উত্তরবঙ্গ সংবাদের ‘শারদাঞ্জলি’তে (২০২২) তৃপ্তি সান্ত্রার একটি শব্দকে (শব্দটি অবশ্যই নিন্দনীয় ও অবজ্ঞাসূচক) যে বিপুল প্রতিবাদ, প্রতিরোধ লক্ষ্য করলাম তা থেকে স্পষ্ট হল একটি শব্দ মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, সাড়া দেয় বা জাগিয়ে তোলে। অথচ বাংলার কবি/ সাহিত্যিকরা দৈনন্দিন ভূরি ভূরি শব্দ প্রসব করে। মূল্যহীন, সাধারণ, অতিসাধরণ, দর্শনহীন, সময়জ্ঞানহীন, দায়সারা, বিনোদনচর্চা, নিজেকে সাংস্কৃতিক মনস্ক করে তুলতে যে অজস্র সীমা-পরিসীমাহীন শব্দের জন্ম হয়, হচ্চে এর ভবিষ্যৎ কী? শব্দ সত্যের সন্ধান দেয় আবার মিথ্যারও সন্ধান দেয়। স্পষ্ট বোঝা গেল একটি শব্দ নিয়ে একজন কবি/ সাহিত্যিককে কেমন/কত কঠিন সচেতনতা অবলম্বন জরুরি। আরও জরুরি পাঠককে বোকা না ভাবা। তেমনি যে বিভীষিকা সময়ে আজকের রাজ্য দাঁড়িয়ে আছে (কাপড় দিয়ে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা) সেখানে কবি শিল্পী কোন দায়বদ্ধতা পালন করলেন? সেই যে কবি লিখলেন—সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিতে হয়। কী সাক্ষর রেখে গেলেন আজকের আমাদের কবিরা? সাহিত্যের প্রতি থেকে (বিশেষ করে কবিতার) মানুষ বিমুখ হওয়াতে (বিনোদনের অন্য মাধ্যম অবশ্যই দায়ী) কি কবিরাই দায়ী নন? আজও একটি কবিতা কী বিপুল আলোড়ন তুলতে পারে (তা যদি সময়ের ভাষ্য হয়) এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে বসেই প্রত্যক্ষ করি। জনজীবনের দোসর হিসেবে, মানুষের মুক্তির প্রয়াস হিসেবে কবিতাই কি শেষ অবলম্বন হয়ে উঠবে না? কী বলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরাসূরীরা? এসব তর্ক-বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে বরং ঢুকে পড়া যাক অরণি সরণিতে, পরের ট্রাম একটু পরেই ছাড়বে যে!
সাতের দশকের বিশিষ্ট কবি অরণি বসু (১৯৫১)। যদিও প্রথম কাব্য ‘শুভেচ্ছা সফর’ (১৯৮৭) আসতে অনেক দেরি হয়েছে। ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ (সম্পাদনা-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়) যা আমার কাছে আধুনিক কবিতার মূল্যবান দলিল, যা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী সেখানে অরণি বসুর বা ‘উলুখড়’ পত্রিকার কোনো চিহ্ন দেখলাম না। দূর থেকে, বহুদূর থেকে, প্রান্তভাগ থেকে যে কেতাবকে মূল্যবান ডকুমেন্ট শিরোধার্য করে সেই শৈশবের দিনগুলি থেকে কবিদের চিনছি, বুঝছি (এই জনপদজীবনে বইয়ের আউটলেট নেই, বই দেখার কোনো সুযোগ নেই) সেখানে কবিচিহ্নের অনুপস্থিতি কী কোনো নঞর্থক বোধের জন্ম দেয় না? তবে শুনেছি ‘আমিও কি কবি নই? যত কবি রণজিৎ দাশ?’ (‘শুভেচ্ছা সফর’ প্রকাশের বছরই রণজিৎ দাশের তৃতীয় কাব্য ‘সময়, সবুজ ডাইনি’ প্রকাশিত হবে)। একথাও সত্য (শুভেচ্ছা সফর) কবিকণ্ঠকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় পাঠের অন্তরালে। অরণি সরণিতে পাঁচটি স্টপেজ। (শুভেচ্ছা সফর, লঘু মুহূর্ত) কাব্যের পরে তৃতীয় কাব্য (ভাঙা অক্ষরে রামধুন) আসতে পঁচিশ বছর সময় লাগবে (২০১৭)। পরের দুটি কাব্যে অরণি বসু (‘খেলা চলে’, ‘চ্যুত পল্লবের হাসি’) নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকবেন। এও তো বিস্মিত সত্য প্রথম দুটি কাব্যে যে চেতনা, বোধের জাগরণ, তারপর কবিতার মুহূর্ত থেকে পলায়নের কারণ কী!
