেঁকীর সহনশক্তি সীমা অতিক্রম করিল।’ এ এক দুর্ভাগা কুকুর। আহসান হাবীরের ‘ধন্যবাদ’ কবিতার ডলির মতো সে সৌভাগ্যবান নয়। ডলির বাদশাহী বরাত, তার জন্মোত্সবে দু-হাজার টাকা খরচ করা হয়। আর এদিকে ভজার মানবেতর নিষ্ঠুর আচরণে খেঁকীর মৃত্যু হয়। সেদিন ভজার নিকট থেকে দু-দুবার অমানুষিক তাড়া খেয়ে শ্রান্ত খেঁকী ভজার জ্বলন্ত চোখকে এড়াবার জন্যে একদিকে ছুটে চলল। বড়লোকের বাড়ির আগাছার অন্তরালে আশ্রয় নিয়েও ভজার হাত থেকে রেহাই পেল না সে। ভজা পৈশাচিক ব্যাগ্রতায় তার দিকে এগিয়ে এলে ক্লান্ত নির্জীব খেঁকী উঠে এক লাফে পথে নামল এবং একজন পথযাত্রীকে কামড় দিল। এই কামড়ের কারণেই খেঁকীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয়ে গেল। ‘বীরবরদের লাঠির আঘাতে’ খেঁকীর দেহান্ত ঘটল।

‘স্পর্শদোষ’ উপসংহারে এসে ‘কুকুর ও মানুষের সম্পর্কের গল্পে’র চেয়ে অন্য একধরনের মানবিক মূল্যবোধের গল্পের মাত্রা পেয়ে যায়। গল্পকার গল্পটিতে উন্মাদপ্রায় ভজার মধ্যে মানুষের সামূহিক মূল্যবোধের প্রতিচিত্র স্পষ্ট করে তোলেন। যে ভজা নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি, সে ভজা বীভত্সভাবে গণপ্রহারে মৃত খেঁকীর জন্যে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ‘প্রথমে সে কি করিবে ভাবিয়া পাইল না, যেন তাহার প্রিয়বিচ্ছেদ ঘটিয়াছ, এমনিভাবে সে জ্ঞানহারা হইয়া লুটাইয়া পড়িতে পড়িতেও সামলাইয়া লইল। তারপর বিস্মিত স্তম্ভিত জনতাকে ভাবিবার অবসর না দিয়া সে খেঁকীকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে চলিয়া গেল।’ তার মুখে কিছুটা পাপবোধ ও অনুশোচনার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল হয়তো। অদ্বৈত মল্লবর্মণের সুনিপুণ তুলির টানে ‘মানুষের নির্মম আচরণে’র এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত চারুত্ব পেয়ে যায়। গল্পের শেষে মানুষের মন ভেঙে যাওয়ার কথাই বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর গল্পে পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা শুনিয়েছেন। তাঁর চারটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরুষ এবং অতি সাধারণ মানের পুরুষ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে অসাধারণ মাত্রা যুক্ত করেছেন। ধনঞ্জয়, গুরুদয়াল, আবু মিয়া এবং ভজা আপাত ঔজ্জ্বল্যহীন অথচ বিচিত্রতায় ভরপুর চারটি চরিত্র। চারজনই বুভুক্ষু—কেউ স্নেহর জন্য (ধনঞ্জয়), কেউ কামের জন্য (গুরুদয়াল), কেউ পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যের জন্য (আবু মিয়া) আর কেউ শুধু খাদ্যের জন্য (ভজা)।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন