চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর আগেই জানা যায়, আগের বছরের তুলনায় এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার কম। কারণ, গত বছর যে সংখ্যাটা ছিল ৭ লক্ষ ৯০ হাজারের মতো এবার তা কমে হয়েছে ৫ লক্ষ ৯ হাজারের মতো। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মাধ্যমিক উত্তীর্ণের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার ৪২৮ জন। তাদের মধ্যে একাদশের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিল ৫ লক্ষ ৫৪ হাজার জন। তার থেকে চলতি বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে ৫ লক্ষ ৯ হাজারের মতো পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ একাদশ শ্রেণিতে যতজন রেজিস্ট্রেশন করেছিল তার থেকে ৪৫ হাজার কম পরীক্ষার্থী এবার উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সংখ্যার মধ্যে ৪৫.৩২ শতাংশ ছাত্র আর ৫৪.৬৮ শতাংশ ছাত্র। অর্থাৎ ছাত্রীর সংখ্যা ৪৭ হাজার ৬৭১ জন বেশি। এইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কম হওয়ার কারণ কি? পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০২৩ সালে মাধ্যমিকে কম পরীক্ষার্থী কম হওয়ার জন্য একাধিক কারণ তুলে ধরেন। তার মধ্যে অন্যতম হল করোনার জেরে স্কুলছুট পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এর পাশাপাশি তারা পঞ্চম শ্রেণীতে ভরতি হওয়ার ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে পঞ্চম শ্রেনীতে ভরতির ক্ষেত্রে বয়স নিয়ে কড়াকড়ি নিয়মের কথা বলেন। উল্লেখ্য, ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ বছরের একদিন কম হলেই কোনো পড়ুয়াকে ক্লাস ফাইভে ভরতি করা যাবে না। তার ফলে আগে যেখানে কয়েকমাস কম হলেও যে কোনো পড়ুয়া পঞ্চম শ্রেণীতে ভরতি হতে পারত সেখানে বয়স কম হওয়ায় ক্লাস ফাইভে অনেকেই ভর্তি হতে পারেনি।
অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের বক্তব্য, একাদশ শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশনের সময় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাঝেই বহু শিক্ষার্থী শিক্ষার্থী পেশামুখী পড়াশুনোর দিকে ঝুঁকে পড়ে, কেউ নার্সিং কিংবা পলিটেকনিক কেউবা অন্য ট্রেনিং ভিত্তিক কোর্সের দিকে চলে যায়। তাছাড়া বেশ কিছু শিক্ষার্থী নানা কারণে মাঝপথে পড়াশোনাও ছেড়ে দেয়। তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে শুধু কি এইসব কারণেই এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেল, শিক্ষার্থী তো বছর বছর কমছে। শিক্ষা সংসদের তথ্যই বলছে, ২০২৩ সালের মাধ্যমিকে কম পরীক্ষার্থীর কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে রেজিস্ট্রেশনের পরও বহু পরীক্ষার্থী গত কয়েকবছর ধরে বহু শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেনি। ২০২০ সালে একাদশ শ্রেনীতে ৮ লক্ষ ১০ হাজার ৬৯৭ শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেও ২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় ৭ লক্ষ ৪৫ হাজার ৭৩০ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশনের পর উচ্চমাধ্যমিক দেয়নি ৬৪ হাজার ৯৬৭ জন পড়ুয়া। ২০২১ সালে একাদশ শ্রেনীতে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার ৭৬২ পড়ুয়া রেজিস্ট্রেশন করে ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক দেয় ৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১২ জন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করেও উচ্চমাধ্যমিক দেয়নি ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৩৯ জন। একইভাবে ২০২২ সালে ৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৩৫ পড়ুয়া একাদশে রেজিস্ট্রেশন করে ২০২৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক দেয় ৭ লক্ষ ৮৯ হাজার ৯৪১ জন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করেও উচ্চমাধ্যমিক দেয়নি ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৯৪ জন। ২০২৩ সালেও একাদশে রেজিস্ট্রেশন করা পড়ুয়ার সংখ্যার চেয়ে এবার ৪৫ হাজার ৩৮৮ জন কম পড়ুয়া পরীক্ষা দিচ্ছে। একাদশে রেজিস্ট্রেশনের পর এতজন শিক্ষার্থীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে পলিটেকনিক বা বৃত্তিমূলক কোর্সে ভর্তির কথা বলা হলেও বস্তুতপক্ষে একাদশে রেজিস্ট্রেশনের আগেই ওই সব ক্ষেত্রের ভরতি শুরু শেষও হয়ে যায়। তাছাড়া অল্প কিছু পড়ুয়া হয়ত যায় কিন্তু, ক্রমাগত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যে কমছে, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
প্রশ্ন, কেন পড়ুয়াদের স্কুলে ধরে রাখা যাচ্ছে না? অথচ একাদশ শ্রেণীর জন্য ট্যাবের ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছে না ৫৫ হাজার ছাত্রছাত্রী! জানা গিয়েছে, এই খাতে ৫৫ কোটি টাকার সরকারি তহবিল স্রেফ ‘ড্রপ আউট’ ছাত্রছাত্রীদের পিছনে খরচ হয়ে গিয়েছে। একাদশ এবং দ্বাদশ দু’টি শ্রেণিতেই ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে যাতে মোবাইল ফোন বা ট্যাব ব্যবহার করতে পারে, তার জন্যই সরকার এই প্রকল্প চালু করেছিল, ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্প নীতি বদল করে দ্বাদশ শ্রেণীর পরিবর্তে একাদশ শ্রেণী থেকেই মোবাইল কেনার ১০ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ফল কি হল? রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর ছাত্রীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়াতে কন্যাশ্রী ও রূপশ্রীর মতো বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। তাহলে আগ্রহ কমছে কেন? পরীক্ষা না–দিলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাত্রীরা কন্যাশ্রীর ২৫ হাজার টাকা হাতে পেয়ে যাচ্ছে বলে? দেখা গিয়েছে অনেকে বিয়েও করে ফেলেছে। অনেকে বলছেন এখন ছাত্রছাত্রীরা সহজেই এত কিছু হাতে পেয়ে যাচ্ছে, যে তাদের পড়াশোনায় আর আগ্রহ থাকছে না। কিন্তু আসল কথাটাই বলা হচ্ছে না যে, সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল নিয়ে ছাত্র ও অভিভাবকদের কোনো উৎসাহ নেই। সেখানে পড়ুয়ার সংখ্যাও কমেছে, স্কুলগুলির শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি, শিক্ষার গুণগত মান, ব্যবহারিক মূল্য নিয়ে ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র অনীহা তৈরি হয়েছে। তথ্য জানাচ্ছে, রাজ্যের দশ হাজারের বেশি স্কুল আছে যেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা তিরিশও নয়। যদিও তা মূলত প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুল, কিন্তু বহু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের অবস্থাটাও ভাল নয়। তার মানে কি এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা আর স্কুলে যাচ্ছে না? অবশ্যই যাচ্ছে কিন্তু অভিভাবকরা সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলকে বর্জন করে বেছে নিচ্ছেন বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। আজ নয় বেশ কয়েক বছর আগেই এ রাজ্যের যে কোনো শহরের উচ্চবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাংলা মাধ্যম স্কুল ছেড়েছে। আর সেই সুযোগে ওই স্কুলগুলি যথেচ্ছভাবে কেবল ব্যবসার খাতিরেই পিটছে কোটি কোটি মুনাফা।