অরণি বসু সাতের দশকে (১৯৭০ এর আগেও কিছু কবিতা পাওয়া যাবে) কাব্যযাত্রা শুরু করবেন, প্রথম কাব্য পাব আটের দশকের পড়ন্ত বেলায় (১৯৮৭)। সাতের দশকের কব্য পরিমণ্ডলের সূচনা হচ্ছে অমিতাভ গুপ্তের ‘আলো’ (১৯৭০) কাব্য দিয়ে, শেষ ধরে নিচ্ছি অনন্য রায়ের ‘আমিষ রূপকথা’ (১৯৭৯) বা তুষার চৌধুরীর ‘অলীক কুকাব্য রঙ্গে’ (১৯৭৯)। আটের দশকের সূচনা ধরে নিচ্ছি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘জলপাইকাঠের এসরাজ’ (১৯৮০), শেষ ধরে নিচ্ছি জয় গোস্বামীর ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা’ (১৯৮৯)। সাত আটের দশকের কাব্য পরিমণ্ডলের মধ্যে আমরা একে একে পাব — কমল চক্রবর্তী, নির্মল হালদার, শ্যামলকান্তি দাশ, বীতশোক ভট্টাচার্য, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত, সুবোধ সরকার, জহর সেনমজুমদার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয়দেব বসু, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনিতা অগ্নিহোত্রী সহ একাধিক কবিকে। আমাদের কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু ১৯৮৭ (শুভেচ্ছা সফর) তাই আশপাশ দিয়ে একটু ঘুরে নেব (অবশ্যই সাত, আটের দশকের কবিদের নিয়ে)। রণজিৎ দাশের ‘সময়, সবুজ ডাইনি (১৮৮৭, তৃতীয় কাব্য) আগেই বলেছি। একে একে পাব অনুরাধ মহাপাত্রের ‘অধিবাস মণিকর্ণিকা’ (১৯৮৭, দ্বিতীয় কাব্য), তুষার চৌধুরীর ‘ডোমকাক ও বহ্নিশিখা’ (১৯৮৮, তৃতীয় কাব্য), মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’ (১৯৮৮, তৃতীয় কাব্য), সুবোধ সরকার ‘একা নরকগামী’ (১৯৮৮), রাহুল পুরকায়স্থ ‘অন্ধকার স্বরলিপি’ (১৯৮৮, প্রথম কাব্য)। অনুরাধা মহাপাত্র, মল্লিকা সেনগুপ্তরা নিজস্ব পরিসর গড়ে তুলবেন, নারীর মনন নিয়ে কথা বলবেন, প্রতিবাদী ঢঙ উপস্থাপিত হবে। অনুরাধা মহাপাত্রে জনজীবনের কথা, প্রান্তিক পরিসর আসবে। জয় গোস্বামীর প্রসঙ্গে জাচ্ছি না কেননা ততদিনে জয় কবিতায় হাত পাকিয়ে ফেলেছেন, সহজ সেন্টিমেন্টাল ইসুকে সামনে রেখে পাঠকের মগজ ধোলাই দিতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। রণজিৎ দাশ সাড়া জাগাবেন বটে, মস্তিষ্কে বোধে আঘাত করবেন বটে কিন্তু কাব্যসত্য অনুপস্থিত। সহজ অনুভূতি, প্রেম রোমান্স, পরিচিত পরিমণ্ডলে হালকা স্পর্শকাতর শব্দে জয় গোস্বামী এঁদের সবাইকে পিছনে ফেলে দেবেন। সুবোধ সরকার, মৃদুল দাশগুপ্তের সমগ্র কাব্য পরিক্রমায় খুব সচেতন ব্যালেন্স লক্ষ্য করা যাবে। যদিও বিংশ শতকের আগের সুবোধ, মৃদুল স্পষ্ট শিল্প সচেতন, সময় সরণির কবি। কিন্তু কালের দোসর সত্তায়, বৌদ্ধিক চর্চায় জয় থেকেও এগিয়ে থাকবেন রণজিৎ দাশ, জয়দেব বসু, জহর সেনমজুমদাররা। এই দশকে সবচেয়ে স্বতন্ত্র চিহ্নিত কবি হিসেবে উঠে আসবেন বীতশোক ভট্টাচার্য ও জহর সেনমজুমদার। বীতশোক ভট্টাচার্যে ‘অন্যযুগের কথা’ পৃথক সুর শুনিয়ে যাবেন। জহর সেনমজুমদারের ‘মহাকাল সমারূঢ়’ (১৯৮১), ‘শ্রাবণশ্রমিক’ (১৯৮২) ও ‘প্রসবসিঁদুর’ (১৯৮৯) কাব্যে বড় পরিসরে মহাপৃথিবীর আনাচে কানাচের সত্য ভিন্নধর্মী কাব্য ভাষায় উপস্থিত হবে। অরণি বসু প্রথম থেকে নিজস্ব ভাষা পরিসরে (যদিও পরে ব্যঙ্গ করে লিখবেন—‘যে ভাষায় বাজার কথা বলে/ আমি এখন সেই ভাষাতেই কথা বলার চেষ্টা করি’) এগিয়ে গিয়েছেন। মনে ছিল অগ্রজ কবি সাহিত্যিকদের কথা। তবুও নিজস্ব বিন্যাস পেয়েছিলেন। ষাট ও সত্তরের পরিসর মাথায় নিয়েই ‘বালাই ষাট ও সত্তরের একজন’ কবিতায় উচ্চারিত হবে —
