অদ্বৈত মল্লবর্মণকে (১৯১৪-৫১) পাঠক-সাধারণ কথাসাহিত্যিক হিসেবেই জানেন। তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক প্রাকৃত ও লোকজীবন ঘনিষ্ঠ উপন্যাসের নিপুণ রচয়িতা হিসেবেই তিনি সুখ্যাত। উৎপল দত্ত এবং ঋত্বিক কুমার ঘটকের শিল্পশৈলীর সৌজন্যে এই উপন্যাসটির নাট্য (১৯৬৩) ও চলচ্চিত্ররূপের (১৯৭৩) কারণেও তিনি কথাকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করে আছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর উপন্যাসটির শিল্পগুণ ও জীবন চিত্রায়ণের গভীরতর বোধের কারণেই কালজয়িতা অর্জন করেছেন। স্মর্তব্য যে, অদ্বৈত মল্লবর্মণের চারটি ছোটগল্প রয়েছে। গল্পগুলো হলো : ‘সন্তানিকা’, ‘কান্না’, ‘বন্দী বিহঙ্গ’ এবং ‘স্পর্শদোষ’। ‘বিদেশি নায়িকা’, ‘শুশুক’, ‘যোহার গান’, ‘ধারা শ্রাবণ’, ‘মোদের রাজা মোদের রাণী’ এবং ‘ত্রিপুরালক্ষ্মী’ নামে তাঁর ছয়টি কবিতাও রয়েছে। তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক সুনামখ্যাত উপন্যাস ব্যতীত ভারতের চিঠি — পার্ল বাককে রচনাটিকে উপন্যাস না ধরলেও তাঁর আরো তিনটি (জীবন-তৃষা, রাঙামাটি, শাদা হাওয়া) শিল্পসফল উপন্যাস রয়েছে। উল্লেখ্য, তাঁর রচনাবলিতে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও আলোচনা শিরোনামে ২৪টি প্রবন্ধও রয়েছে। অচিন্ত্য বিশ্বাস-সম্পাদিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র (কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০০) অবলম্বনে আমি বর্মণের প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যসমালোচক দৃষ্টিভঙ্গিকে এ-প্রবন্ধে উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছি।
বর্মণের প্রবন্ধের মধ্যে চিত্রকলা, শিল্পকলা এবং ঋতু বিষয়ক প্রবন্ধ যেমন রয়েছে; তেমনি টিএস এলিয়ট এবং রোকেয়া-সম্পর্কিত তাঁর মূল্যায়নও প্রত্যক্ষযোগ্য। পল্লীগীতি, বাউলসংগীত, পালাগান, নাইওরের গান, পুতুল-বিয়ের ছড়া এবং বারোমাসি বিষয়ক বিভিন্ন লোকসংগীত সংকলনকে আমি প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই এজন্যে যে, তিনি শুধু এ-পল্লীগীতিকাগুলো সংকলন ও সংগ্রহই করেননি; বরং এই গীতিকাগুলো সম্পর্কে (শুধু অপ্রকাশিত বাউলসংগীত বাদে) মতামত, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণও তাঁর গীতিকাসমূহে উপস্থাপিত করেছেন। বর্মণের প্রবন্ধসমূহকে আমি বিষয়নির্ভর, লোকসংগীতভিত্তিক এবং সাহিত্য সমালোচনামূলক – এই তিন ভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেছি।
উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশে অনেক প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক রয়েছেন। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রবল গভীর প্রাজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই কম। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জৈবনিক অন্তর্দৃষ্টি, মূল্যায়ন-ক্ষমতা এবং মানুষের ও মানবতার জন্য মমত্ববোধ যে কত গভীর, তা তাঁর প্রবন্ধাবলি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি। প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রেও বাংলা সাহিত্যে তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের মতোই কালজয়ী আসন পেতে পারেন বলে আমি মনে করি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিষয়নির্ভর প্রবন্ধ
