সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক লেখায় লিখেছিলেন দেবী সরস্বতীকে দেখে নাকি তাঁর কামবাসনা জেগে উঠেছিল কৈশোরে। তিনি কিন্তু দেবী সরস্বতীর হাতের বীণাটিকে ভালো করে দেখেননি। তাহলে হয়তো তিনি অন্তঃসলিলা সরস্বতীর বীণারহস্যের উন্মোচনও করতে পারতেন।
দেবী সরস্বতী ঋগ্বেদে নদীগণের দেবী হিসেবে বন্দিত হয়েছেন৷ নদীর দেবী বাগ্দেবী হলেন কীভাবে? কী সেই মেটামরফোসিস? কল্পনাকে একটু বিস্তৃত করলে দেবী সরস্বতীর অনুষঙ্গে কয়েকটি জলজ-সভ্যতার চিহ্ণ খুঁজে পাওয়া যাবে৷ তিনি পদ্মাসনা, হংসবাহিনী৷ পদ্ম ও হাঁস জলে অধিষ্ঠিত৷ সরস্বতীর হাতের বীণার সঙ্গে নাবিক বা মাঝির হাল বা দাঁড়ের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়৷ সরস্বতীর ‘হাল’ দেখেই বোঝা যায়, তিনি জল থেকে সদ্য ডাঙায় উঠেছেন৷ সরস্বতীর শুভ্রবসন কীসের ইঙ্গিত করে? জলবিধৌত পরিধেয়বস্ত্র যে বর্ণহীন বা শ্বেতরূপ ধারণ করে, তা সবাই দেখেছে৷ আবার দেবীর কুচযুগ নন্দিত কীসের হারে! না মুক্তার হারে। মুক্তা তো সামুদ্রিক ঝিনুকের পেটেই থাকে। সরস্বতীকে জল থেকে ডাঙায় তোলা হলটা কেন? ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’-এর ব্যাখ্যাটা মন্দ নয়৷ জল যেমন জমিকে উর্বর করে, বিদ্যা তেমনি মস্তিষ্ককে উর্বর করে, সরস হয় মেধা ও মনন৷
সরস্বতীর বীণার একটি পোশাকি নাম আছে৷ ‘কচ্ছপী বীণা’ বলে এটিকে৷ যেমন নারদের বীণার নাম ‘মহতী’৷ বাগ্দেবী সরস্বতীর বীণার নাম কচ্ছপী কেন হল, তা বোঝা শক্ত৷ ঋগ্বেদে সরস্বতীকে নদীমাতা বা নদীর দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ কূর্ম বা কচ্ছপ জলের বাসিন্দা, তাই তার শক্ত খোল দিয়ে তৈরি হল বাগ্দেবীর বীণা৷ বলা যায়, নদীবাচী সরস্বতীর দেবীবাচী হওয়ার ‘মেটামফোসিস-পথে’ এই কচ্ছপী বীণার আমদানি৷
অন্য একটি সম্ভাবনার কথাও মনে আসে৷ পুরাণমতে দেবী সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার স্ত্রী৷ ব্রহ্মার মানসপুত্র হলেন কশ্যপ মুনি৷ ইনি এক বিশিষ্ট মুনি, যিনি প্রজাপতি দক্ষের তেইশজন কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন৷ এই কশ্যপ মুনি দক্ষের মেয়েদের ছাড়াও আরও কয়েকজন রমণীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁদের একজন হলেন সুরভি৷ সুরভি হলেন রুদ্রগণের মাতা৷ রুদ্রবীণার নাম আমাদের জানা আছে৷ মনে হয়, কশ্যপ মুনিই তাঁর মাতৃদেবী সরস্বতীর হাতের বীণাটি নির্মাণ করেছিলেন৷ ‘কশ্যপী বীণা’ নামে সরস্বতীর বীণাটি পরিচিত হয়৷ কশ্যপী বীণা ক্রমে অপভ্রংশপ্রাপ্ত হয়ে ‘কস্যপী বীণা’ তথা ‘কচ্ছপী বীণা’য় পরিণত হতে পারে৷ কচ্ছপের সংস্কৃত নাম কস্যপ৷ তাই কি এই বিভ্রান্তি!
আবার পদ্মপুরাণ অনুসারে কশ্যপমুনির স্ত্রী হলেন বাগদেবী সরস্বতী। তাহলে তো সরস্বতীই সরাসরি কশ্যপী। যেমন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে নারায়ণের স্ত্রীরূপে তিনি হলেন নারায়ণী। কশ্যপীর হাতে যে বীণা থাকে তারই নাম কশ্যপী। কশ্যপী থেকে কচ্ছপী হতে আর কতক্ষণ! সরস্বতীর হাতের বীণাটির নাম কী জিজ্ঞেস করলে বসন্তপঞ্চমীর রোমিও জুলিয়েটরা ভিরমি খেতে পারে!