“রবীন্দ্রসদন স্টেশনে নামতে যাব ধাক্কা খেলাম সুব্রতদার সঙ্গে—
সেই মোটা কালো ফ্রেম, মাথাটা পুরো সাদা
পেছনে ভাস্করদা জিন্সের প্যান্ট, লাল টি-শার্ট।
শামসেরের বয়স বাড়েনি
তর্কে ব্যস্ত ব্যান্ডমাস্টার আর মানিক চক্রবর্তী,
মানিকদাকে এই প্রথম দেখলাম পাজামা-পাঞ্জাবিতে
মাথায় আবার গামছার পাগড়ি।” (‘বালাই ষাট ও সত্তরের একজন’, শ্রেষ্ঠ
কবিতা, অরণি বসু, প্ল্যাটফর্ম, হুগলি–২৪, প্রথম প্রকাশ, মার্চ ২০২২, পৃ. ১২৬)
দুই
অরণি সরণিতে প্রথম থেকেই বোধচর্চা প্রধান হয়ে ওঠে। চারিদিকে ভরে গেছে অশুভচেতনা, অমঙ্গলবোধ, নঞর্থক ধারণা। ধান্দাবাজির ছলচাতুরি। অরণি বসুর ‘শয়তান’ একটি থিম। যা সর্বত্র বিরজমান। যা সমস্তকে ধ্বংস করছে। কোথাও প্রকাশ্যে কোথাও ছদ্মবেশে। নেই কোনো পরিত্রাণ। শহর ক্রমে দুঃখী হতে থাকে। শহরের যন্ত্রণা বেরিয়ে আসে। শয়তানের মানবিক বোধ জাগে না। অন্ধকারের চরাচর বৃদ্ধি পেয়ে চলে। তিনিও সামান্য জীবনের কবি হতে চান। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের, যে জীবন কাকের, ভাঙা সোফার সেই ব্যঞ্জনাময় সরল সত্যের কবি হতে চান। সরলতার, সামান্যতার আত্মদর্শনকে নিজের মধ্যে জাগরিত করে বিন্দু বিন্দু বোধ ও সরল সত্যের কবি হিসেবে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান। অরণি বসুর ‘অভিসার’ দিবাভিসার। আপাত রোমান্টিকতার আড়ালে গভীর বিষাদ ও না পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত কবি আকুতির প্রকাশ। তিনি সফল হতে চান না, আবার ব্যর্থতার বোঝা বয়ে বয়ে ক্লান্ত। স্পষ্ট বোঝা যায় বাংলা কবিতার প্রচন্ড ভিড়ে কীভাবে আড়াল খুঁজে স্বতন্ত্র স্বর ঘোষণা করা যায় সেই চেষ্টায় তিনি প্রথম থেকেই অগ্রসরমান। প্রান্ত ও কেন্দ্রকে সামনে রেখে ভিন্ন বোধ জাগিয়ে দিয়ে বিশল্যকরবীর সন্ধান করে চলেন। গ্রাম থেকে খবর আসে। গ্রাম জাগে। শ্রেণিচেতনা জাগরিত হয়। সংবাদ মূলত কাব্য হয়ে ওঠে। ভোরের কোলাহল কাব্যে রূপ পায়।
কবিতায় তিনি গল্প বলেন, চিত্রমালা আঁকেন, একটা পরিসর নির্মাণ করেন কিন্তু পাঠককে ডুবতে দেন না। পাঠক যখন অল্প অল্প করে ডুবে যাচ্ছে তখনই ভয়ংকর সংবাদ (যার মধ্যে সময়ের বিভীষিকা চরম শিখায় জ্বলতে থাকে) এনে ভেঙে দেন। ভালোবাসায় বলি হয়ে ভেসে গেছে কতফুল। ভালোবাসায় ভাসব বলে ডুবে গেছে কত কুঁড়ি —
“মানুষের কোমর আর তেমন সোজা নেই, আগেকার মতো
প্রত্যেকের ছোটো মেয়ে ভালোবাসার বিবাহের পর ক্রমশ ভালোবাসাহীন” ( সাড়া, তদেব, পৃ. ২০)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনারতরী’র মাঝি সৃষ্টিকে নিয়েছিল, স্রষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অরণি বসু সমুদ্রের কাছে বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন লঘু কলরব, গাঢ় প্রেম ও পাপ। সমুদ্র কিছুই নেয়নি। শেষে নিজেকে তুলে দেবার জন্য আকুল হয়েছিলেন। সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। পরে আছে কিছু সমুদ্রস্নানের স্মৃতি। তাও তা লবণাক্ত। এক নঞর্থক জীবনবোধ, শূন্যচেতনা নিয়ে তিনি কবিতার অন্ধকার বিশ্বে যাত্রা করেন। রোমান্টিকতায় ভেসে যায় না তাঁর পংক্তি মালা, বরং ধাক্কা খেয়ে গূঢ় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কবি তীরে বসে জীবনের বায়ু সেবন করেন। পাগল আছে, পাগলামি আছে, পাগলে পাগলে কোলাকুলি আছে, আবার নিজস্ব বলয়ে ফিরে আসার প্রবণতাও আছে। এই নিজস্ব বলয়ে ফিরে আসার রহস্যই অরণি বসুর কাব্যসত্য।
