সংস্কৃতে দোহলী শব্দের অর্থ অশোকগাছ। তা থেকেই প্রাকৃতে দোঅলি ও বাংলায় দোল। দো লুপ্ত হয়ে অপভ্রংশে হয়েছে হলী, হোলী বা হোলি। যদিও হোরি থেকে থেকে হোলি এসেছে বলেও একটি মত আছে।
গর্ভবতী নারীকে সাধভক্ষণ করানোর সময় অতীতে নাকি অশোক গাছের ডালের দরকার পড়তো।
রবীন্দ্রনাথ কবিতায় লিখেছেন, পুরাকালে নাকি অশোকবৃক্ষে নারীর চরণস্পর্শে ফুল ফুটে উঠতো।
আর সকাল থেকে কানের কাছে বাজতে থাকা ‘তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রং লাগল আমার অকারণের সুখে’ তো কান ঝালাপালা করে দিল। কাছের হাউসিং কমপ্লেক্স থেকে পাড়ার মোড়, সেই এক গান!
ভাগ্যিস, সিদ্ধার্থ লুম্বিনীর এক অশোকতরুর নিচে জন্মেছিলেন! তাই তাঁকে এই গনগনে গানের সামনে পড়তে হয়নি। অশোক গাছ হিমালয়ের পাদদেশেও জন্মায়। লুম্বিনীতেও তাই প্রচুর অশোকগাছ ছিল।
ভারতীয় ইতিহাস তথা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ঋতুবৈচিত্র্যের উপস্থিতি চিরকালীন। পাঁচ হাজার বছরের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যে ঋতুকেন্দ্রিক অসংখ্য উৎসব, পূজার্চনা এমনকি সঙ্গীতচর্চার ধারাও অব্যাহত রয়েছে। ভারতীয় তথা উপমহাদেশীয় সাহিত্যে ঋতুচক্রের যে অসামান্য ধারা বিবরণ পাওয়া যায় তার মধ্যে থেকে বসন্ত বর্ণনার স্থান অগ্রগণ্য। তন্ন তন্ন করে এই সাহিত্যের গহীনে ডুব দিয়ে এক অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর সমাপতন লক্ষ করা যায়; প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সাহিত্যে পৌঁছেও দেখা যায় উপমহাদেশীয়, বিশেষত ভারতীয় সাহিত্যে বসন্ত আর অশোকবৃক্ষের অপরিমেয় ব্যবহার এবং বলা বাহুল্য, সে ব্যবহার রীতিমতো ধ্রুপদী আখ্যানের দাবি রাখে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে ভারতে যে বৈদিক যুগের সূচনা হয় তাতে প্রকৃতি আরাধনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদে অসংখ্য ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের উল্লেখ পাওয়া গেছে, অশোকের উল্লেখ রয়েছে সঙ্গত কারণেই। সেখানে অশোকবৃক্ষকে প্রজননের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে দেবী গৌরীর তপস্যাস্থান হিসেবে অশোকবৃক্ষকে চিহ্নিত করার কাহিনী জানা যায়। দেবী এই বৃক্ষের নীচে তপস্যার মাধ্যমে যাবতীয় শোক থেকে মুক্তি লাভ করেন তাই এই বৃক্ষ অশোক। রামায়ণে সীতার লঙ্কাবাসের স্থল এই অশোকবাটিকা। আদি কবির বর্ণনায় সেই বনের যে অপরূপ শোভা মানসচক্ষে প্রস্ফুটিত হয় কাব্যসাহিত্যে এক কথায় তা তুলনারহিত।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে জনৈক শিবাচার্য নামক প্রয়াগনিবাসী কবি রচনা করেন ‘শ্রীরাধা কৃপাস্তোত্র’। সেখানে তিনি শ্রীরাধার অঙ্গশোভার বর্ণনা দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছেন, —
অশোকবল্লরীসম শরীরোত্তম শোভিতে
প্রবালজ্বালকুসুম প্রভারূণাঙ্ঘি কোমলে।।
বরাভয়স্ফুরত্করে প্রভূতসম্পদালয়ে
কদা করিষ্যসীহ মাং কৃপা-কটাক্ষ-ভজানম্।।