বর্মণের প্রবন্ধরাজিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। তাঁর বিষয়নির্ভর প্রবন্ধের মধ্যে আমি তাঁর ‘নাটকীয় কাহিনী’ ‘প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি’, ‘ছোটদের ছবি আঁকা’, ‘আম্রতত্ত্ব’, ‘বর্ষার কাব্য’ এবং ‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’কে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। ‘সাগর তীর্থে’ রচনাটিকে আমি ভ্রমণধর্মী প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই। জীবনের বিস্ময়বোধ ও মানবিকতা এবং ধর্মগত অনুধ্যানময় গভীরতার কথা এতে অভিব্যক্ত হয়েছে। মহামুনি কপিল যে তাঁর ‘তেজোদ্ভাসিত বদনমন্ডলে তপের কঠোরতা মাখিয়ে সগর্বে পদচারণা করে ধ্যানের আসনে গিয়ে বসতেন’ (অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র, পৃ ৩৮) এবং ‘অসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে বসে তিনি ধ্যানের গহনতায় ডুব দিতেন’ (ওই, পৃ ৩৮), তা তিনি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এই প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করেছেন। এতে লেখকের অন্তর্দৃষ্টির ধ্যানময়তা স্রষ্টাকেন্দ্রিক অনুভাবনার সঙ্গে নিবিড়তায় সম্পর্কিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
‘নাটকীয় কাহিনী’ রূপটি বর্মণ কার্ল কাপেকের একটি লেখা অবলম্বনে রচনা করেছেন। বর্মণ নাটক না লিখলেও নাট্যকার, প্রযোজক, অভিনেতা, দর্শক প্রমুখের বিচিত্রমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে নাট্যকারের মননকে স্পর্শ করার প্রচেষ্টা এতে করেছেন। বর্মণ লিখেছেন, গ্রন্থকার, সমালোচক এবং জনসাধারণকে অর্থাৎ নাট্য-দর্শককে উপলক্ষ করেই তিনি এই প্রবন্ধটি রচনা করেছেন। ‘থিয়েটার আদতে কেউ বোঝেই না’ (ওই, পৃ ৪২) ভাষ্যমধ্য নিয়ে তিনি মূলত যুগপৎ নাট্যকার ও প্রযোজকের প্রতিভাহীনতার কথাই ব্যক্ত করেছেন। পরিচালক ও সমালোচকরাও যে প্রকৃত নাট্যসমঝদার নন, তাও তাঁর ভাষ্য থেকে; ‘যেসব পরিচালক চুল দাড়ি পাকিয়েছেন, তাঁরাও না, এমনকি সমালোচকরা নিজেরাও না।’ (ওই, পৃ ৪২) আসলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ আমাদের দেশে প্রকৃত ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নাট্যকার, প্রযোজক, গ্রন্থকার ও সমালোচকের অভাব বোধ করেছেন। আসলেই তাঁর এই অনুধাবনের মধ্যে সত্যতা আছে। নাট্যকার সেখানে বলেছেন, ‘দুঃখ, বেদনা ও মমতা মিশিয়ে গড়ে তুলেছি নাটকের আখ্যানবস্ত্ত’ (ওই, পৃ ৪৪) সেখানে অন্তঃসারশূন্য প্রযোজক বলছেন, একটা প্রহসনরূপে বঙ্গমঞ্চে এ নাটকটিকে দাঁড় করাতে হবে; শুধু তাই নয়, দুঃখজনকভাবে প্রযোজক বলেছেন : ‘একে নাট্যকার যে ধারণায় খাড়া করেছেন, তার থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে খাড়া করে তুলতে হবে।’ (ওই, পৃ ৪৪) নাট্যকারের জৈবনিকবোধের সারাৎসারকে যে নাট্যাভিনয়ে তুলে আনতে হবে – তা অন্তঃসারশূন্য প্রযোজক অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘প্রাচীন চীনা চিত্রকলার রূপ ও রীতি’ প্রবন্ধটির মধ্যে স্পষ্ট হয় যে, বর্মণের জীবনদৃষ্টি কত গভীর। চিত্রকলার মতো একটি আয়াসসাধ্য শিল্পকর্মকে তিনি চৈনিক ইতিহাস ও সভ্যতা বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন। পৃথিবীর সব দেশের লিখন ও চিত্রণ রীতি আলাদা হলেও চীনের লিখন-রীতির মূলটাই যে চিত্রণরীতি, তা তিনি স্পষ্টতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। চৈনিক যুবক-শিল্পীরা ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপান থেকে সেখানকার চিত্রকলার রীতি ও পদ্ধতি শিখে এসে