শরীর ইশারা দেয়। আড়মোড়া ভাঙে। সন্ন্যাসিনীর বিবাগি মন চায়। অন্তর রহস্যে আবার ফিরে আসে। রক্তে গার্হস্থ্যের খেলা চলে। বাইরে বেরিয়ে উদাসীন হয়েও আবার গৃহে ফিরে আস। এই যাওয়া-আসার দ্বন্দ্ব সোপানের যুগলবন্দিতে যে হৃদয়মন্থনের হলাহল ওঠে তা কবি গভীর বোধের চোরাবালিতে ধরতে চান। অন্ধকারের বিবমিষা থেকে তিনি আলোর খোঁজ করেন। চারিদিকে হতাশা, ক্লেদ রক্তাক্ত বিষণ্ণতা। ক্লান্তি, যন্ত্রণা ব্যর্থতার লম্বা লাইন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। অসহ্য অস্থির, ব্যর্থ হতে হতে কোন সমুদ্রে ডুব দেবে আমরা কেউ জানি না। প্রতীক্ষা করতে করতে কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে তার কোনো হাদিস নেই। তাই কবি ডাক দেন—
“হাসি পায়, উঠে আসুন, বন্ধুগণ, আপনারা তো জানেনই
অভিধানে প্রতীক্ষা শব্দেরই কাছাকাছু কোথাও
প্রতিশোধ শব্দেরও মানে লেখা আছে।” (‘প্রতীক্ষা নয় প্রতিশোধ’, তদেব, পৃ. ২৫)
ক্রোধ, রাগ, রাগী মানুষ, প্রেমহীনতা, অর্থহীনতা অরণি বসুর কবিতায় বড় পরিসরে প্রস্ফুটিত হয়। শান্ত, ভদ্র, লড়াইহীন, মুখোশ পড়া, মেকি, সভ্য, ডয়িংরুম বিলাসী জীবনের আড়ালে যে আরেক জীবন আছে, যে জীবনে চাওয়ার অনেক কিছু থাকলেও পাওয়ার কিছু নেই, সেই অস্থির জীবনের কবি অরণি বসু। তাই গোলাপের অপর পিঠে ভিখিরি থাকে, সৌন্দর্যের অপর পিঠে দুঃখ নাচতে থাকে, ভিখিরিরা গোলাপের সন্ধান পায় না, শুধু পথ থেকে ফোটা দেখে, ফুলের প্রহরী হয়ে ওঠে। জীবনের উলটো পিঠের কবি অরণি বসু। যে জীবন বেকারত্বের, অনাধুনিকতার (‘ঠেস’ কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে চরম ব্যঙ্গ কষবেন), অন্ধকারের, চাকুরিহীনতার, শহিদের, ক্লান্তির তাই তিনি নশ্বর বিন্যাসে ধরতে চান (সুধন্যরা অনেক কিছু চেয়েও না পেয়ে শহিদ হবে)। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে মহাপৃথিবীর রহস্য কী? কোথায় জীবন মশাইয়ের খেলা? হাসতে হাসতে দৈন্যতা ঢাকতে ঢাকতে শেষে বেরিয়ে আসে চোখে জল। মধ্যবিত্ত স্বল্প রোজগারি বাঙালির স্বাদ আহ্লাদের বহুকিছুই পূরণ হয় না। বহু কিছুই মুখ ফুটে বলে না। সমস্ত না পাওয়ার বেদনা নিয়েই কাটিয়ে দেয় দিবস-রজনী। দিন কেটে যায় বিস্ময়, নিজের বেঁচে থাকার ঘোরে। মানুষ হয়ে যায় ভিখারি। ব্যক্তির সীমাবদ্ধ চিন্তা চেতনা পরিসরে আটকে যায়। ব্যক্তি কোনোভাবেই প্রচলিত গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে না। অরণি বসুর ‘বাঘ’ হয়ে ওঠে সীমাবদ্ধতার প্রতীক। যা মানুষকে গণ্ডিতেই আটকে দেয়। পরশ পাথরের সন্ধান করা হয় না। এক ইউটোপিয়া যেন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বেড়ায়। সেখান থেকে ব্যক্তির মুক্তি নেই। নতুন কিছুর সন্ধান নেই। মূল্যবোধহীন, সুবিধাবাদী সময়ে প্রেম ভালোবাসা হয়ে উঠেছে যৌন সুখের মাধ্যম। কেবলই ভালোবাসার অভিনয় করে দেহজ কামনা। মাথার ভিতর কোনো বোধ নয়, চেতনা নয়, কল্যাণকর ভাবনা নয়, পাশাপাশি থেকে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার আত্মচেতনা নয় কেবলই দেহজ ক্ষুধা। সময়ের দোটানায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের চোরাবালিতে, প্রেমের হড়পা বানের প্রতিযোগিতায় কবি বিষণ্ণ হয়ে লেখেন —
“এই শহরে চর্তুদিকে অগুনতি মানুষের সাথে
অগুনতি মানুষীর প্রেম
তারাও আমার মতো মূর্খ, বোঝে শুধু সঙ্গসুখ
ভালোবাসার কিছুই বোঝে না।” (প্রসঙ্গ : প্রেম, তদেব, পৃ. ৩৭)