অর্থাৎ আদি-মধ্যযুগের ভারতীয় কাব্যসাহিত্যে এই অশোকবৃক্ষকে এতখানি মহিমান্বিত স্থান দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে নারীর সৌন্দর্যকে তার নান্দনিকতার সঙ্গে তুলনা করা হয় নির্দ্বিধায়। অশোকবৃক্ষের মহানতার দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে বৌদ্ধ সাহিত্যেও। লুম্বিনী উদ্যানের যে তরুতলে সিদ্ধার্থের জন্ম হয় তা ছিল এক সুবিশাল রাজ অশোকবৃক্ষ। এর পত্রগুলির রং লালচে গোলাপি, পাতার মুখ ডিঙিনৌকোর মতো সূচালো। অপূর্ব শোভা বিশিষ্ট এই পুষ্প, জন্মমাত্রেই শিশু গৌতমের নেত্রের উপর পতিত হয়েছিল বলে বর্ণিত হয়েছে ধম্মপদের পুষ্পবর্গ অধ্যায়ে—
ন পুপফগন্ধো পটিবাতমেতি ন চন্দনং।
সতঞ্চগন্ধো পটিবাতমেতি নেত্রঃ দিসা পতিতঃ রক্তপল্লবক্। (রক্তপল্লবক্ – লাল পুষ্পবিশিষ্ট অশোকবৃক্ষ)
এই বর্ণনা কেবলমাত্র ঘটনার ঘনঘটা নয় বরং অশোক পুষ্পের সঙ্গে শিশু গৌতমের চক্ষুযুগলের সমরূপতার অসামান্য কাব্যিক প্রকাশ।
প্রাচীন সাহিত্য থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে আমরা যদি আধুনিককালের সাহিত্যে প্রবেশ করি তবে সেখানেও আমরা অশোকবৃক্ষ প্রকারান্তরে বসন্তঋতুর অত্যাশ্চর্য ব্যবহার লক্ষ করব। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় পুষ্প যে অশোক, আশ্রমের দিকে দিকে তার বিপুল উপস্থিতি অতি সহজেই সেই সাক্ষ্য বহন করে।
“রাঙা হাসি রাশি রাশি/অশোকে পলাশে”— থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনাতেই এই ফুলের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্র কবিতাতেই উল্লেখ রয়েছে পুরাকালে নাকি অশোকবৃক্ষে নারীর চরণস্পর্শে ফুল জেগে উঠত! এমনকি সাধারণ রসিকতাতেও কবি এই গাছের প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রমথনাথ বিশীর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে দেখা যায়, কবি ছাত্রকে রসিকতা করে বলছেন, “জানিস, একসময়ে এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্নসহাকারে লাগিয়েছিলাম? আমার ধারণা ছিল এটা অশোকগাছ; কিন্তু যখন বড় হল দেখি ওটা অশোক নয়, গাবগাছ।” অতঃপর তিনি প্রমথনাথের দিকে সরাসরি তাকিয়ে স্মিতহাস্যে যোগ করলেন, “তোকেও অশোকগাছ বলে লাগিয়েছি, বোধকরি তুইও গাবগাছ হবি।”
অশোকবৃক্ষের প্রতি এই পক্ষপাতিত্ব অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও লক্ষ করা যায়। ১৯৮৪ সালে কোটা শিবরাম কারান্থ রচিত কন্নড় ভাষার প্রবাদপ্রতিম উপন্যাস ‘আলাদি মেলে’ [মৃত্যুর পর]-তে উল্লেখ রয়েছে স্বর্ণ অশোকের। কন্নড় ভাষায় যার নাম ‘কঙ্গেলি’। শুধুমাত্র উল্লেখ নয়, কাঁচা হলুদ বর্ণের ফুলে লাল বেদানার মতো ফুটে থাকা গুটি সম্পন্ন, বিস্ময়কর সৌন্দর্যশালী এই পুষ্পবৃক্ষটি উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের কাজ করেছে। উপন্যাসটির নায়িকা চিরুয়ার জীবনচক্রের সঙ্গে স্পন্দিত রয়েছে গাছটির অস্তিত্ব। প্রতি বসন্তের সমাগমে চিরুয়া এবং অশোকবৃক্ষ যেন একসঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়। আবার বসন্তের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চিররুগ্ন নায়িকা রোগশয্যায় চলে যায় এবং একই সঙ্গে সমস্ত ফুল ঝরে গিয়ে পুষ্পহীন গাছটিও যেন গ্রহণ করে স্বেচ্ছা নির্বাসন! গোটা উপন্যাস জুড়ে স্বর্ণাশোক বৃক্ষটি পুরুষপ্রতীক। চিরুয়ার সঙ্গে তার নৈসর্গিক রতিক্রিয়ার যে বিবরণ উঠে আসে উপন্যাসে তাতে শিহরিত হতে হয়! প্রকৃতি ও মানবীয় রমনক্রিয়ার এ এক মোহনীয় জাদু বাস্তবতার [Magic realism] অসামান্য বর্ণনা।