যে চীনে তারা তা প্রবর্তন করেছেন, তা তিনি লিখেছেন, ১৯২৩ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে চৈনিক শিল্পীরা নব্য ভাবধারায় সে-চীনের শিল্পকলা রূপায়িত ও রসায়িত করেন, তা স্পষ্টতার সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছেন। শাঙপিওকে তিনি নব্য চীনের শিল্পাচার্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গ্রিক দর্শনে খাদ মেলানো কঠিন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আসলে প্লেটো যেভাবে গ্রিস দেশে মানব-প্রজননের কথা বলেছেন, তাতে সভ্যতা রক্ষা পাওয়া তো দুঃসাধ্যতায় পর্যবসিত হয়। নৈতিক দিক থেকেও তাঁর এ-প্রজননভাবনা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। সে-কারণে গ্রিক দর্শনের ঘাটতিও আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে। ভারতের উপনিষদের ঋষিদের ভাববাদী এবং আত্মা-পরমাত্মাবাদী দর্শনকে তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কময়তার দর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন বলেই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছে : ‘ভারতের উপনিষদের ঋষিরা যা দিয়ে গেছেন, তাতে মিশ্রণ ঘটাবে কোন্ দেশের ভাবধারা?’ (ওই, পৃ ১১৫)
প্রকৃতির সঙ্গে চৈনিক শিল্পকলার গভীর যোগাযোগের কথা বর্মণ লিখেছেন। ইয়াংসি নদীর সীমাহীন প্রশান্তি, শান্ত মৌন মন্থরতা, জ্ঞানগম্ভীর নীরবতা এবং অবিরাম গতিশীলতাকে শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মে চমৎকারভাবে উজ্জীবিত রেখেছেন। ‘চীনা শিল্পীরা প্রকৃতিকে যেভাবে দেখেছেন, সেইভাবে চিত্রিত করেছেন। বুদ্ধি দিয়ে তার অপ্রাকৃত সত্তাকে কোথাও ক্ষুণ্ণ করেন নি।’ (ওই,পৃ ১১৬) চৈনিক শিল্পকর্মের প্রকৃতির মধ্যে চৈনিক নিসর্গের মতোই ঝটিকা নেই, তার অন্তরেও উপলভাঙা চাঞ্চল্য নেই। কনফুসিয়াস ও লাউৎসের মতো আত্মবাদী, ভাববাদী ও স্রষ্টাবাদী অনুভববাদীদের মগ্নচৈতন্যের নিবিড়তার মতোই চৈনিক চিত্রকলার স্তব্ধতা ও মৌন নান্দনিকতা। পাশ্চাত্য শিল্পকলায় ইতালির স্থান যেমন উচ্চে; প্রাচ্য চিত্রকলায় সেই স্থান চীন পেতে পারে বলে শিল্পরসিকরা মনে করেন।
খ্রিষ্টজন্মের তিনশো বছর পূর্বে চীনে তুলির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সেখানে কাগজের প্রচলন হয়। তার আগে, কাঠের তক্তায় বা দেয়ালের গায়ে চুন দিয়ে ছবি আঁকা হতো। যেগুলো এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উপর্যুক্ত চিত্রাবলি চীনের ভাববাদী ও স্রষ্টাময়ী দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ কনফুসিয়াসের খুব প্রিয় ছিল।
ঋষি লাউৎসের মরমি ও আধ্যাত্মিক ভাবনা এবং তাঁর শিষ্যগণের বৃত্তান্তসহ গৌতম বুদ্ধের সৌম্যমূর্তি এবং অনন্তের পথে তাঁর প্রত্নগভীর মন্থরিত যাত্রা চৈনিক শিল্পীদের শিল্পকর্মে খুব admire বা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিস্ময়ের সঙ্গে স্থান পেত।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে চীনে landscape বা প্রাকৃতিক দৃশ্যময় ছবি আঁকা শুরু হয়। ইউয়েন বংশের চিত্রশিল্পী চাও মেঙ-ফু ‘ওয়াঙ-চুয়াঙের দৃশ্য’ শীর্ষক ছবিটি অষ্টম শতাব্দীতে এঁকেছিলেন। ওয়াঙ-ওয়ে নদীর পাড়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন শিল্পী; অতঃপর তিনি এ-ছবিটি এঁকেছিলেন। প্রকৃতিময়তার সঙ্গে শিল্পীর অন্তরের একাত্মতাবোধের প্রকাশই যুগপৎ শিল্পীর চেতনায় ও শিল্পকর্মটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। (ক্রমশ)