যে জীবন অন্ধকারের, ভাঙনের, প্রবাহহীনতার, অভিমানের, অভিশাপের, যে জীবনে প্রাপ্য বলতে শুধুই শূন্যতা বোঝায় অরণি বসুর নায়করা সেই পরিসরে বাঁচে। বাঁচে স্বপ্ন দেখে। বাঁচার অদম্য কামনা নিয়ে, প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অন্ধকারকে সঙ্গী করে ব্যর্থতার অপমানে পৌঁছে যায় নতুন ভোরে। সেখানেও অপেক্ষা করছে আরও বড় অন্ধকার। এই পৌঁছনোর জার্নিটাই জীবনের সত্য — আর তাই কাব্যময় ভাষায় কবি ধরতে চান। সমাজ-সময় পরিসরে কবিই যে বড় তা তিনি জানিয়ে দেন ‘সমাধিফলক’ কবিতায়। আজকের ধান্দাবিশ্বে, ধান্দাবাজির নোংরামিতে কবির সত্তা চেতনা নিয়ে নানা প্রশ্ন, সংশয় আসবে (সেই যে জীবনানন্দ দাশের অমোঘ বাক্য — সকলেই কবি নয়…)। কিন্তু প্রকৃত কবি তো জাগরণের প্রহরী হয়ে কাজ করে যাবে। নৈতিকতার পাঠ নয়, পাঠের অন্তিমে কোনো স্থির সত্য নয় তবুও অরণি বসু কবিতার শেষে একটা চেতনায়, একটা বার্তায় মানুষকে, পাঠককে পৌঁছে দিতে চান। নীতিও নয় নীতিমালাও নয় একটা জীবনবোধ যা কবিচেতনায় সত্য বলে ধরা দেয় তাই পাঠকের চেতনায় প্রবেশ করিয়ে দিতে চান মৃদুভাবে। সমস্ত নেই-এর মধ্যেও কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, সমস্ত ‘না’এর মধ্যেও কীভাবে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করা যায়, দাম্পত্য কলহ-বিবাদকে উপেক্ষা করে কীভাবে জলের মতো সহজ-সরলতায় বাঁচা সম্ভব তারই উপপাদ্য যেন ‘জলতরঙ্গ’ কবিতা। পারা-না পারা, পাওয়া-না পাওয়া, অভিমান-অনুযোগের সরণি ধরে অরণি বসু এমন এক জগৎ নির্মাণ করেন যেখানে সব হারিয়েও বাঁচা যায়। জাগতিক বোধ, চেতনা জাগিয়ে রেখেও পাশ্ববর্তী জগতে সদা প্রত্যক্ষ করেও, নষ্ট রিপুর ষড়যন্ত্রে জীবনের ক্ষত আবিষ্কার করেও বাঁচার প্রবণতা টিকিয়ে রাখা যায়। ঘটমান প্রবাহমান ভবচক্রের লীলা দেখতে দেখতে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগিয়ে যাওয়ার রহস্য মন্থন করেও সব কিছু থেকে বিচ্যুত হয়েও ব্যক্তি বাঁচতে পারে, বাঁচে, অরণি বসু সেই বোধের কবি। বিরোধাভাস, বিপরীত চিত্রকে সামনে রেখে সভ্যতার যে মুখোশ আবিষ্কার করেন ‘এখন যেখানে’ কবিতায় তার জুড়ি মেলা ভার। প্রতি পদক্ষেপে যেখানে গোপন ফাঁদ, আজকের মিত্র কাল যেখানে শত্রু, আজকের সহযোগী আগামী কালের প্রতিযোগী, আজকের সাহয্য কালকেই শোষণ, এইসব রহস্য দেখতে দেখতে কবি বক্তব্য প্রধান কবিতায় উপনীত হন—
“কেউ কারো বন্ধু নয়, শুধু নখ আর দাঁতের চর্চা
কেউ আত্মীয় নয় কারো, শুধু ভয় আর স্বার্থপরতা
বাজনা বলতে পেটের ওপর চাপড়,
শিল্প বলতে বাবুদের উঠোনে সম্মিলিত শিকল-পারা-নাচ।
আশ্চর্য, এখনও এখানে ফুলের চাষ হয়,
জন্মায় অজস্র শিশু, কেউ আমোদে-আহ্লাদে, কেউ প্রার্থনায়।” (এখন যেখানে, তদেব, পৃ. ৪৯)
অরণি বসুর কাব্যচেতনা জোরালো বক্তব্যময়। আপাত রোমান্টিকতার বাইরে সভ্যতার গোলকধাঁধাকে তিনি সরাসরি বলেন, বলতে ভালোবাসেন। আটপৌর শব্দবিন্যাস, হেঁয়ালিহীন অর্থে, রূপকের বাইরে, অলংকার সজ্জাকে অতিক্রম করে দৈনন্দিন সত্য আবিষ্কারে মত্ত থাকেন। দিন-রাতের সৌরভ আকাশভরা সূর্য তারায় ধরা দেয়। সমাজ, সামাজিক চাহুনি-দৃষ্টি মানুষকে বিকারগ্রস্ত করে। মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার উপর আঘাত আনে। অথচ সমাজ, সামাজিক পরিসর মানুষকে কিছু দেয় না। বরং পাঠিয়ে দেয় মানসিক হাসপাতালে (‘নষ্ট’ কবিতা)। বেঁচে থাকাটাই একটা ঘোর, বিস্ময়। সমস্ত গুছিয়ে তুলতেই মানুষের এসে যায় যাবার মুহূর্ত। সমস্ত পুরাতন ক্যানভাসে বাঁচতে বাঁচতে এসে যায় নতুন ঠিকানা (মৃত্যুর)। অথচ মানুষ আগন্তুক হয়ে নিত্য কাজ করে চলছে। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে উদগ্রীব। যাপনের সত্য থেকেই অরণি বসুর কাব্য সত্য প্রতিফলিত হয়। কোনো উচ্চ দর্শন, অলীক কল্পনাজাল, বড় পরিসর নয় নিজের ক্ষুদ্র বিশ্বের ছোট ছোট সত্য থেকেই জীবন মন্থন করে কাব্যের অলীক জালে পাঠককে ভাসাতে চান। এক অপরাধ বোধ, পাপ বোধ, ঘৃণা বোধ নায়ককে প্রায়ই দংশন করে। বাঁচার সত্য খুঁজে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কেবলই রহস্য নির্মিত হতে থাকে। মৃত্যুযন্ত্রণা আনে কিন্তু মরণ হয় না। মৃত্যুভয় যেন আবার জীবনকে লড়াইয়ে নামায়। সেখানেও এক গোলকধাঁধা অপেক্ষা করে। এই জীবনের চোরাবালিতেই অরণি বসু কাব্যের ফুল ফোটান।
নির্মাণ থেকে বিনির্মাণে যাওয়া যেমন সহজ নয় তেমনি প্রত্যাবর্তনে ফেরাও সহজ নয়। নিজেকে ভাঙা, নির্মাণ করা এক দুরূহ কাজ। মানুষ বাঁচার অভিপ্রায়ে প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়। কখনও নিজেকে ভেঙে নব নির্মাণে প্রস্তুত হয়। কিন্তু সেই পথ সহজ নয়। তবুও মানুষের এই প্রক্রিয়া চলে। অন্তর্বিশ্বে দ্বন্দ্ব চলে। রোমন্থনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতেও মানুষ হেরে যায়, হারার সমীকরণে নতুন চেতনা জাগে — সেই বহুকৌণিক বিন্যাসকেই অঙ্কন করে চলেন কবি। তিনি হতাশাকে নিভিয়ে দিতে চান নয়নের নীরে। অপমানের মালা গলায় পরেও বঞ্চনা, পরশ্রীকাতরতাকে বিসর্জন দিতে চান সমুদ্রে। সমস্ত ‘না’র মধ্যে বাঁচার বিশল্যকরবী আবিষ্কার করতে চান দৃপ্ত চেতনায় — ‘টুসকি মেরে উড়িয়ে দাও হতাশার দীর্ঘশ্বাস’। যাবতীয় অভিলাস, অনুসন্ধান, উপলব্ধির মধ্যে লুকিয়ে আছে নঞর্থক বোধ, বিরোধাভাস। কোনটাই পূর্ণ নয়। কোনটাই একাগ্র ভাবে এক পক্ষ নয়। সমস্ত অনুভূতিই মিশ্রিত। সেই মিশ্র সভ্যতার অনুরণন বাজিয়ে তোলেন ‘রূপান্তর’ কবিতায়। জিজ্ঞাসা, আত্মজিজ্ঞাসা, প্রশ্ন, সত্তা-দ্বিখণ্ডিত সত্তা সমস্ত মিলিয়ে কবির সংশয়ী মনন নিজেকেই যেন এক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এই চরাচরের যাবতীয় অন্ধকারের কূল কিনারা করতে না পেরে, যেখানে বাঁচাটাই প্রশ্নহীন, অর্থহীন, যে পাঁক সমুদ্রে কোথাও শুভবোধের ইশারা নেই সেখানে মানুষ কোন অভিলাসে নিয়ে বাঁচবে? নেই কোন উত্তর। নেই কোন পরিত্রাণ। কেবলই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি আমরা, আমাদের সময়। সেই দিকহারা সময়ের কুণ্ডলিকেই তিনি এঁকে চলেন।
যে সময়ে বেঁচে থাকাটাই একটা বিভ্রম, অরণি বসু সেই সময়ের কবি। আমরা কিসের অপেক্ষায়, অভিলাসে বেঁচে আছি নিজেরাই জানি না। জানতে গিয়েও উত্তর মেলে না। কে দেবে উত্তর? তবুও বাঁচি। মানসসুন্দরীর মতো কেউ কেউ ইশারা দেয়। রক্তে বোধের নাচন নাচিয়ে দেয়। ‘উন্মাদিনীর হাসি’ পথহীনকে পথ দেখায়। সবই আপতিক। তবুও তো বেঁচে আছি। দ্বিধায়-সত্যে-মিথ্যায়-শিল্পকলায়। সেই স্তিমিত সময় যা ব্যক্তিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, উইপোকার মতো দংশন করতে করতেও কিছু অবশিষ্ট রেখে যায় সেই ভাঙাচোরা সময়ের কবি অরণি বসু। অন্ধকারে জড়িয়ে জড়িয়ে নিঃসঙ্গতায় দংশনক্ষত হতে হতে মানুষ পথ হারায়। অরণি বসু প্রবলভাবে অন্ধকার চিত্রকল্পে, কাহিনিকল্পে নেমে আসেন। চারিদিকে যেন পরিকল্পিত ছায়াজাল। যেখান থেকে মানুষের মুক্তি খুঁজে পাওয়া ঢের বেশি শক্ত। তাই গাঢ় অন্ধকারের চক্রে মানুষকে নামিয়ে ঘুরপাক খাইয়ে, জীবনের ক্লান্তিকর মুহূর্তে জীবনের বিষাদ উপলব্ধি করিয়ে আলোয় ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখান। সেই উত্তরণের পথে বহু চিত্র, উপচিত্র, বোধ, সমীকরণ অলিগলির বিন্দু বিসর্গ থাকে, সেই পথটিই অরণি বসুর অন্বিষ্ট। জীবনের গভীর ক্ষোভের ভেতর থেকে তিনি জীবনেরই জয়গান গেয়ে যান। জীবন নদীর মাঝ বরাবর যে চওড়া খাদ তা অতিক্রম করে জীবনের রসদ কুড়িয়ে নিতে চান। তাই সমস্ত নঞর্থক বোধগুলি দূরে রেখে উচ্চারিত হয় —