মরাঠি ভাষায় ১৯৬৩ সালে ভালচন্দ্র নেমাড়ে রচিত ‘কোসলা’ [Cocoon] একটি প্রবাদ হয়ে যাওয়া উপন্যাস। এক অন্ধ ব্যক্তি নিজস্ব পরিসর ও চেতনার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে থাকতে ক্রমশ প্রকৃতির সংবেদনাগুলিকে অনুভব করতে শুরু করে। সর্বপ্রথম যে বৃক্ষের সঙ্গে তাঁর স্পর্শবিহ্বলতা তৈরি হয় সেটি পুষ্পহীন এক অশোকবৃক্ষ! ঘন ধূসর বর্ণের বৃক্ষের বল্কলে হাত রেখে সে শুনতে পায় নিসর্গের ক্রন্দন। এই কান্না প্রকৃতপক্ষে চরিত্রটির অন্তর্নিহিত বেদনার প্রতীকস্বরূপ। জীবনের যাবতীয় পরাজয়, লড়াই, বঞ্চনার কাহিনি মানুষের হৃদয় থেকে বৃক্ষশরীরে সঞ্চারিত হয় স্পর্শের মাধ্যমে। লেখকের ভাষায়, “রঘুবা ধীরে ধীরে অশোক গাছটির নীচে এসে দাঁড়ায়, হাত রাখে আলতোভাবে। এক অদ্ভুত শিহরণ! সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে, কান্নার শব্দ। সে কাঁপতে আরম্ভ করে; যেন তাঁর সমস্ত শরীর, শিরা-উপশিরা, কৃষ্ণবর্ণ দেহ হয়ে উঠছে অশোক গাছটির মতো বিরাট, বিপুল। কিন্তু পুষ্পহীন! রঘুবা গাছটিকে প্রাণে আঁকড়ে ধরে, এই একটি জায়গায় এসে তাঁরা মিলে গেছে—তাঁদের কোন সৌন্দর্য নেই।”
মানবচক্ষু ও বৃক্ষপুষ্পের সৌন্দর্যদর্শনের এমন অভিনব বিবরণ ‘কোসলা’-কে আধুনিক ভারতীয় উপন্যাসে ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা প্রদান করেছে।
হিন্দি কবিতাতেও এই বৃক্ষটির উপস্থিতি প্রবলভাবে উল্লেখিত। বিংশ শতকের প্রখ্যাত হিন্দি কবি কাশীনাথ চৌহানের ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘আকেলা অশোকবৃকস্ অউর কসবী কী রাতেঁ’ [একাকী অশোকবৃক্ষ ও নিষিদ্ধপল্লীর রাত্রিগুলি] কাব্যোপন্যাসে এক অভূতপূর্ব প্রতীকীবাদের (Symbolism) দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। মধ্যপ্রদেশের একটি ছোট্ট জনপদের প্রান্তসীমায় নির্দিষ্ট ‘কসবী’ বা নিষিদ্ধপল্লীটি অবস্থিত। চল্লিশটি ঘর নিয়ে গঠিত পল্লীটির মাঝখানে দণ্ডায়মান এক দীর্ঘ অশোকগাছ। এই গাছের মূলে একদা আবির্ভূত হয়েছিলেন লিঙ্গদেব; ফলস্বরূপ শতাব্দীর পর শতাব্দী এই অঞ্চলের রমণীরা বৃক্ষসহ লিঙ্গদেবকে ঈশ্বররূপে অর্চনা করে আসছেন। এই অশোকগাছই তাঁদের রক্ষাকর্তা। সেখানকার নারীদের বিশ্বাস, বসন্তের বাতাসে ওই গাছে যে রক্ত পুষ্পের সঞ্চার ঘটে—তা তামাম জনপদের সৌভাগ্যের প্রতীক। এবং সেইসঙ্গে প্রতি বসন্তে ওই বস্তিতে জন্ম নেয় একটি করে নবজাতক। তাদের বিশ্বাস, যেদিন বৃক্ষটির সমস্ত শাখায় ফুল ফুটে উঠবে সেদিন পল্লীর প্রতি ঘরে ঘরে পবিত্র শিশুর জন্ম গ্রহণের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হবে। একটি কবিতায় কাশীনাথ লিখছেন,
“অশোক কী বৃকস কে পাশ
ইস্ সামান্য বস্তি মেঁ
আজ ফির রাত ঘনানে লগে,
শুনো, এক গহরী আওয়াজ়
জীবন কা সম্বাদ লে কর্
ফ্যাল রহা হ্যায় রক্ত পুষ্প কী তরহা”!