“চোখ নামিয়ে নি, আমি এখনই মরতে চাই না
আমার এখনও অনেক যোগাযোগ বাকি রয়ে গেছে
আমি সমস্ত প্রাণীর সঙ্গে, বৃক্ষ ও তরঙ্গের সঙ্গে
নিশ্বাস-প্রশ্বাসময় মানুষষের সঙ্গে, এমনকী মৃতদের সঙ্গেও
যোগাযোগ করতে চাই।
আমি তাদের প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা কবিতে লিখে
রেখে যেতে চাই” (অস্পষ্টতার বিরুদ্ধে, তদেব, পৃ. ৮৩)
বাঁচার জন্য তীব্র আকুতি, জীবনের প্রতি অদম্য ভালোবাসা, পৃথিবীর সৌন্দর্য উপলব্ধির অনেকান্তিক ইচ্ছা অরণি বসুর কবিতায় বড় পরিসরে ব্যাপ্তি লাভ করে। তিনি পুড়তে ভালোবাসেন, ভালোবাসার আগুনে পুড়তে চান। বিষাদের আগুনে পুড়ে যেতে চান। ভালোবেসে ফকির হতে চান। তবুও অবিশ্বাস সন্দেহ জেগে ওঠে না। কাউকে দোষারোপ করতে রাজি নন। এক বিস্ময়, আত্মচেতন মন, সংবেদনশীল অনুভব ও সমস্ত থেকে বিচ্যুত হয়েও বাঁচতে চান। জীবন মীমাংসাহীন। নীরবতা না কোলাহল কোনটা চায় সে নিজেই জানে না। বৈরাগ্য হতে চেয়েও জীবনের কাছে ফিরে আসে। আবার তীব্র বাঁচার আকুতি নিয়েও সংসার ত্যাগ করে। নির্জনতায় ভেসে যেতে গিয়েও কোলাহলে মিশে যায়। আবার কোলাহল থেকে মুক্তি চাইলেও ঘটে না। এই তীব্র বিরোধাভাস অরণি বসুর কবিতার মূল সুর। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত জীবনের কবি বলে অরণি বসুকে দেগে দেওয়া যাবে না। যাবে না প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে কবিকণ্ঠকে। রোমান্টিসিজম বা আপাত আবেগ আঘাতেরও তিনি কবি নন। শূন্যতা-পরিপূর্ণতার দোলায় তিনি জীবন মন্থনের কবি। বোধ-চেতনার কবি। বাউলের চেতনা নেই। কিন্তু সহজ সুরে সরল বিশ্বাসে জীবনের কাব্য তিনি ঝরাপাতার সুরে চিহ্নিত করেন। যে জীবন মেনে নেওয়ার, যে জীবন ভালোবেসে স্বার্থ ত্যাগের, যে জীবন পূর্ণতার কাছে গিয়েও শূন্যতার অভিমুখে যাত্রায় বিশ্বাসী, যে জীবন নিন্দা-লাঞ্ছনাকে উপেক্ষা করে নিজস্ব অসীম আনন্দ উপলব্ধির, অরণি বসু সেই পরিসরের কবি।
তিনি নিজের চৈতন্যের জাগরণ ঘটাতে চান বারবার। আত্মসংকটের দৈন্যতা অতিক্রম করে আত্মজাগরণের মৃদু বিস্ফরণে আত্মনিয়োগ করেন। পরিসর ভেঙে নতুন পরিসরে যাবার প্রবণতা যেমন লক্ষণীয় তেমনি নতুন মানুষ সন্ধানে অগ্রসরমান। কবি ‘শিব’ খোঁজেন, আসলে বহুরূপী মানুষের মধ্য দিয়ে সত্য খোঁজেন। ভাঙাচোরা, অন্ধ, ভঙ্গুর, পিছিয়ে পড়া মানুষের দৈন্য, সংকট নিয়ে তিনি যেমন ভাবেন তেমনি ফুলের সত্য গানের ভুবনে কতটা কার্যকর তা স্পষ্ট করেন। চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণে সকলেরই বাঁচার অধিকার আছে, সকলেই পৃথক পদ্ধতিতে বাঁচতে চায়, সেই বাঁচা অন্যের দৃষ্টিতে অনৈতিক, অর্থহীন, সেই বিশ্বাস কবিতার অবয়বে ধরা দেয়। মানুষকে আয়ব্যয়ের হিসেব করতে হয়। জমা খরচের খতিয়ান স্পষ্ট করতে হয়। নিজস্ব পরিসরে জমা খাতায় ভিড় উপচে পড়লে ত্যাগের মায়া বাড়াতে হয়। স্থানাভাবে কতকিছুই আমরা বিসর্জন দেই। আবার সব আঁকড়ে ধরে রাখাও সমীচীন নয়। পরিসর ভাঙতে ভাঙতে কিছু উড়িয়ে দিতে হয়। কবির আর দেবেন ঠাকুর হওয়া হয় না (কল্পতরু কবিতা)।