বাংলা তর্জমায় কবিতাটি —
অশোক বৃক্ষের পাশে
এই বস্তির ভিতর
আজ ফের রাত্রি ঘনায়
শোনো, এক গভীর আওয়াজ —
জীবনের সংবাদ হাতে
রক্ত পুষ্পের মতো ছড়িয়ে যায়।
ঈশ্বরচেতনা, জীবন ও সমাজভাবনা থেকে শ্রেণি-বৈষম্যতার ব্যাখ্যান, লিঙ্গবিভাজন পাশাপাশি আঞ্চলিক মিথের [Myth] অভাবনীয় ব্যবহারে এই কাব্যোপন্যাসটি ভারতীয় সাহিত্যে হয়ে উঠেছে অনন্য সৃষ্টির দাবিদার।
দীর্ঘদিন ধরে যে হিন্দি ঔপন্যাসিককে পাঠ করতে গিয়ে পদে পদে বিস্মিত হতে হয়, থমকে যেতে হয়, বাকরুদ্ধ হতেও হয়,- তিনি নীলকণ্ঠ চৌবে। তাঁর অসামান্য সৃষ্টিগুলির মধ্যে ২০০৪ সালে প্রকাশিত, ‘পাত্থরোঁ কী ঝোপড়ি অউর বৌনা পাহাড়’ [পাথরের কুটির ও বামন পাহাড়] অন্যতম। অত্যন্ত ছোটো ছোটো বাক্যে নির্মিত এই উপন্যাসটি মূলত ভারতীয় নিসর্গচেতনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। উত্তর ভারতের প্রান্ত ঘেঁষে ছোট্ট এক পাহাড়ি জনপদের কাহিনী। পিতৃমাতৃহীন এক কিশোর তাঁর দিদিমার কাছে মানুষ হতে থাকে। বড়ো হতে হতে সে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মাপতে থাকে আর কত বড়ো হলে পাহাড়ের মাথার সঙ্গে তার মাথা এক সরলরেখায় আসবে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে অনেক নীচে সমতলে চলে আসে। সেখানে পাশাপাশি দুটি নাতিদীর্ঘ অশোকবৃক্ষ। অতি শৈশবে এক বর্ষণমুখর মধ্যাহ্নে তাকে কোলে রেখে এখানেই তার মাতা-পিতার আলিঙ্গন দৃশ্য মনে পড়ে। গাছদুটি যেন তাঁদেরই প্রতিভূ আর বামন পাহাড়—যার কোলে তার লালন-পালন, সে যেন বৃদ্ধ দিদিমা! ছোট্ট শিশু থেকে কিশোর থেকে যুবক–দিন হতে রাত্রি, পাহাড় থেকে সমতল থেকে আবার পাহাড়ি জনপদে প্রত্যাবর্তনে কেটে যায়। সেই সঙ্গে বদলে যেতে থাকে পাহাড়ি জনপদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। উপন্যাসটির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে লেখকের আশ্চর্য ভাষাশৈলীর অনুপম নিদর্শন। এক কিশোরের দৃষ্টি থেকে পার্বত্যপ্রকৃতির যে বর্ণনার নির্মাণ তিনি করেছেন তাতে বিহ্বল হতে হয়। নীলকণ্ঠ লিখছেন, “বল্লু অশোকগাছদুটিকে দেখে। দাঁড়ায়। গোধূলির মগ্ন আলোয় সেই গাছের ছায়া থেকে অসংখ্য সবুজ মথ বেরিয়ে এসে ওর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি পথে ফিরতে থাকে। বল্লু দু-একটি মথ হাতের মুঠোয় ধরে নেয়, রক্তিম ফুলের রেণু তার ভিতরের মায়াকে স্পর্শ করে। কোমলতা স্পর্শ করে কাঠিন্যকে।”
ভারতীয় সাহিত্যের পাশাপাশি আধুনিক সিংহলি সাহিত্যেও এই উপাদান বিরাজমান। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শ্রীলঙ্কায় অশোকগাছের চাষাবাদ আরম্ভ হয়েছে, ফলে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির আর্থ-সামাজিক চরিত্রে গাছটির প্রভাব যথেষ্ট। এর পাতা, ফুল ও ছাল থেকে চর্মরোগ, হৃদরোগ নিরাময় ছাড়াও যৌনক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ঔষধ প্রস্তুত হয় বলে জানা যায়। সুতরাং ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে এই বৃক্ষচাষ নিয়ে ঘটে চলেছে অসংখ্য ঘটনা। আর সেই সমস্ত প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে সিংহলি ভাষায় সুগাথাপালা ডি-সিলভা, সিরি গুণসিংঘে, কে. জয়তিলক-এর মতো বিখ্যাত লেখকেরা লিখেছেন উপন্যাস ও ছোটোগল্প।
সুতরাং আজ আর এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, সুপ্রাচীন সময়ের কিংবদন্তির অশোকতরু সাহিত্য তথা আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতির শাখাপ্রশাখায় ভর দিয়ে প্রকৃতির এক অমোঘ প্রতীকরূপে এই উপমহাদেশীয় সমাজচেতনায় বিরাজমান। তার উপস্থিতি নীলকণ্ঠ চৌবের উপন্যাসের সেই কিশোরের মতো, যে সেতু হিসেবে বন্ধন তৈরি করে উচ্চ ও নিম্নভূমির। আর চিরযৌবনের নিসর্গপ্রতীক হিসেবে উল্লেখিত অশোকবৃক্ষ নির্মাণ করে মানব ও প্রকৃতির বাঙ্ময় উত্তরাধিকার; যে অধিকার থেকে মানুষ আজও বৃক্ষদেবতার সম্মুখে নতজানু হয়, তার প্রাণকে গ্রহণ করে নিজস্ব বিশ্বাসের ভিতর… অহরহ, নিরন্তর।
কাজী নজরুল ইসলামও অশোকের কথা লিখে গেছেন। এই বহুশ্রুত নজরুলগীতিটিতে হোলি খেলায় মত্ত রাধাকৃষ্ণের রূপসজ্জায় অশোক ফুল শোভা পাচ্ছে —
ব্রজ–গোপী খেলে হোরী
খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে।
রাঙা অধরে ঝরে হাসির কুম্কুম্
অনুরাগ–আবীর নয়ন–পাতে।।
পিরীতি–ফাগ মাখা গোরীর সঙ্গে
হোরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে।
বসন্তে এ কোন্ কিশোর দুরন্ত
রাধারে জিনিতে এলো পিচ্কারী হাতে।।
গোপিনীরা হানে অপাঙ্গ খর শর ভ্রুকুটি ভঙ্গ
অনঙ্গ আবেশে জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।
শ্যামল তনুতে হরিত কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রঙ–পিয়াসি মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রঙ প্রেম–যমুনাতে।।
আমাদের সদ্যপ্রয়াত সাহিত্যিক কমলকুমার চক্রবর্তীকে তো বৃক্ষনাথ বলেই ডাকা হত। ভালোপাহাড়ের স্রষ্টা এই যুগন্ধর সাহিত্যিক তো সেখানে শালমহুয়ার সঙ্গে অনেক অশোকগাছও লাগিয়েছেন। সেগুলি এখন পূর্ণযৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে।
দোহলী মানে অশোকগাছ। দোল ও হোলি এই দুটি শব্দের উৎপত্তিই দোহলী থেকে। মানে অশোকবৃক্ষের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত এই উৎসব। আসলে দোলকে শ্রীকৃষ্ণের দোলা বা ঝুলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে অনেক পরে। হোলিকাদহনের উপাখ্যানও মনে হয় প্রক্ষিপ্ত। শ্রীকৃষ্ণের সময় পুতনা ছিল, হোলিকা ছিল না। সম্পূর্ণভাবে ঋতুপরিবর্তন ও প্রেমের জাগরণ থেকে পুরাকালে সৃষ্টি হয়েছিল দোল বা হোলির।বসন্তোৎসব,দোলযাত্রা, হোলি, সবই আসলে অশোকপুষ্প বিকশিত হওয়ার জয়গানের উৎসব। দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতিতে হোলি শব্দটি প্রাধান্য পেয়েছে। উত্তর, পূর্ব ও মধ্যভারতে দোল, হোলি, ফাগুয়া, সব চলে।
আমরা, বাঙালিরা, যেমন দোল, হোলি — দুটোতেই সমান সচ্ছন্দ। কাউকে বাগে পেলেই হল।
এবার আমার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতটি পুরোটা লিখি। গাইতে সুবিধে হবে।
ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান —
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান —
আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ॥
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান॥
পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা।
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান॥