তিন
প্রথম দুটি কাব্য (‘শুভেচ্ছা সফর’, ‘লঘু মুহূর্ত’) যে বোধ চেতনার জাগরণ তা অনেকটাই কমে এসেছে শেষ কাব্যগুলিতে। মরচে পড়া পেরেকের গানের মতো শব্দের ঔজ্জ্বল্য কোথায় যেন মিইয়ে যাচ্ছে। বোধের বদলে রোমান্টিকতা, সহজ চালচিত্রের রামধনু হয়ে ওঠে। ‘শুভেচ্ছা সফর’ (১৯৮৭), ‘লঘু মুহূর্ত’ (১৯৯২) কাব্যে কবি চেতনার যে উদ্দীপনা (যা স্বতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়) তা যেন পাচ্ছি না ‘খেলা চলে’ (২০১৯) কাব্যে এসে। সাধারণ বাক্য বিন্যাস, সাধারণ সজ্জার মধ্যে দুই চারটি হীরক বিচ্ছুরণ ছিটিয়ে দিয়ে যেন দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। ‘কথা ১’, ‘কথা ২’ কবিতাগুলি সহজ সমীকরণের বহিঃপ্রকাশ হয়ে দাঁড়ায়। পাগলের প্রকারভেদ আছে। কেউ কেউ পাগলের ভান সেজে সব গুছিয়ে নিয়েছে, কেউ কেউ ব্যর্থ হয় এই শহরের পথে ঘুরে বেড়ায়। নষ্ট সময়ে মানুষ যখন পাগলের পাগলামিতেও আর বিশ্বাস রাখে না, এড়িয়ে যায়, তখন শহরে পাগলের সংখ্যা কমে আসে। শেষপর্বে এসে মৃত্যুচেতনা, শৈশবের অন্ধসন্ধানে ভেসে যান। নস্টালজিক মনে স্মৃতিকাতর অনুভূতি কবি কলমে ভাষা সঞ্চার করে। বোধের বিন্দু থেকে সরে গিয়ে কলম আপাত হালকা চালে মৃত্যুর রং, জীবন-মৃত্যুর দোলায় ভালোবাসার স্মৃতি সঞ্চারে অগ্রসর হয়। ‘বালাই ষাট ও সত্তরের একজন’ হয়ে ওঠে স্মৃতিচিহ্নের ভাস্কর। শেষপর্বে বক্তব্য চরিত্রের আড়াল খোঁজে। বলা ভালো চরিত্রকে সঙ্গী করে (দেবারতি মিত্র, মণীন্দ্র গুপ্ত, ভাস্কর চক্রবর্তী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মানিক চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গজেন্দ্রনাথ মিত্র) কখনও একান্নবর্তী সংসার, অখণ্ড সত্তা, বাঙালিয়ানা (‘মল্লিকা’, ‘গামছ’ কবিতা) প্রতিষ্ঠায় নিমগ্ন থাকেন। মৃত্যু বলয়, মৃত্যুর অশৌচ বৈরাগ্য ত্যাগ করে নতুন করে বাঁচা, আবার কখন পলাতক মানসিকতায় (যে স্মৃতিতে রংমশাল, শুকতারা জীবন্ত) দুলতে দুলতে কবি সিন্ধুপারে চলে যান। স্থির চেতনা অপেক্ষা অবয়ব ভাঙা-গড়ার খেলায় তিনি মত্ত থাকেন। তবে অপ্রকাশিত কবিতাবলির কোনো কোনো কবিতায় আবার স্বমহিমায় ফিরেছেন। চলান্তিক শব্দে, সজ্জায় বাজার চলতি সংস্কৃতিকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। রবীন্দ্র সংস্কৃতির নামে লুচ্চামি, বাজার ধরার প্রতিযোগিতায় আনন্দবাজারীয় কায়দা, কৌশল, ভাষাগত বয়ান, প্রচলিত সাংস্কৃতিক পরিসরে ডুবে যাওয়া অন্ধ বিশ্বাসের মূলে সূক্ষ্মভাবে আঘাত আনতে সচেষ্ট হয়েছেন।
অরণি সরণিতে পাঁচটি স্টপেজে স্পষ্ট প্রভেদ লক্ষ্য করা যাবে। বলা ভালো এক বোধ থেকে আরেক বোধের সমুদ্রে উত্তরণ ঘটেছে। অন্ধকার থেকে মৃত্যুচেতনা, জীবনের কাছে ফিরতে ফিরতে মৃত্যুর দরদাম, সব পাবার পরেও প্রেম প্রত্যাশা কবিকে স্বতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে দেবে। শব্দের অস্পষ্টতা, জটিলতা, অভিধান প্রবণতা নেই। যে জীবন হালকা মেজাজের, কথা বলতে বলতেই এক মেঠোদর্শনে সত্য খোঁজা প্রয়াস, না পেলেও হতাশ নয়, সেই রহস্যে তিনি ভেসে বেড়ান। তিনি টুকরো মুহূর্তকেই ধরতে চান, বড় ক্যানভাসে কবিতা যায় না, আবার সেই টুকরো খণ্ডের মধ্যেই জোনাকির মতো একটা আলো জ্বালিয়ে দিয়েই বিদায় হন। সেই নিয়ন আলো থেকে জীবনকে যেটুকু দেখতে পারা যায় পাঠকের কাছে অরণি বসু সেই সারসত্যের কবি।
লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।